আজকের যুগে মাছ-মাংস-দুধ-ডিমও কারখানার পণ্যের মতো উৎপাদন করা হচ্ছে৷ আরও দুধের লোভে গরুকে বেশি খাওয়ানো হচ্ছে৷ জার্মানির একদল পশু চিকিৎসক গরুদের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দিয়েও তাদের ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
একটি গরুর খাবারে ‘পারফর্মান্যাট' নামের ‘অ্যাডিটিভ' যোগ করা হয়েঠে৷ এটা খেলে যে গরু বেশি দুধ দেয়, তার ক্ষমতা আরও বেড়ে যাবে৷ তাদের স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হবে৷ দুই পশু চিকিৎসক তথা শিল্পপতি এটি তৈরি করেছেন৷ জার্মানির উত্তরে এই গোয়ালে তাঁরা গরুর রক্ত ও মূত্র নিয়ে এই পদার্থের প্রভাব পরীক্ষা করছেন৷ তাঁদেরই একজন হানা সোফি ব্লাউন৷ তিনি বলেন, ‘‘যে গরু থেকে এখনো নমুনা নেওয়া হয়নি, আমরা সবসময়ে তাদের চিহ্নিত করি৷ তাদের গায়ে গোলাপি চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়৷ যাদের মূত্র পরীক্ষা হয়েছে, তাদের গায়ে সবুজ চিহ্ন আঁকা হয়৷''
গবেষণার জন্য দুই পশু চিকিৎসকদের নিজেদেরই গোয়ালঘরে যেতে হয়, যদিও সেটা কম বিপজ্জনক নয়৷ হানা বলেন, ‘‘আমি আর কোনো রক্তের নমুনা নিতে চাই না৷ তাই আমরা এটা থামিয়ে দিয়েছি৷ গরুর কাছে এগোলে সে গোয়ালের মধ্যে দাপিয়ে বেড়াবে, বাকি গরুদেরও মাথা খারাপ করে দেবে৷ তাদের তখন খাঁচায় বন্ধ করে রাখতে হবে৷''
ল্যাবের প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী খাবারের ‘অ্যাডিটিভ' গরুদের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারে৷ কোম্পানির দুই প্রতিষ্ঠাতার আশা, রক্ত ও মূত্র পরীক্ষায়ও একই ফল পাওয়া যাবে৷ ‘পারফর্মান্যাট' কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইয়ুলিয়া রোসেনডাল বলেন, ‘‘বেশি দুধ উৎপাদনের লক্ষ্যে গরুকে এমনিতেই বেশি খাদ্য খাওয়ানো হয়৷ আমরা এই ‘অ্যাডিটিভ' ব্যবহার করে খাদ্যের আরও ভালো ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাই৷''
অতিরিক্ত শক্তিবর্ধক খাদ্যের কারণে জার্মানিতে প্রায় অর্ধেক গরু অসুস্থ হয়ে পড়ে৷ ১০ থেকে ১৫ বছরের বদলে তাদের আয়ু কমে দাঁড়ায় গড়ে পাঁচ বছর৷ এই ‘অ্যাডিটিভ' কি বড় আকারে পশুপালনে সাহায্য করে? পশু চিকিৎসক হানা সোফি ব্লাউন মনে করেন, ‘‘না, একেবারেই না৷ ব্যাপারটা এভাবে দেখা চলে না৷ কারণ বড় আকারে পশুপালনের ক্ষেত্রে দিনে কত দুধ পাওয়া গেল, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ৷ দিনে চল্লিশের বদলে ৫০ লিটার দুধের প্রত্যাশা করা হয়৷ আমরা কিন্তু মোটেই সেটা করছি না৷''
মায়ের দুধের নানা গুণ
১লা আগস্ট ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃদুগ্ধ পান দিবস৷ এই দিবস পালন করা শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর থেকেই৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, মায়ের দুধ শিশুদের জন্য ম্যাজিক পানীয়৷ বিস্তারিত জানতে এই ছবিঘরটি দেখুন৷
শিশু পেটে আসার পর থেকেই মায়ের বুকে দুধ তৈরি হওয়া শুরু হয়৷ এর জন্য সাহায্য করে প্রোজেস্টেরন এবং প্রোলাকটিন নামের দুটি হরমোন৷ এই দুধ শিশুকে জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পান করানো যায়৷ তবে শিশু কতটা দুধ পাবে তা নির্ভর করে প্রথম স্তন্যপানের ওপর৷ অর্থাৎ শরীরের প্রোলাকটিন হরমনই মায়ের নার্ভ সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেভাবেই প্রয়োজনীয় দুগ্ধ উৎপাদন করে৷
ছবি: Svetlana Fedoseeva - Fotolia.com
শিশুদের জন্য সবচেয়ে ভালো
মায়ের দুধ শিশুদের শরীরে ম্যাজিকের মতো কাজ করে৷ শিশুর জন্মের প্রথম সপ্তাহে মায়ের দুধ পান করলে তা বাচ্চাকে অন্ত্র সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে এবং হজম করতে ও দুধ পান করার সময় পেটে বাতাস জমা থেকে রেহাই পেতেও সহায়তা করে৷ মায়ের দুধ শিশুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং অ্যালার্জির বিরুদ্ধে কাজ করে৷ তাছাড়া মায়ের দুধ পান করার কারণে শিশুর মুখের তালু এবং মাড়ি শক্ত হয়৷
ছবি: Fotolia/Marcito
মায়ের দুধে কী আছে?
মায়ের দুধে কী আছে তার হিসেব অনেক লম্বা৷ এতে রয়েছে মিনারেল, ভিটামিন, ফ্যাট, পানি ইত্যাদি৷ মায়ের দুধে বিশেষ এক রকম ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, যা শিশুর চোখের জ্যোতি বাড়াতেও সাহায্য করে থাকে৷
ছবি: Getty Images
শালদুধ
সদ্য প্রসূতির স্তন থেকে বের হওয়া প্রথম দুধ৷ হলদেটে রং-এর এই দুধ পরিমাণে কম হলেও এতে থাকে শ্বেতকণিকা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা৷ শালদুধ শিশুর জন্য অত্যন্ত উপকারি, যা শিশুর জীবনের প্রথম টিকা হিসাবেও কাজ করে৷ শালদুধে থাকে আমিষ ও প্রচুর ভিটামিন-এ৷ শালদুধ শিশুর পেট পরিষ্কার করে এবং শিশুর জন্ডিস হবার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়৷
ছবি: imago/Xinhua
মায়ের দুধই কি যথেষ্ট?
নবজাতকের মা এক লিটারের মতো দুধ উৎপাদন করে থাকেন৷ শিশুরা সাধারণত প্রতিবার ২০০ থেকে ২২৫ মিলিগ্রাম দুধ পান করে৷ তবে একজন শিশুর যতটা দুধ প্রয়োজন শিশু চাইলে ঠিক ততটুকুই পায়৷
ছবি: Royal Holloway, University of London
কত বয়স পর্যন্ত স্তন্যপান করা উচিত
মায়ের দুধ শিশুদের আদর্শ পুষ্টিকর খাবার৷ তবে এ দুধ কতদিন শিশু পান করবে – সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জার্মানির জাতীয় মাতৃদুগ্ধ পান কমিশনের পরামর্শ: কমপক্ষে ছয়মাস মায়ের দুধ পান করানো উচিত৷ তবে চার মাসের পর থেকে নবজাতকদের মায়ের দুধের পাশাপাশি অন্য খাবারও দেয়া যেতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দেশ ভেদে রয়েছে পার্থক্য
মায়ের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে একেক দেশে একেক রীতি প্রচলিত৷ যেমন মধ্য আফিকার ‘বফি’-তে সাধারণত সাড়ে চার বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করানো হয় বাচ্চাদের৷ অবাক করার মতো হলেও অনেক মা ১৬,০০০ লিটার দুধ উৎপাদন করে থাকেন৷ তবে সারা বিশ্বে গড়ে মায়েরা ৩০ মাস পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ পান করিয়ে থাকেন৷
ছবি: imago/blickwinkel
অন্য নারীর নয়, মায়ের দুধ চাই
বহুদিন আগে কিন্তু শিশুদের অন্য নারীর বুকের দুধ পান করানো হতো৷ পরবর্তীতে ১৮ শতক থেকে একটি প্রচারাভিযান চালানো হয়, যেখানে বলা হয় যে, মা-রাই যেন শিশুকে নিজের বুকের দুধ পান করান৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রকাশ্যে দুধ পান করানো
মা তাঁর শিশুকে প্রকাশ্যে দুধ পান করাচ্ছেন – এটা কিছু দেশের মানুষের কাছে তেমন পছন্দ নয়৷ তাই সেসব দেশে মা শিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছে এমন ছবি কেউ ফেসবুকে দিলে সেগুলো ফেসবুক থেকে মুছে ফেলা হয়৷
ছবি: Getty Images
শুধু শিশু নয়, মায়েরও উপকার হয়
যে মা তাঁর শিশুকে বুকের দুধ পান করান সেই মায়ের জরায়ু, স্তন ও ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের ঝুঁকি কমে যায়৷ তাছাড়া দুধ খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে সন্তান ও মায়ের মধ্যে তৈরি হয় এক নিবিড় সম্পর্ক৷
‘পারফর্মান্যাট' কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতাদের তৃতীয় সদস্য কাটারিনা হিলে ল্যাবে এই ‘অ্যাডিটিভ'-এর আরও একটি সুবিধা প্রমাণ করতে চান৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ‘অ্যাডিটিভ' দিয়ে মূত্রে অ্যামোনিয়ার মাত্রা কমানো যায়৷ এই প্রতিবেদনে তার প্রমাণ রয়েছে৷ শুধু গরু নয়, পরিবেশের উপরও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে৷ মাঠের উপর গোবর ফেলে দিলে তার মধ্যে থাকা অ্যামোনিয়াও ছড়িয়ে পড়ে জলবায়ুর ক্ষতি করে৷''
‘পারফর্মান্যাট'-এর মার্কেটিং-এর জন্য এই তিন গবেষক একটি কোম্পানি খুলেছেন৷ জার্মান অর্থনীতি মন্ত্রণালয় সহ একাধিক সূত্র থেকে তাঁরা ৪ লাখ ৪০ হাজার ইউরো আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন৷
এর ফলে কি দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে এমন হতে পারে যে, প্রচলিত দুধ শিল্পকেই আরও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে? ইয়ুলিয়া রোসেনডাল বলেন, ‘‘আমার বিশ্বাস, অরগ্যানিক খামারের কোনো ক্ষতি হবে না৷ মানুষের মধ্যে অরগ্যানিক পণ্যের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে বলে আমি মনে করি৷ আমাদের লক্ষ্য হলো, পশুর স্বাস্থ্যের ক্ষতি না করেও বড় আকারে পশুজাত পণ্যের উৎপাদন সম্ভব করা৷''
বড় আকারের খামারে প্রতিটি গরু বছরে ১০,০০০ লিটারেরও বেশি দুধ দেয়৷ একশো বছর আগের তুলনায় এই পরিমাণ প্রায় চার গুণ বেশি৷ ‘পারফর্মান্যাট' পশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারে, পশুপালকদের আর্থিক সুবিধা দিতে পারে৷ আগামী বছরের শুরুতেই এই ‘অ্যাডিটিভ' প্রথম খামারগুলিতে বিক্রি করার কথা৷