গরম যত বাড়ছে তত বাড়ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার৷ কিন্তু এতে ঘরের ভিতরে সাময়িক স্বস্তি মিললেও বাইরের পরিবেশ আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে৷ তাহলে বিকল্প কী?
বিজ্ঞাপন
কুয়েতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ছাড়া গ্রীষ্মে কারো পক্ষে বসবাস কঠিন এক ব্যাপার৷ দেশটিতে এক সময়ে বসবাস করতেন আলেক্সান্ডার নাসির৷ তিনি বলেন, ‘‘কুয়েতে আপনাকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে হবে৷ সেখান থেকে বের হয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শপিং মলে যেতে হবে৷''
২০১৪ সাল থেকে নাসির বার্লিনে আছেন৷ কিন্তু ইউরোপে এসেও গ্রীষ্মে ঘাম ঝরানো তাপমাত্রা থেকে মুক্তি মিলছে না৷ তুলনামূলক কম গরম সত্ত্বেও জার্মানির রাজধানীতে এরিমধ্যে তিনি ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করেছেন কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের সুবিধা ছাড়া৷ কেননা জার্মানির বাড়িঘরগুলোতে এসি নেই বললেই চলে৷ অবশ্য তিনি নিজেও চান না পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই ব্যবস্থায় ফিরে যেতে৷ নাসির বলেন, ‘‘আমি আবার এসি ব্যবহারে ফিরে যেতে চাই না৷ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পরিস্থিতি প্রতি বছরই খারাপ থেকে আরো খারাপ হচ্ছে এবং আমরা এর সঙ্গে আসলে মানিয়ে নিচ্ছি না৷''
বাড়ছে এসির চাহিদা
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির ২০১৮ সালের হিসাবে বৈশ্বিক বিদ্যুৎ ব্যবহারের ১০ শতাংশ খরচ হয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও বৈদ্যুতিক পাখাতে৷ জাপান ও যুক্তরাজ্যে এসির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি৷ দেশ দুইটিতে ৮০ শতাংশ ঘর-বাড়িতে আছে এমন ব্যবস্থা৷ অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে গরম অঞ্চলগুলোতে এসি ব্যবহার করেন মাত্র আট শতাংশ মানুষ৷ কিন্তু ক্রমশ তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে এসির চাহিদা বেড়েই চলছে৷ এতে ২০৫০ সাল নাগাদ বিদ্যুত ব্যবহারের চাপ তিনগুণ বাড়বে৷
কিন্তু বিদ্যুতের ব্যবহার যত বাড়বে তত পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে৷ বাড়বে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের গতি৷ এই চক্র ভাঙতে বিকল্প উপায় বেছে নেয়ার কথা বলছেন বিজ্ঞানীরা৷ তাদের মতে এতে নগরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রকোপ ঠেকানোর পাশাপাশি বৈদ্যুতিক গ্রিডের উপর চাপও কমানো যাবে৷
গরমে যা যা কম আর যা যা বেশি করবেন
বিশ্বের অনেক দেশের মানুষই এখন গরমে হাঁসফাঁস করছে৷ ইউরোপও পুড়ছে দাবদাহে৷ এই সময়ে কী করে এবং না করে, কী কী খেয়ে আর কী কী না খেয়ে মানুষ একটু ভালো থাকছেন? দেখুন ছবিঘরে...
গরমে অনেকেই সবজি বেশি খান৷ সবজিতে মরিচ খান? মরিচে ক্যাপস্টাসিন থাকে এবং তা এমন এক অবস্থা তৈরি করে যা দেখে মস্তিষ্ক মনে করে, শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত খুব বেড়ে যাচ্ছে, তাই সঙ্গে সঙ্গে সে ঘামগ্রন্থিগুলোকে বার্তা পাঠায়, ‘‘কই হে, কাজ শুরু করো৷’’ অমনি গ্রন্থিগুলো ত্বকের ঘাম বাষ্পীভূত করতে থাকে দ্রুত আর ঘাম শুকালে শরীরে কেমন একটা শীতল অনুভূতি আসে৷
ছবি: Karl Allgäuer/Zoonar/picture alliance
গরমে চীন, ভারত, বাংলাদেশের মানুষ যা করে
চীনে গরমে ওষুধ হিসেবে শরীর উষ্ণ করে এবং শরীর শীতল করে- এমন দুই ধরনের খাবার সমানভাবে খাওয়ার ঐতিহ্য রয়েছে৷ চীনারা বলেন, ইয়িন (ঠান্ডা) আর ইয়াং (গরম জিনিস) একসঙ্গে খাও, গায়ে শক্তি পাবে৷ তো চীনের মানুষ তখন তরমুজ, শসা বেশি খান৷ আর ভারতীয়রা কী করেন? কেন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে তো বলাই আছে, গরমে ডাবের পানি অতীব উপকারী! প্রচণ্ড দাবদাহে বাংলাদেশেও কিন্তু ডাবের পানি বিক্রি বেড়ে যায়৷
ছবি: Rehman Asad/NurPhoto/picture alliance
নিম্বু পানি, কিংবা লেবুর শরবত
গরমে লেবুর রসও খুব উপকারী৷ তাই ভারতে দাবদাহে ‘নিম্বু পানি’ খাওয়ার ধুম পড়ে যায়, বাংলাদেশের মানুষের শরীরেও প্রশান্তি আনে লেবুর শরবত৷ একই পানীয় মধ্যপ্রাচ্য এবং মালয়েশিয়াতেও পান করা হয়, তবে সেখানে তার নাম যথাক্রমে লিমোনানা’ এবং ‘লিমাউ আসাম বোই’৷ গরমে লেবুর কদর আসলে বিশ্বজোড়া৷ জার্মানরাও ‘সিত্রোনেজাফট’ খুব পছন্দ করেন৷
ছবি: F. Hecker/blickwinkel/picture alliance
কম বিয়ারে বেশি আরাম
যেসব দেশে বিয়ার প্রায় পানির মতো পান করা হয়, গরমে সেসব দেশেও বিয়ার বিক্রি অনেক কমে যায়৷ কারণ, বিজ্ঞানীরা বলেন, গরমে যত কম অ্যালকোহল ততই মঙ্গল, বিয়ার খেলেও ‘পরিমানমতো’ খাওয়াই ভালো৷
ছবি: Matthias Schrader/AP Photo/picture alliance
সুতি বা লিনেনের কাপড়
সবাই বলেন, গরমে হাল্কা রংয়ের কাপড় পরতে হয়৷ তা সেই কাপড়ই খুব আঁটোসাঁটো হলে কিন্তু আর আরাম লাগবে না৷ তাই একটু ঢোলা কাপড় পরাই ভালো৷ এমনকি গরমে স্লিভলেস জামা পরারও কোনো দরকার নেই৷ বরং ফুলহাতা জামা গায়ে দিয়ে ত্বককে রোদের হাত থেকে একটু বাঁচান৷ আর হ্যাঁ, সুতি বা লিনেনের কাপড়ও গরমে পরতে খুব আারাম৷৷
১৯৮০ সালে গরমে কাপড়ের রংয়ের প্রভাব পরীক্ষা করে দেখে দ্য নেচার৷ এক মরুভূমিতে ঢিলেঢাল সাদা এবং কালো কাপড় আর শর্টসের ওপরে সেনাবাহিনীর পোশাক পরিয়ে কিছু মানুষকে নামিয়ে দিয়ে জার্নালটি দেখেছে, হালকা রংয়ে তাপ প্রতিফলিত হয় তা ঠিক, কালো রং শরীরের তাপ শুষে নিতে সহায়তা করে, তা-ও ঠিক, তবে কাপড়ের রং আসলে বড় কোনো ব্যাপার নয়৷ ঢিলেঢালা কাপড় পরলে বাতাস চলাচলে সুবিধা হয় এবং তাতে এমনিতেই আরাম বেশি লাগে৷
ছবি: Michael Weber/imageBROKER/picture alliance
নিরাপদ সময়, কিংবা নিরাপদ ছাতা
হ্যাঁ, ইউরোপের মানুষ এখন জেনে গেছে, গ্রীষ্মের গরমে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত চার দেয়ালের ভেতরে থাকা ভালো৷ ওই সময় ছাতা নিয়ে বের হলেও গরমে হাঁসফাঁস করতে হবে ৷ তবে আজকাল অবশ্য এমন ছাতাও বাজারে এসেছে, যাতে তাপ প্রতিফলিত হয়ে দূরে সরে যায়৷
ছবি: Tiziana Fabi/AFP/Getty Images
হাতপাখা
বিদ্যুৎ যেখানে নেই, এসি চলছে না বা মাথার ওপরে যেখানে ফ্যানও ঘুরছে না, তেমন পরিবেশে হাতপাখার ব্যবহার সব দেশের মানুষই করে থাকেন৷ ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বেই তো এখন জ্বালানি সংকট প্রকট৷ তাই এই দাবদাহে হাতপাখার ব্যবহার স্বাভাবিক কারণেই বেড়েছে৷
ছবি: Burak Akbulut/AA/picture alliance
8 ছবি1 | 8
সমাধান কী?
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলোর জন্য সহজ সমাধান হলো রাতে জানালা খোলা রেখে ঘরে পর্যাপ্ত ঠান্ডা বাতাস ঢুকতে দেয়া৷
যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আলেক্সান্দ্রা রেমপেল এই বিষয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন৷ তাতে দেখা গেছে প্রাকৃতিক বাতাস চলাচল ব্যবস্থা বা ভ্যান্টিলেশন এবং ছায়া পরিবেশ তৈরি করে ঘরে ভিতরের তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমানো যেতে পারে৷ এতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের উপর ৮০ শতাংশ পর্যন্ত চাপ কমানো সম্ভব৷
এক্ষেত্রে নতুন করে কোন ব্যবস্থাও উদ্ভাবনের প্রয়োজন নেই৷ বরং পুরনো কৌশল ব্যবহার করেই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা যেতে পারে৷
ভবনের নকশায় পরিবর্তন
ভবনের নকশায় কিছু কৌশল ব্যবহার করে ভিতরে ঠান্ডা থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে৷ যেমন, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে শতশত বছর ধরে বাতাস ধরে রাখার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়৷ এজন্য ভবনের উপরে খোলা জানালার টাওয়ার বসানো হয়৷ সেই টাওয়ার দিয়ে ভবনের ভিতরে ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করে গরম বাতাসকে বের করে দেয়৷
আরেকটি উপায় হলো কৃত্রিমভাবে ছায়া ফেলার ব্যবস্থা করা৷ এতে ভবনে সূর্যের আলোর প্রবেশ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ঘরের তাপমাত্রা সহনীয় রাখা যায়৷
দুবাইর ব্রিটিশ ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা বলছে এমন সব বিকল্প উপায় ব্যবহার করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বার্ষিক জ্বালানির ব্যবহার ২০ শতাংশের বেশি কমানো সম্ভব৷
সেই সঙ্গে ঘরের বাইরে পরিবেশকে ঠান্ডা রাখতে নগরে আরো গাছ লাগিয়ে ছায়া তৈরির পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা৷ সিঙ্গাপুরের এক গবেষণা বলছে এতে করে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা অন্তত পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমানো যেতে পারে৷