ডেয়ার স্পিগেলের পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক ক্লাস রেলোটিউস মিথ্যা গল্প লেখার অভিযোগ স্বীকার করে পদত্যাগ করেছেন৷ জার্মানির স্বনামধন্য পত্রিকাটি বলেছে, ৭০ বছরের ইতিহাসে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েনি তারা৷
বিজ্ঞাপন
বুধবার সাপ্তাহিক পত্রিকা ডেয়ার স্পিগেল খবর প্রকাশ করে যে, তাদের একজন তারকা সাংবাদিক বছরের পর বছর ধরে ‘বিরাট সব গল্প' সাজিয়ে তা প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করতেন৷
এর প্রায় তিন সপ্তাহ আগে ৩৩ বছর বয়সি ক্লাস রিলোটিউস মর্যাদাপূর্ণ জার্মান রিপোর্টার্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৮ জেতেন৷ এক সিরিয়ান বালকের গল্প লিখে তিনি সেরা প্রতিবেদনের পুরস্কার পান৷
ঠিক একই সময় গল্প সাজানোর অভিযোগ আসার পর অভ্যন্তরীণভাবে তদন্ত করে স্পিগেল৷ তখন ঐ সাংবাদিক প্রতারণার অভিযোগ স্বীকার করেন এবং গত সপ্তাহে পদত্যাগ করেন৷
গেল কয়েক বছরে স্পিগেলের ঐ সাংবাদিক ৬০টির মতো প্রতিবেদন লেখেন৷ তিনি স্বীকার করেছেন যে, একবার দু'বার নয়, তিনি বেশ কয়েকবার নিজে নিজে গল্প বানিয়েছেন অথবা তথ্য বিকৃতির পথ বেছে নিয়েছেন৷
ডেয়ার স্পিগেল জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তের একটি প্রতিবেদন নিয়ে মূলত সন্দেহের শুরু৷ এ প্রতিবেদনটি হুয়ান মোরেনো নামের আরেক সাংবাদিকের সঙ্গে যৌথভাবে করেন ক্লাস৷ পরে ঐ সাংবাদিক ক্লাসের বিরুদ্ধে অসততার অভিযোগ আনেন৷
ক্লাস অবশ্য নিজের পাপের কথা স্বীকার করে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন৷ বলেছেন, ‘‘আসলে বড় কিছুর জন্য নয়, বরং ব্যর্থতার ভয় থেকে করেছি৷'' এই ভয় থেকে তিনি নিজে থেকে মন্তব্য বানিয়ে ছাপিয়ে দিয়েছেন৷ কাজের স্বীকৃতি পাবার সঙ্গে সঙ্গে আরো ‘ভালো' কিছু করার চাপ তৈরি হয় বলে জানান তিনি৷
স্পিগেল বলেছে, মিথ্যা মন্তব্য, বানানো স্থান, কাল, পাত্র ও ঘটনা দিয়ে ক্লাস যে প্রতিবেদনগুলো ছাপিয়ে গেছেন দিনের পর দিন, তা আগে ধরতে পারেনি তারা৷ এটাকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি৷ গত ৭০ বছরে কখনো এতটা ‘ছোট' হতে হয়নি বলে বিবৃতি দিয়েছে তারা৷
শুধু ডেয়ার স্পিগেলই নয়, ফ্রিল্যান্সার হিসেবে দেশি-বিদেশি অনেক নামি-দামি পত্রিকায় লিখেছেন ক্লাস৷ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ঘটনার ওপরও প্রতিবেদন লেখেন তিনি৷ ২০১৪ সালে সিএনএন জার্নালিস্ট অফ দ্য ইয়ার পুরস্কার পান তিনি৷
ডেয়ার স্পিগেল হামবুর্গভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক নিউজ ম্যাগাজিন৷ এর সার্কুলেশন প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার কপি৷ জার্মানির অন্যতম শীর্ষ পত্রিকা এটি৷
গণমাধ্যমের ভ্রান্তি ও উপস্থাপনের নীতিমালা
গণমাধ্যমে কোন খবর কীভাবে প্রকাশ করা হবে, কী ছবি বা ভিডিও যাবে সেই প্রতিবেদনের সাথে – এ নিয়ে পশ্চিমাবিশ্ব সতর্ক৷ জটিলতা রয়েছে বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশে৷ দেখা যাক গণমাধ্যমে সংবাদ উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু ভুল এবং অসঙ্গতি৷
ছবি: picture alliance/ANP/R. Koole
মানবিকতা না পেশাদারিত্ব?
সুদানে মৃতপ্রায় একটি শিশু মাঠে পড়ে রয়েছে আর তার ঠিক কয়েক হাত দূরেই একটি শকুন তাকিয়ে রয়েছে –১৯৯৩ সালে বিশ্ব তোলপাড় করা এই ছবিটি তুলেছিলেন বিখ্যাত ফোটো জার্নালিস্ট কেভিন কার্টার৷ পুলিত্জার পুরস্কারও পেয়েছিল ছবিটি৷ কিন্তু প্রশ্ন উঠেছিল শিশুটির মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা না করে তিনি কি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারতেন না? আর এ কারণেই হয়ত আত্মহত্যা করেছিলেন কেভিন৷
ছবি: DW/C. Wanjoyi
ধর্ষিতার ছবি ও পরিচয় প্রকাশ নয়
সংবাদ নীতিমালা বলে, ধর্ষিতা বা যৌন নিপীড়নের শিকারের নাম প্রকাশ করা যাবে না৷ কিন্তু অনেকক্ষেত্রে গণমাধ্যম ধর্ষিতার এলাকার নাম বা তাঁর কোনো আত্মীয়ের পরিচয় প্রকাশ করে৷ এ যুগেও সাংবাদিকতার এমন ভুল সত্যিই মর্মান্তিক৷
ছবি: Fotolia/DW
অপরাধীর অপরাধ প্রমাণের আগে ছবি প্রকাশ নয়
সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুযায়ী, অপরাধ করেছে সন্দেহে পুলিশ ধরার পরই তার ছবি সাংবাদিকরা প্রকাশ করতে পারেন না, কেননা, অপরাধ তো তখনো প্রমাণিত হয়নি৷ কিন্তু বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশে অপরাধীর অপরাধ প্রমাণের আগেই ছবি প্রকাশ করার ঘটনা ঘটে৷
ছবি: picture alliance/dpa/P. Pleul
উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দেশের একটি প্রধান দৈনিক হিন্দু নারীদের ছবি প্রকাশ করে, যারা ভোট কেন্দ্রে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন৷ ক্যাপশনে যে স্থানের উল্লেখ ছিল, ছবিটি সেই স্থানের ছিল না৷ ফটোশপের সহায়তায় কিছু পরিবর্তনও আনা হয়েছিল ছবিটিতে৷ ছবিটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছিল তখন৷
ছবি: DW/S. Kumar Day
একতরফা বক্তব্য নয়
বড় বড় ইস্যুতে ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো এক তরফা বক্তব্য প্রচার করে৷ কিন্তু সাংবাদিকতার প্রথম নীতিই হলো নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন৷ অর্থাৎ কোনো ঘটনায় উভয় পক্ষের বক্তব্য থাকতে হবে৷ না হলে জন্ম নেবে বিতর্কের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উদ্ধার কাজে সমস্যা বা আহতদের প্রশ্ন
দুর্ঘটনা স্থলে অতিরিক্ত সাংবাদিকের উপস্থিতি কাজে বাধার সৃষ্টি করে৷ একইভাবে দুর্ঘটনাগ্রস্ত মানুষ বা নিহতদের স্বজনদের ঘটনা ঘটার মুহূর্তে প্রশ্ন করাটা একেবারেই অমানবিক৷ এতে নৈতিকতার চেয়েও মানবিকতার প্রশ্ন এসে যায়৷ বিশ্বের অনেক দেশের সাংবাদিকরা এমন পরিস্থিতিতে ঐ আহত বা নিহতদের স্বজনদের স্বার্থ রক্ষা করে কাজ করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
ভুল ছবি, ভুল সংবাদ পরিবেশন
যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশের দুটি দৈনিক পত্রিকা কাবা শরীফের ছবি ব্যবহার করে মিথ্যা সংবাদ ছাপাতেও পিছপা হয়নি৷ ‘আলেমদের নির্যাতনের প্রতিবাদে কাবার ইমামদের মানববন্ধন’ শিরোনামে তারা একটি সংবাদ পরিবেশন করে, যেটা কিনা ১৮ অক্টোবর ২০১২ তে প্রকাশিত কাবার গিলাফ পরানোর সময় তোলা৷
ছবি: Stringer/AFP/Getty Images
জঙ্গিবাদকে উসকে দেয়া
গত দুই বছরে তথাকথিত ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট আইএস বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে জবাই করে হত্যা করেছে এবং সেই হত্যাদৃশ্যের ভিডিও প্রচার করেছে৷ অনেক সংবাদ মাধ্যমও নিজেদের টিআরপি বাড়াতে সেই ভিডিও প্রচার করেছে৷ কিন্তু একদিকে এই ভয়াবহ দৃশ্য মানুষের মনে চাপ সৃষ্টি করে, অন্যদিকে জঙ্গিবাদকে উসকে দেয় না কি!
ছবি: SITE Intel Group/Handout via Reuters
শিশুদের ছবি প্রকাশ না করা
কোনো শিশুর বাবা-মাকে হত্যা করা হয়েছে৷ মানবিক আবেদন সৃষ্টি করতে অনেক সংবাদমাধ্যম তখন শিশুটিকে নিয়ে নানা প্রতিবেদন তৈরি করে৷ এতে যে শিশুটির উপর মানসিক চাপ তৈরি হয়, এটা সাংবাদিকদের বোঝা উচিত এবং এটা নীতিবিরুদ্ধ৷
ছবি: DW
শিশু অপরাধী এবং শিশু নির্যাতনের শিকার
অনেক দেশেই শিশু অপরাধীদের ছবি প্রকাশ করা হয় না৷ পাশাপাশি কোনো শিশুর ছবি তুলতে হলে অভিভাবকদের অনুমতি লাগে৷ এছাড়া ক্ষেত্র বিশেষে শিশুদের নিরাপত্তার স্বার্থেও অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া তাদের ছবি প্রকাশ করা উচিত নয়৷ কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই নীতি মেনে চলা হয় না৷ বাংলাদেশে নির্যাতিত শিশুর ছবিও হরহামেশাই প্রকাশ করা হয়৷