ক্যাথলিক অধ্যুষিত আর্জেন্টিনার কয়েক লাখ মানুষ সব ধরনের গর্ভপাত বৈধ ঘোষণার জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন৷ কিন্তু দেশটির সিনেটে ভোটাভুটিতে প্রস্তাবটি পাস হয়নি৷
বিজ্ঞাপন
আর্জেন্টিনার সংসদের নিম্ন কক্ষে কয়েক সপ্তাহ আগে সব ধরনের গর্ভপাতকে বৈধ ঘোষণার প্রস্তাব অল্প ব্যবধানে পাস হলেও সিনেটে তা ভোটাভুটিতে জিততে পারেনি৷ প্রস্তাবের পক্ষে সেখানে ভোট দেন ৩১ সিনেটর, বিপক্ষে ৩৮৷
ফলে ক্যাথলিক চার্চের বিরোধিতা সত্ত্বেও যে লাখ লাখ মানুষ গর্ভপাত বৈধের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন, তারা কার্যত হতাশ হলেন৷ দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী, প্রতিবছর দেশটিতে পাঁচ লাখের মতো অবৈধ গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে৷ গোপনে এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেসব গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে অনেক নারী মারাও যান৷
তবে গর্ভপাতবিরোধীরা সিনেটের ভোটাভুটির ফলাফল কংগ্রেসের সামনে দাঁড়িয়ে আতশবাজী আর আনন্দউল্লাসের মাধ্যমে স্বাগত জানিয়েছেন৷ কাছেই আরেক জায়গায় অনেককে কাঁদতে দেখা গেছে, যারা গর্ভপাত বৈধের পক্ষে আন্দোলন করেছেন৷ এমনকি, সিনেটের ভোটাভুটির পর কোথাও কোথায় দাঙ্গা পুলিশের সঙ্গে গর্ভপাতের পক্ষের অ্যাক্টিভিস্টদের সংঘর্ষে জড়াতে দেখা গেছে৷
গর্ভপাত৷ অনাকাঙ্খিত সন্তান না নিতে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই চলছে ভ্রুণ হত্যা৷ আর্জেন্টিনায় গর্ভপাত নিষিদ্ধ৷ তারপরও গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে অনেকে প্রাণ হারাচ্ছেন, অনেকে আর কোনোদিন মা হতে পারছেন না৷
ছবি: Lisa Franz, Guadalupe Gómez Verdi, Léa Meurice
স্বাধীনতা...
‘শরীরটা আমার নিজের’ – আর্জেন্টিনার মেয়েরা এখনো স্বাধীনভাবে এ কথা ভাবতে পারেন না৷ গর্ভপাত সেখানে নিষিদ্ধ৷ তা সত্ত্বেও গর্ভপাত চলছে৷ ২৭ বছর বয়সি ক্যামিলাও গর্ভপাত ঘটিয়েছেন, তারপর নিজের ঘাড়ে এঁকেছেন উল্কি, সেখানে লেখা, ‘স্বাধীনতা’৷ তাঁর এ ছবি ‘১১ সপ্তাহ, ২৩ ঘণ্টা, ৫৯ মিনিট – আর্জেন্টিনায় অবৈধ গর্ভপাত’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে দেখানো হচ্ছে৷
ছবি: Goméz Verdi, Franz, Meurice
নববর্ষের প্রাক্কালে...
এ ছবিতে মারা নামের একটি মেয়ের জীবনের গল্প বলার চেষ্টা করা হয়েছে৷ ২১ বছর বয়সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে মারাকে তাঁর বয়ফ্রেন্ডের পরিবার, ‘গর্ভপাত ঘটালে আমরা অভিযোগ দায়ের করবো’ – বলে শাসিয়েছিল৷ হুমকি দিলেও ছেলেবন্ধুর সটকে পড়া কিন্তু তাঁরা ঠেকাননি৷ সঙ্গী চলে যাওয়ার ১২ সপ্তাহ পর বাধ্য হয়ে মারা ব্যাপারটি খুলে বলেন মাকে৷ তারপর ২০০২ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবৈধভাবে গর্ভপাত ঘটিয়ে আবার নতুন জীবন শুরু করেন মারা৷
ছবি: Lisa Franz, Guadalupe Gómez Verdi, Léa Meurice
পুরুষেরও ভোগান্তি
গর্ভপাত অনেক সময় পুরুষদেরও বিপদে ফেলে৷ ফোটোগ্রাফার লিসা ফ্রানৎস, গুয়াদালুপে গোমেজ এবং লেয়া মরিসের কাজগুলো তেমন গল্পগুলোই তুলে ধরছে৷ পেদ্রো নামের এই তরুণ গর্ভপাতের ব্যাপারে তাঁর গার্লফ্রেন্ডকে শুধু সমর্থনই করেননি, তাঁকে ক্লিনিকেও নিয়ে গিয়েছিলেন৷ কিন্তু গর্ভপাত ঘটানোর পর বিষয়টি নিয়ে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে কথাও বলতে পারেননি৷ সবার আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল, পেদ্রো যেন খুব বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছেন!
ছবি: Lisa Franz, Guadalupe Gómez Verdi, Léa Meurice
বাড়িতেই গর্ভপাত
অন্তঃসত্ত্বার পেটে ঘুষি মেরে ভ্রুণ হত্যা, তারপর কাপড়ের হ্যাঙার আর কাপড় সেলাই করার সুঁচ ব্যবহার করে ‘জঞ্জাল’ সাফ করে দেওায়া – আর্জেন্টিনার অনেক অঞ্চলে এভাবেই ঘরে ঘরে হয় গর্ভপাত৷ কোনো ডাক্তার বা নার্স নয়, ঘরের মেয়েরাই এভাবে কাজ সারেন৷ ফলে অকালে ঝরে যায় অনেক নারীর প্রাণ৷
ছবি: Lisa Franz, Guadalupe Gómez Verdi, Léa Meurice
বছরে অন্তত একশ জন...
গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে আর্জেন্টিনায় প্রতিবছর ৬০ হাজার থেকে ৮০ হাজারের মতো নারী জটিল সমস্যায় পড়ে হাসপাতালে ভর্তি হন৷ তাঁদের মধ্যে কমপক্ষে একশ জন সন্তানের আগমন রুখতে গিয়ে নিজেদেরই মৃত্যু ডেকে আনেন৷ আর্জেন্টিনার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মনে করে, বিশেষত দরিদ্র অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে অবৈজ্ঞানিক উপায়ে গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে নিজেদের জীবনও বিপন্ন করছেন মেয়েরা৷
ছবি: Lisa Franz, Guadalupe Gómez Verdi, Léa Meurice
১৫০০ ইউরোয় মুশকিল আসান
গর্ভপাত আইনত দণ্ডনীয় হলেও আর্জেন্টিনায় টাকা দিলে এ কাজ সহজেই হয়৷ টাকাটা অবশ্য বেশিই লাগে, কোনো কোনো ডাক্তার এ জন্য ১০ হাজার পেসো বা ১৫০০ ইউরোও নিয়ে থাকেন গর্ভপাত ঘটাতে ইচ্ছুক নারীদের কাছ থেকে৷ জার্মান কারদোসো একজন সার্জন৷ তবে আর্জেন্টাইন ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয়েও তিনি লড়ছেন গর্ভপাতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার দাবির পক্ষে৷
ছবি: Lisa Franz, Guadalupe Gómez Verdi, Léa Meurice
নারীর পাশে নারী
‘ডিম্বাশয় থেকে তোমার গোলাপরেণু সরিয়ে নাও’ – এভাবেই গর্ভপাতকে আইনসিদ্ধ করানোর আন্দোলনের পক্ষে সোচ্চার আর্জেন্টিনার নারী অধিকার সংগঠন ‘লা রেভুয়েলতা’৷ ক্যাথলিক খ্রিষ্টান প্রধান দেশ আর্জেন্টিনায় বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন এ দাবির পক্ষে৷ ‘লা রেভুয়েলতা’ শুধু দাবি আদায়ে সোচ্চার নয়, গর্ভপাতে ইচ্ছুক নারীদের উপযুক্ত পরামর্শ দিয়ে গর্ভপাতে সহায়তাও করে তারা৷
ছবি: Lisa Franz, Guadalupe Gómez Verdi, Léa Meurice
দিকনির্দেশনার অভাব
এলুনের বয়স এখন ২১৷ ‘লা রেভুয়েলতা’-র সহায়তায় তিনি গর্ভপাত ঘটিয়েছেন৷ ‘কখন মা হবো, এ সিদ্ধান্ত আমিই নেবো’ – এলুনে এমন কথা বলেছেন ঠিকই, তবে এতদিনে তিনি জেনে গেছেন যে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে গর্ভপাত ঘটানোও তাঁর দেশে খুব একটা নিরাপদ নয়৷ ডাক্তাররা ওষুধ কখন, কিভাবে খেতে হবে তা না বলেই বিক্রি করে দেন৷ ফলে অজ্ঞতার ঝুঁকি থেকেই যায়, আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সহায়তা নিতে চেয়েও মৃত্যু এড়াতে পারেন না অনেক নারী৷
ছবি: Lisa Franz, Guadalupe Gómez Verdi, Léa Meurice
জেলখানায় গর্ভপাত
সোনিয়া সানচেজ ছিলেন পতিতা৷ অবৈধভাবে পতিতাবৃত্তির অভিযোগে জেল খেটেছেন অনেকবার৷ কারাবন্দি অবস্থায় গর্ভপাতও ঘটিয়েছেন৷ এক খদ্দের তাঁর মা হতে চাওয়া, না চাওয়ার স্বাধীনতাকেও কিনে নিয়েছিলেন৷ পতিতালয়ের মালিককে বাড়তি টাকা দেয়ায় কনডম ছাড়াই তিনি মিলিত হতেন৷ ফলশ্রুতিতে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন সোনিয়া৷ এই তরুণী এখন নেমেছেন গর্ভপাতের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে৷ ইতিমধ্যে সাফল্যের দেখাও পেয়েছেন৷
ছবি: Lisa Franz, Guadalupe Gómez Verdi, Léa Meurice
আর নীরবতা নয়...
ছবিতে দেখা যাচ্ছে মনিকা নামের এক নারীর শরীরের অনাবৃত একটি অংশ৷ লিসা ফ্রানৎস, গুয়াদালুপে গোমেজ এবং লেয়া মরিসের তোলা ছবি নিয়ে ‘১১ সপ্তাহ, ২৩ ঘণ্টা, ৫৯ মিনিট – আর্জেন্টিনায় অবৈধ গর্ভপাত’ শীর্ষক যে প্রদর্শনী চলছে, সেখানে এ ছবিটিও দেখানো হচ্ছে৷ নিজের এমন একটা ছবি দেখানোর অনুমতি দেয়া মনিকা গর্ভপাতের পক্ষে নিজ বক্তব্য তুলতে গিয়ে শুধু বলেছেন, ‘এটা আমার দেহ’৷
ছবি: Lisa Franz, Guadalupe Gómez Verdi, Léa Meurice
10 ছবি1 | 10
প্রসঙ্গত, গর্ভপাত ইস্যুতে গত বেশ কিছুদিন ধরেই আর্জেন্টিনায় নানা রকম কর্মসূচি দেখা গেছে৷ পোপ ফ্রান্সিসের দেশটির ক্যাথলিক চার্চ গর্ভপাতের ঘোর বিরোধী৷ এমনকি চার্চের তরফ থেকে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের রাজপথে নেমে গর্ভপাত বিরোধী অবস্থান জানাতেও আহ্বান জানানো হয়েছে৷
অবশ্য সিনেটে ভোটাভুটিতে প্রস্তাবটি পাস না হলেও গর্ভপাতের পক্ষের আন্দোলনকারীরা হাল ছেড়ে দেবে না বলে জানিয়েছেন সিনেটর মিগেল পিচেতো৷ গর্ভপাতের পক্ষে ভোট দেয়া এই পুরুষ সিনেটর বলেন, ‘‘ভবিষ্যত গর্ভপাতের বিরোধীদের জন্য নয়৷ সেদিন বেশি দূরে নয় যখন নারী তার জন্য দরকারি সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারবে, আমরা শীঘ্রই এই বিতর্কে জয়ী হবো৷''
উল্লেখ্য, আর্জেন্টিনার বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলে কিংবা গর্ভধারণের কারণে গর্ভবতীর জীবনশঙ্কা দেখা দিলে গর্ভপাত করা বৈধ৷ এর বাইরে অন্য কোনো কারণে গর্ভপাত করা অবৈধ৷