গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে ৩০ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্যোগ
২৬ মার্চ ২০২১আগামী ১ এপ্রিল জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হচ্ছে৷ সেখান থেকেই এই উদ্যোগের শুরু হবে৷ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি এই উদ্যোগ নিয়েছে৷
এই সংগঠনের সভাপতি শাহরিয়ার কবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকারি উদ্যোগেও এখন কেন যেন ভাটা পড়ে গেছে৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও যেভাবে উৎসবের সঙ্গে শুরু হয়েছিল, এখন তেমন গতি নেই৷ তাই আমরা এবার ৩০ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছি৷ জাতীয় সংসদের সদস্যদের দিয়ে ১ এপ্রিল এই কার্যক্রম শুরু হবে৷ শুধু দেশের নয়, বিদেশেও যারা আমাদের বন্ধু আছেন, তারাও এখানে স্বাক্ষর করবেন৷ এরপর এই স্বাক্ষরগুলো আমরা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্রের কাছে পাঠাবো৷ আসলে এতবছর পর গণহত্যার স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব, কিন্তু কঠিন৷ এই কারণে আমরা আগে জনমত গঠনের কাজে নেমেছি৷ আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বহুবার বলেছি, বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে চিঠি পাঠাতে৷ কিন্তু কেন তারা পাঠায়নি, আমরা জানি না৷ এমনকি ভারতের কাছেও চিঠি পাঠায়নি৷ তাহলে তারা তো আগে স্বীকৃতি দিতো? ৯০ বছর পর আর্মেনিয়া গণহত্যার স্বীকৃতি পেয়েছে৷ সেখানে সরকার ও জনগণ একসঙ্গে কাজ করেছে৷ এখানেও যদি আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি, তাহলে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় সম্ভব৷’’
৫০ বছর আগে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট'-এর নামে নিরীহ বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালায়৷ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন৷ ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত নয় মাস ধরে এই গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ চলে৷ যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে এবং দুই লাখ নারী ও মেয়ে শিশুর ওপর যৌন সহিংসতা চালায়৷
তবে ২৫ মার্চ রাতে যে গণহত্যা, সেটার এখন আর স্বীকৃতি পাওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করেন শাহরিয়ার কবীর৷ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ ১৯৬টি দেশ সেখানে সই করেছে৷ এর মধ্যে বাংলাদেশও আছে৷ ফলে এখন আর বলার সুযোগ নেই যে, আমরা এটা মানি না৷ তাই আমাদের এখন ৯ মাসের যুদ্ধে যে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে সেটার স্বীকৃতি পেতে হবে৷ অনেক বড় দেশই এটার বিরোধিতা করবে তারপরও এটা আদায় করা সম্ভব৷ কারণ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন তো তখন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, ফলে তারা চাইবে না৷
গণহত্যার স্বীকৃতির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানবতা অভিশাপগ্রস্থ কি-না সে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এটা আন্তর্জাতিক অপরাধ৷ এর স্বীকৃতি হতে হবে আন্তর্জাতিকভাবেই৷ কারণ, এখানে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্রে, চীনসহ অনেক দেশই তো তখন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল৷ আমরা তো দেখেছি, একাত্তরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত যে তারবার্তা পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে সেখানে গণহত্যার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে৷ তারপরও নিক্সন সেদিকে কর্ণপাত করেননি৷ তিনি পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে গেছেন৷ ফলে তারা চাইবে না এটার স্বীকৃতি হোক৷ যেমন যুদ্ধাপরাধের বিচারেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে আসেনি৷ বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধের বিচারকরেছে৷ এটা তো যারা স্থানীয় অপরাধী তাদের বিচার করা গেছে৷ কিন্তু যারা গণহত্যা চালিয়েছে, তারা তো পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে এখন অবস্থান করছেন৷ তাদের তো বিচার হতে হবে৷ এমনকি তাদের মরনোত্তর বিচার করাও সম্ভব৷ তা না হলে আইনী ন্যায্যতা আসবে না৷’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ বিভাগের খন্ডকালীন শিক্ষক ও প্রবীণ সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এই গণহত্যার শিকার হওয়া মানুষের লাশ দেখেছি৷ মাটিচাপা দেওয়ার পরও দেখা গেছে, কারো হাত কারো পা বের হয়ে আছে৷ যুদ্ধে আমাদের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে৷ এটা কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কখনো হয়নি৷ যেসব দেশে গণহত্যা হয়েছে, সেখানে কিন্তু একটা দেশের সঙ্গে আরেকটা দেশের যুদ্ধ হয়েছে৷ আমাদের এখানে কিন্তু শান্তিপূর্ণ নিরীহ মানুষের উপর গণহত্যা চালিয়েছে৷ আমরা পাল্টা হিসেবে আমরা যুদ্ধ শুরু করি৷ এটার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না হওয়ার একটা বড় কারণ মনে হয়, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিধ্বস্ত একটি দেশ, অর্থনৈতিক পুনর্হঠনসহ এই কাজগুলোতে বেশি মনোযোগ দিয়েছি৷ যুক্তরাষ্ট্র, চীন তো অস্ত্র দিয়ে এই গণহত্যায় সহযোগিতা করেছে৷ ফ্রান্স, বৃটেনসহ আরো অনেক দেশই তখন সরাসরি এই গণহত্যার বিরোধিতা করেনি৷ এই কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের অবস্থানটা খুব জোরালো ছিল না৷ এখনও এটার সময় যায়নি৷ এটার স্বীকৃতি পেতে হলে দালিলিক প্রমাণ দিতে হয়৷ সেগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে৷ আমার মনে হয় সবাই মিলে কাজগুলো করতে পারলে এটার স্বীকৃতি পাওয়া যাবে৷’’