গাছেরা কী ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে? তাদের শিকড় আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিটি গাছের আকৃতি যে আলাদা৷ এক জার্মান পদার্থবিদ গাছেদের খাড়া থাকার রহস্য ফাঁস করে দিয়েছেন: টেনসাইল ট্রায়াঙ্গল, মানে প্রসারণসাধ্য ত্রিভুজ৷
বিজ্ঞাপন
কার্লসরুয়ে ইনস্টিটটিউট অফ টেকনোলজি-র অধ্যাপক ক্লাউস মাটহেক-এর সম্পদ কিছু কাঠের টুকরো: প্রতিটি টুকরোর একটা ইতিহাস আছে৷ কোনো কোনো গাছের শিকড় কিংবা চাকতির আলাদা নাম পর্যন্ত দিয়েছেন প্রফেসর মাটহেক৷ গত তিন দশক ধরে মাটহেক যে বিষয়টি নিয়ে গবেষণায় লিপ্ত রয়েছেন, সেটি হল: প্রত্যেকটি গাছের আকৃতি আলাদা হয় কেন? গাছেরা তাদের নিজেদের ওজন বহন করে কী ভাবে, ঝড়ে উপড়ে পড়ে না কেন?
দৃশ্যত গাছেরা বোধ করতে পারে, তাদের কী ভাবে, কোন দিকে বাড়া উচিত৷ মাটহেক-এর তত্ত্ব হল: ‘‘নির্দিষ্ট জায়গায় হাই স্ট্রেস বা চাপ গাছ নিজেই তার মেকানো-সেন্সর দিয়ে পরিমাপ করে৷ তাই গাছটা ঠিক সেখানে বছর গোনার চক্রাকৃতি আঁকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না চাপ আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসে৷''
মাটির ওপর গাছের কাণ্ড দেখে মাটহেক আরো একটি আশ্চর্য বিষয় আবিষ্কার করেন: গাছেরা তাদের গুঁড়ির এই অংশটিকে কী ভাবে গড়ে তোলে, তা জ্যামিতি দিয়ে সহজেই বোঝা এবং বোঝানো সম্ভব৷ তিনি বলেন, ‘‘ধরুন এটা হল মাটির ওপরদিক৷ এর ওপর যখন একটা গাছ দাঁড়িয়ে থাকে, তখন দু'টোর মধ্যে একটা তীক্ষ্ণ কোণা থাকে, যেন গাঁজ কাটা রয়েছে৷ প্রযুক্তিবিদরা এ যাবৎ একটা বৃত্তের মতো দাগ কেটে সেই গাঁজটা ভরিয়ে দিতেন৷ তা সত্ত্বেও গাঁজের চাপ কিছুটা থেকেই যায়৷ তখন গাছ একটা কাজ করে: গাছ এই চক্রাকৃতির উপর আরো একটা প্রতিসম ত্রিভুজ বসায়৷ তার উপরেও আবার অনুরূপভাবে অনুবন্ধন করা হয়৷ এ ভাবে একবার, দু'বার, বারংবার৷ তারপর আমরা সেগুলোকে মিলিয়ে দিয়ে একটা টেনসাইল ট্রায়াঙ্গল বা প্রসারণসাধ্য ত্রিভুজ পাই – যা কিনা প্রাকৃতিক জগতের একটা সার্বজনীন আকৃতি৷''
জার্মানির বাগানে বাংলাদেশের গাছ
১৯৮০ সালে ‘ফ্রিডেন্সভাল্ড’ বা শান্তির বাগানটি তৈরি করা হয়েছে, যেখানে বিশ্বের ১৪২টি দেশের গাছ লাগানো হয়েছে বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে৷ এখানে এতগুলো দেশের গাছ পাশাপাশি থাকবে, বেড়ে উঠবে, সহাবস্থান করবে৷
ছবি: imago/Photoshot/Balance
লাল সবুজ পতাকা
জার্মানির কোলন শহরের অভিজাত এলাকা রোডেনকির্শেন৷ সেই এলাকারই এক কোণে তৈরি করা হয়েছে ২৬ হেক্টর জমি জুড়ে সুন্দর একটি বাগান৷ এই বাগানে আছে বাংলাদেশের একটি গাছ৷
ছবি: Mohammad Zahidul Haque
শান্তির বাগানে সহাবস্থান
১৯৮০ সালে ‘ফ্রিডেন্সভাল্ড’ বা শান্তির বাগানটি তৈরি করা হয়েছে, যেখানে বিশ্বের ১৪২টি দেশের গাছ লাগানো হয়েছে বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে৷ এখানে এতগুলো দেশের গাছ পাশাপাশি থাকবে, বেড়ে উঠবে, সহাবস্থান করবে৷ গাছ লাগানোর মধ্য দিয়ে জার্মানির সাথে এই দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্ক গাঢ় হবে – এমন ভাবনা থেকেই কিন্তু এই উদ্যোগ৷
ছবি: DW/N. Sattar
সারা বছরই মানুষের ভিড়
যে কোনো ঋতুতেই এখানে প্রচুর লোকজন আসেন বেড়াতে, হাঁটতে বা জগিং করতে৷ গাছগুলো এমনভাবে সাড়ি বেঁধে লাগানো যেন ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়৷ বাংলাদেশ, ভারত, অ্যামেরিকা, আফ্রিকা যে কোনো দেশের গাছেই সে দেশের পতাকা লাগানো আছে৷ কোনো কোনো দেশের আবার একটি নয়, অনেকগুলো গাছ রয়েছে শান্তির প্রতীক হিসেবে৷
ছবি: DW/N. Sattar
বসন্ত
বসন্ত যে এসে গেছে, সেটা বাগানের গাছটিই বলে দিচ্ছে৷ ভাবতে এখন হয়ত অবাকই লাগবে যে গাছটি শীতকালে একেবারেই ন্যাড়া ছিল৷ আসলে জার্মানিতে কখন কোন ঋতু চলে তা গাছের দিকে তাকালেই বোঝা যায়৷ যদিও এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তা অনেকটাই বদলে গেছে৷
ছবি: DW/N. Sattar
মুক্ত হাওয়া
গ্রীষ্মের মিষ্টি সকালে এমনি করেই শান্তির বাগানে এসে মুক্ত হাওয়া সেবন করে নেয় মেয়েটি৷ এতে তার মনে হয়, সে যেন সারাদিন শান্তিতে থাকতে পারে৷ আজকের এই যান্ত্রিক জীবনে এটা খুবই প্রয়োজন, তাই নয় কী?
ছবি: Fotolia/Fotowerk
ভালোবাসার ফুল
শান্তির বাগানে এসে সুন্দর একটি জায়গা খুঁজে নিয়ে প্রেমিকাকে ফুল উপহার দিচ্ছেন, যেন তাকে সারা জীবন শান্তিতে রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে৷
ছবি: Fotolia/TeresaYehPhotography
সাদা বালির লেক
শান্তির বাগানে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে সবই পরিবর্তন হয়৷ তবে এই সাদা বালির অংশটুকুর কোনো পরিবর্তন হয় না, সব সময় সাদাই থাকে৷ এখানে বাচ্চারা খেলতে খুবই ভালোবাসে৷ বছরের যে কোনো সময়ই তাই দেখা যায় তাদের৷
ছবি: DW/N. Sattar
মিনি পাহাড়
বালির লেকের একটু ওপরেই খানিকটা জায়গা পাহাড়ের মতো উঁচু-নীচু৷ যেখানে শীতকালে বাচ্চারা বরফ দিয়ে খেলতে ভালোবাসে৷ মাঝে মধ্যে বড়রাও কিন্তু সঙ্গ দেন এই অপার আনন্দে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
একটুখানি বিশ্রাম
বাগানের শুরুতেই ১৪২টি দেশের গাছ লাগানো হয়েছে আর ভেতরে দিকে করা হয়েছে একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন৷ পুরো গার্ডেন হেঁটে ক্লান্ত? তাহলে তো চাই একটুখানি বিশ্রাম! তবে হঠাৎ যদি বৃষ্টি আসে তাহলে ছাতাটি কিন্তু বড় কাজে দেয়৷
ছবি: DW/N. Sattar
রডোডেনড্রন
শান্তির বাগানের একটা বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে নানা রং-এর রডোডেনড্রন ফুলের গাছ৷ এ বছর অবশ্য এখনো সব গাছে ফুল ফোটেনি৷
ছবি: DW/N. Sattar
বেড়ানোর মধ্যেই কাজ
অনেকক্ষণ খোঁজার পর ছাত্রীরা পেয়ে গেছে শিক্ষকের নাম বলে দেওয়া গাছটি, যে গাছ সম্পর্কে গত সপ্তাহেই ক্লাসে আলোচনা করা হয়েছে৷ স্বাভাবিকভাবেই, এখন তারা মহা খুশি৷
ছবি: DW / Gaby Reucher
অসুস্থ গাছ
গাছটা কি সত্যি অসুস্থ? পরীক্ষা করে দেখছে৷ এভাবেই কিন্তু নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখা হয় বিশাল বাগানের প্রতিটি গাছ৷
ছবি: picture alliance/empics
পুরো পরিবার
সপ্তাহান্তেই কেবল পুরো পরিবারের একসাথে হওয়ার সুযোগ৷ তাই সবাই মিলে শান্তির বাগানে এসেছে৷ উদ্দেশ্য ছোটবেলা থেকেই যেন বাচ্চাদের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক গড়ে উঠে৷ এই বাগানে এই একই লক্ষ্য নিয়ে ছোট্ট একটি কিন্ডারগার্টেনও করা হয়েছে৷
ছবি: Bilderbox
গাছ কাটা
গাছের যত্নের কোনো ত্রুটি নেই৷ অসুস্থ গাছকে সময় মতো কেটে ফেলা হয়৷ তবে একটা গাছ কাটা মানেই কিন্তু আর একটা গাছ লাগানো৷ বলা যায় একেবারে সঙ্গে সঙ্গেই!
ছবি: imago/Photoshot/Balance
14 ছবি1 | 14
একটি সার্বজনীন ফর্মুলা
সে আকৃতি সর্বত্র দেখতে পাওয়া যাবে – গাছে কিংবা হাড়ে... এমনকি প্রাণীবিহীন জগতেও এই প্রসারণসাধ্য ত্রিভুজ পাওয়া যাবে৷ রিও ডি জানেইরো-র সুগার লোফ মাউন্টেনের আকারও তাই৷ গবেষকরা যা দেখে চমকে যান, তা হল: একটা গলার চেন-এর আকৃতিও ঐরকম; বিশেষ করে ওপরের দিক ধরে টানলে৷ টেনসাইল ট্রায়াঙ্গল সর্বত্র পাওয়া যাবে৷
গাছের অনুকরণে সবচেয়ে অনুকূল আকৃতি সৃষ্টি করতে গিয়ে আগে কম্পিউটারে অনেক মাপজোক করতে হতো৷ ক্লাউস মাটহেক টেনসাইল ট্রায়াঙ্গল-এর নীতিটিকে একটি সার্বজনীন ফর্মুলায় পরিণত করেছেন৷ এর ফলে কম্পিউটারে লম্বা আঁকজোক ছাড়াই বিভিন্ন যন্ত্রাংশকে তাদের সবচেয়ে অনুকূল আকৃতিতে আনা যায়৷ ফলে অর্থ ও সময় বাঁচে৷ শল্যচিকিৎসায় ব্যবহারযোগ্য, মানুষের শরীরে বসানো যায়, এমন সব স্ক্রু, গাড়ি ও মেশিনের বিভিন্ন পার্টস, এ ছাড়া বহু নিত্যব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্রের ঢালাই করা পার্টস প্রসারণসাধ্য ত্রিভুজের নীতি প্রয়োগ করে আরো উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে৷ মাটহেক বলেন, ‘‘আগে আমাদের প্রতিটি গাঁজ আঁকজোক করে বার করতে হতো৷ আজ আমরা শুধু বলি: এই হল তোমার গাঁজ আর এতোটা জায়গা আছে৷ একটি মাউস ক্লিক দিয়েই আজ গাঁজটাকে তার আদর্শ আকৃতি দেওয়া যায়৷ এ ক্ষেত্রে বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মধ্যে যে টেনসাইল ট্রায়াঙ্গল-গুলো আছে, সেগুলোও তো তার অনুরূপ৷''
ক্লাউস মাটহেক সারা বিশ্বে হাজার হাজার বৃক্ষ পরীক্ষা করে দেখেছেন৷ এবং মাটহেক জানেন: গাছেদের এখনও এমন অনেক রহস্য আছে, যেগুলো খোদ প্রফেসর মাটহেক-এরও অজ্ঞাত৷