৫৯তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে প্রথমবার বাংলাদেশের শিক্ষার্থীর স্বর্ণপদক জয়কে অসাধারণ বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা৷ অবহেলিত শিক্ষার মধ্যেও এই জয় অনুপ্রেরণা বলে মনে করেন তাঁরা৷
বিজ্ঞাপন
অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ দলের সদস্য চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী ১২ জুলাই স্বর্ণ জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করেন৷ ৩ জুলাই রোমানিয়ার ক্লুজ-নাপোকা শহরে হয় আইএমও-র এবারের আসর৷
মোট ৪২ নম্বরের পরীক্ষায় ৩২ পয়েন্ট পেয়ে স্বর্ণপদক অর্জন করেন জাওয়াদ৷ এটিই বাংলাদেশ দলের প্রথম স্বর্ণপদক অর্জন৷ এর আগে ৫৮তম আইএমওতেও রৌপ্য পদক এবং ৫৭তম আইএমওতে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেন তিনি
৬ সদস্যের বাংলাদেশ দলের অপর তিন সদস্য তাহনিক নূর সামিন ২৩ পয়েন্ট, জয়দ্বীপ সাহা ১৯ পয়েন্ট এবং তামজিদ মোর্শেদ ১৮ পয়েন্ট পেয়ে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেছে৷ দলের আরো দুই সদস্য রাহুল সাহা ও সৌমিত্র দাশ সম্মানজনক স্বীকৃতি অর্জন করেছে৷
এবার দলীয়ভাবে মোট ১১৪ নম্বর অর্জন করেছে বাংলাদেশ৷ এ যাবত কালে এটিই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ নম্বর৷ এর আগে মোট ১৩টি আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়ে ৬টি রৌপ্য, ১৯টি ব্রোঞ্জ এবং ২৫টি সম্মানজনক স্বীকৃতি অর্জন করে বাংলাদেশ৷
Professor Mohammad Kaykobad - MP3-Stereo
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার দৃষ্টিতে এটা একটা অসাধারণ অর্জন৷ আমাদের মাধ্যামিক শিক্ষার মান নিয়ে যেখানে অনেক প্রশ্ন আছে তারপরও আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীর স্বর্ণপদক অর্জন অনেক বড় ঘটনা৷ বিশ্বের প্রায় ১০০ দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা এই গণিত অলিম্পিয়াডে অশ নেয়৷ তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে মেধার প্রমাণ রাখে তারা স্বর্ণপদক পায়৷ দক্ষিণ এশিয়া থেকেই জাওয়াদই প্রথম স্বর্ণপদক পেল৷''
তিনি বলেন, ‘‘এটা বলা হয়ে থাকে এই উপমহাদেশে বাংলাদেশের মানুষের মেধা বরাবরই উঁচু মানের ছিল৷ সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু মত মেধাবী মানুষ এখানে জন্ম দিয়েছেন৷ তার ছিঁটেফোটা আমরা এখনো দেখতে পাই৷''
অবেহেলিত শিক্ষাব্যবস্থাতেও এই অর্জনকে বেশ গুরুত্বের সাথেই দেখছেন তিনি৷ ‘‘শিক্ষায় জিডিপি'র ৬ শতাংশ বিনিয়োগ করা উচিত হলেও এখন মাত্র দুই শতাংশ বিনিয়োগ করা হয়৷ এই অবহেলার মধ্যেও আমাদের ছেলেমেয়েদের এই অর্জন অনেক বড়৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘এই অর্জন আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের আরো উৎসাহিত করবে৷ জ্ঞানচর্চায় তাঁরা মনোযোগী হবে৷ আমরা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছি৷ কিন্তু ৪০-৫০ বছর আগে যারা আমাদের সমান কাতারে ছিল তাদের অনেকে আমাদের ছাড়িয়ে গেছে৷ আমাদের এখন এগিয়ে যেতে হবে৷ আর সেজন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে৷''
Sayeda Farhana Khanam - MP3-Stereo
ছেলের এই অর্জনে স্বাভাবিকভাবেই গর্বিত জাওয়াদের মা সৈয়দা ফারহানা খানম৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকেই গণিতের প্রতি আগ্রহ বাড়ে জাওয়াদের৷ তারপর যখন গণিত অলিম্পিয়াডে গেল সেখান থেকে আরো বেশি অনুপ্রাণিত হল৷ নিজে নিজে চর্চা বাড়িয়ে দেয়৷ ছোট বেলায় আমি তাকে মেন্টাল অ্যারিথমেটিক ইউনিমাস, আমাদের দেশে যেটা আছে, আলোহাও বলে, এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলাম৷ চট্টগ্রামে এর চেয়ে বেশি চর্চার কোনো জায়গা ছিলনা৷ ও নিজেই বই থেকে চর্চা করতো৷ তবে সবচেয়ে বেশি সহায়ক হয় ইন্টারনেট৷ এখন যা করে তা ইন্টারনেটের মাধ্যইে করে৷ বাসায়, ঢাকায় যখন যেখানে থাকে ইন্টারনেটের সহায়তায় চর্চা করে৷''
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড টিমের আজ দেশে ফেরার কথা রয়েছে৷
৭ জুলাই উদ্বোধনী পর্বের মাধ্যমে শুরু হয় ৫৯তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড ২০১৮৷ এ বছরের অলিম্পিয়াডে ১১৬টি দেশের ৬১৫ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়৷ দলগতভাবে ১১৪ নম্বর পেয়ে ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪১তম৷
শিশুদের নানা রকমের ক্লাসরুম
বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে শুরু হয় শিক্ষাজীবন৷ সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য শিশুদের শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই৷ চলুন দেখা যাক, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রেণিকক্ষে শিশুদের কীভাবে লেখাপড়া শেখানো হয়৷
ছবি: picture-alliance/landov
বেশির ভাগ দেশের শ্রেণিকক্ষে যা থাকে...
বিশ্বের প্রায় সব দেশের শ্রেণিকক্ষেই চক আর ব্ল্যাক বোর্ড থাকে৷ শিক্ষক বা শিক্ষিকা সেই ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে শিক্ষার্থীদের বোঝান৷ শিক্ষার্থীরা বেঞ্চে বসে বসে শোনে৷ তবে অনেক দেশই এই সাবেকি ব্ল্যাকবোর্ড এবং চক ছেড়ে দিয়েছে৷ আবার এমন দেশও আছে, যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের মাথার ওপরে কোনো ছাদ নেই৷ মাটিতে বসেই লেখাপড়া করতে হয় তাদের৷
ছবি: AP
দক্ষিণ কোরিয়ায় ডিজিটাল বই...
দক্ষিণ কোরিয়ার স্কুলে এসে গেছে কম্পিউটার৷ ইন্টারনেট সংযোগও দেয়া হয়েছে প্রতিটি ক্লাসরুমে৷ অর্থাৎ ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের হাতে কোনো বই-খাতা থাকবে না৷ বইয়ের পরিবর্তে ‘ই-বুক’ দেয়া হবে তাদের৷ সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে সরকার৷ সবাইকে ডিজিটাল শিক্ষাদান পদ্ধতির আওতায় নিতে দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েদের বিনামূল্যে ‘ট্যাবলেট পিসি’ দেয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে৷
ছবি: AP
ঘানার শিশুদের অবস্থা
অনেক দেশের স্কুলে আবার কম্পিউটার তো দূরের কথা, ক্লাসরুমই নেই৷ আফ্রিকার দেশ ঘানার এই স্কুলটি দেখুন৷ ভবনই নেই! তাই গাছের ছায়াতেই নেয়া হচ্ছে ক্লাস৷ শিক্ষিকা পড়াচ্ছেন আর ছোটমনিরা বেঞ্চে বসে মন দিয়ে শুনছে তাঁর কথা৷
ছবি: Fotolia/Living Legend
জার্মানির অত্যাধুনিক ক্লাসরুম
জার্মানিতে কিন্তু ছোট ছোট বাচ্চারাও ক্লাসে পেন্সিল ব্যবহার করে না৷ নোট লেখার বইও নয়৷ টাচ প্যাড, স্মার্টবোর্ড, নেটবুক – এই সমস্ত আধুনিক জিনিসপত্র এ বয়সেই এসে গেছে তাদের হাতে৷
ছবি: AP
যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে শিশুদের শিক্ষা যেন বাড়তি চাপ৷ ছবির এই চার বছর বয়সি শিশুগুলোর মতো সব শিশুকেই বলতে গেলে মায়ের কোল থেকে নেমে ঢুকে পড়তে হয় স্কুলে৷ চাপ যে তখন থেকেই শুরু!
ছবি: AP
কেনিয়ার স্কুল এবং ক্লাসরুম
কেনিয়ায় শিক্ষাজীবনের প্রথম আট বছর শিক্ষার্থীদের কোনো বেতন দিতে হয় না৷ তারপরও লেখাপড়া করা সবার জন্য খুব সহজসাধ্য নয়৷ দরিদ্র পরিবারের বাবা-মায়েরা বই-খাতা, পেন্সিল, পোশাক, জুতো ইত্যাদির খরচ জোগাতে পারেন না বলে অনেক শিশুকেই লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়৷
ছবি: DW/J.Bruck
ব্রিটেনের স্কুলে ‘ইউনিফর্ম’ বাধ্যতামূলক
ইংল্যান্ডের প্রায় সব স্কুলেই শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত পোশাক পরতে হয়৷ সবাই এক রকম পোশাক পরলে শিক্ষার্থীদের চিনতে সুবিধা হয় এবং তাদের পড়াশোনাতেও মন বসে – এমন কিছু যুক্তিতেই শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট পোশাক পরার নিয়ম মানছে স্কুলগুলো৷ তবে ব্রিটেনে একটা সুবিধা আছে৷ দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ হিসেবে অনুদান দেয়া হয়৷ ফলে দরিদ্ররা চাইলেই ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
পাকিস্তিনে অবহেলিত শিক্ষাখাত
পাকিস্তানে গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমিয়ে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে৷ ফলে শিক্ষার হার আরো কমছে, কমছে স্কুলও৷ ওপরের ছবিতে একটি পার্কে লেখাপড়া করতে দেখা যাচ্ছে শিশুদের৷ পাকিস্তানে এমন দৃশ্য অপরিচিত নয়৷
ছবি: AP
দক্ষিণ সুদানে মেয়েরা বিপদে...
দক্ষিণ সুদানেও প্রায় একই অবস্থা৷ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশটির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রীতিমতো সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছে৷ সে দেশের মাত্র ১৬ ভাগ নারী এখন কোনো রকমে পড়তে এবং লিখতে পারে৷ যুদ্ধের ধ্বংসলীলা থেকে হাতে গোনা যে কয়েকটি স্কুল রক্ষা পেয়েছে, তার মধ্যে অনেকগুলোতে চেয়ার-টেবিল, বেঞ্চ নেই৷ বই-পত্রও নেই কিছু স্কুলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উন্নতিশীল ব্রাজিলেরও করুণ অবস্থা
দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে ব্রাজিলে৷ কিন্তু তাতে দরিদ্রদের ভাগ্যের খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না৷ গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে তাই খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হয় শিশুদের৷
ছবি: dapd
উন্নতিশীল ব্রাজিলেরও করুণ অবস্থা
দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে ব্রাজিলে৷ কিন্তু তাতে দরিদ্রদের ভাগ্যের খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না৷ গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে তাই খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হয় শিশুদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এবং বাংলাদেশ...
২০১৩ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের সময় অসংখ্য স্কুলের ক্ষতি সাধন করা হয় বাংলাদেশ৷ এ বছর দীর্ঘদিন হরতাল, অবরোধ চলায় স্কুলগুলোও অনেক দিন বন্ধ ছিল৷ এক পর্যায়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ক্লাস নিতে শুরু করে কিছু স্কুল৷ হরতাল-অবরোধের কারণে সপ্তাহের ৫-৬ দিন গৃহবন্দী, তারপর ছুটির দিনে স্কুলবন্দী৷ বাংলাদেশের শিশুদের অসহায়ত্ব ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন৷