গুয়াতেমালায় ভুট্টা আর পাম চাষের কল্যাণে দুই-তৃতীয়াংশ বন সাফ হয়ে গেছে৷ কাজেই স্থানীয় মানুষদের শেখানো হচ্ছে বাগান করার নতুন পদ্ধতি, প্রত্যেকটি পরিবারের জমিতে নানা ধরনের গাছ লাগানো হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
‘দেফেনসোরেস দে লা নাতুরালেসা' সংগঠনের হাইডি গার্সিয়া বেশ কয়েক বছর ধরে এখানকার মানুষদের বাগান করতে শেখাচ্ছেন৷ তিনি জানালেন, ‘‘আমরা দু'টো জিনিস করার চেষ্টা করেছি: প্রথমত আগে যেসব সবজি আর ফলমূলের গাছ লাগানো হতো, কিন্তু আজ আর হয় না, সেগুলোকে ফিরিয়ে আনা৷ অন্যদিকে নতুন সব সবজি আর ফলের গাছলাগানো, যেগুলো খুবই পুষ্টিকর, কিন্তু যেগুলোকে কেউ চেনে না৷ উদ্দেশ্য হলো, প্রত্যেকটি পরিবারের জমিতে নানা ধরনের গাছ লাগানো৷''
কিন্তু সেটা কি এখানে স্বাভাবিক ব্যাপার হওয়া উচিত নয়, ক্রান্তিমণ্ডলীয় অরণ্যের এই প্রান্তে, যেখানে এক ভু্ট্টা ছাড়া বাকি সব গাছই চমৎকার বাড়ে? হাইডি গার্সিয়া বলেন,‘‘ওরা যে কোনোদিন তা করেনি, এমন নয়৷ কিন্তু কোন সুদূর অতীতে তা হারিয়ে গেছে৷ এখানকার মানুষদের মাটির সঙ্গে সম্পর্ক খুব সহজ ও প্রত্যক্ষ – বিশেষ করে ভুট্টার সঙ্গে৷ তা সত্ত্বেও এদের নানা ধরনের গাছ লাগাতে উৎসাহ দিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে৷''
শিক্ষিত তরুণরা কৃষিকাজের দিকে ঝুঁকছেন
দক্ষিণ এশিয়ায় পড়াশোনা বা চাকরির আশায় অসংখ্য তরুণ যখন শহরমুখী, তখন কেনিয়ার বহু শিক্ষিত তরুণই কিন্তু লেখাপড়া শেষে চাকরি পাবার আশায় বসে না থেকে কৃষিকাজ ও পশুপালনের মতো কাজ করছেন৷ তাঁদের মতে, কৃষিকাজ এখন একটা ব্যবসা৷
ছবি: Jeroen van Loon
ক্যারিয়ার পরিবর্তন
ভালো চাকরি বলতে যেসব পেশাকে বোঝায়, তেমন চাকরি খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়ে কেনিয়ার অনেক শিক্ষিত তরুণ এখন কৃষিকাজ ও পশুপালনের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন৷ এই যেমন ছবির বাম দিকের তরুণটির নাম ফ্রান্সিস কিমানি৷ ৩০ বছরের এই তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে পড়াশোনা শেষ করে কোনো চাকরি না পেয়ে এখন একটি খামার পরিচালনা করছেন৷ খামারে একশোর বেশি গরু ও প্রায় ২০০ ভেড়া ও ছাগল রয়েছে৷
ছবি: J. van Loon
কৃষক হয়ে বেশি আয়
খামার থেকে কিমানির আয় প্রতিমাসে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা৷ চাকরি করলে বেতন হিসেবে এই পরিমাণ অর্থ পাওয়া সম্ভব ছিল না৷
ছবি: J. van Loon
নারীরাও এগিয়ে আসছেন
৩০ বছরের মেরি গিতাউ পড়াশোনা শেষে চাকরি পাচ্ছিলেন না৷ শেষে তিনিও কৃষিকাজ শুরু করে দেন৷ ক্যাপসিকাম, স্ট্রবেরি, টমেটো চাষের পাশাপাশি গিতাউ মুরগি, শুকর ও খরগোশ লালন-পালন করেন৷
ছবি: J. van Loon
আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
অ্যাকুয়াপোনিক্স ব্যবস্থার মাধ্যমে একসঙ্গে স্ট্রবেরি ও মাছ চাষ করছেন দানিয়েল কিমানি৷ তিনি মনে করেন, চাষের ক্ষেত্রে নতুন এই ব্যবস্থা আরও জনপ্রিয় হবে৷ কেননা এর ফলে পানি ও জায়গার অভাব দূর করা সম্ভব৷ অ্যাকুয়াপোনিক্স ব্যবস্থায় একটি ট্যাংকের পানিতে মাছ চাষের পাশাপাশি পানির ওপরে কোনো কিছু জন্মানো যায়৷
ছবি: Jeroen van Loon
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার
কৃষিকাজে শিক্ষিত তরুণরা আশায় পণ্য বিক্রি ও বাজারজাতকরণে এসেছে নতুনত্ব৷ ‘মুকুলিমা ইয়ং’ নামের ওয়েবসাইটে তরুণ কৃষকরা তাদের পণ্যের ছবি দেন৷ ক্রেতারাও সেখান থেকেই পণ্য কেনেন৷ এক্ষেত্রে উৎপাদিত পণ্যের দামও কম পড়ে৷
ছবি: Jeroen van Loon
‘‘কেউ কি পাখি বিক্রি করছেন?
এমন সব প্রশ্নের দেখা মেলে ‘মুকুলিমা ইয়ং’ সাইটে৷ ৩৫ বছর বয়সি জোসেফ মাচারিয়া মাত্র এক বছর আগে সাইটটি শুরু করেছিলেন৷ এখন তাঁর ফলোয়ারের সংখ্যা ২৫ হাজারেরও বেশি৷
ছবি: J. van Loon
‘আমরা সবাই কৃষক হতে পারি’
দানিয়েল কিমানির মতে, ‘‘আমরা সবাই আইনজীবী হতে পারবো না৷ তবে আমরা সবাই কৃষক হতে পারি৷’’ এই কথার মাধ্যমে কিমানি তাঁর আশার কথা শুনিয়েছেন৷ তিনি মনে করেন, কেনিয়াতে আরও বেশি সংখ্যক তরুণ কৃষিকাজের দিকে ঝুঁকবে৷ বর্তমানে কেনিয়ার প্রতি চারজনের মাত্র একজন কৃষিকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট৷
ছবি: Jeroen van Loon
কৃষিকাজ এখন একটা ব্যবসা
‘মুকুলিমা ইয়ং’ সাইটের প্রতিষ্ঠাতা জোসেফ মাচারিয়া বলেন, ‘‘কৃষিখাত এখন শুধু পরিবারের চাহিদা মেটানোর একটা উপায় নয়, এটা একটা ব্যবসা৷’’ তাঁর মতে, তরুণরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে সহজেই কৃষি সংক্রান্ত তথ্য পেতে পারে৷
ছবি: Jeroen van Loon
8 ছবি1 | 8
আনারস, মালাঙ্গা আর চায়া
তবে ইতিমধ্যেই চেষ্টার ফল পাওয়া যাচ্ছে৷ হিমেনেজ পরিবারের আনারস ফসল তোলার কাজ প্রায় শেষ৷ কিন্তু মালাঙ্গা ফল আছে, আর আছে চায়া, যার পাতাগুলি খাওয়া হয়৷ চাষি গৃহিণী পেত্রোসিনিয়া রাকাল হিমেনেজ জানালেন, ‘‘আমাদের প্রিয় খাবার হলো এখন চায়া আর পুর দেওয়া কলা....সেটাই আমরা এখন খেতে ভালোবাসি৷''
একটা অপরিচিত গাছ বা পাতা যে কীভাবে সুখাদ্যে পরিণত হয়, তা জানতে হলে একবার চেখে দেখতে হবে৷ সেজন্য পেত্রোসিনিয়া হিমেনেজের রান্নাঘরে মাঝেমধ্যে পাড়ার মহিলাদের জন্য রান্নার ক্লাশের ব্যবস্থা করা হয়৷
গুয়াতেমালা মানে ‘গাছের দেশ'৷ কিন্তু এদেশের বৃষ্টিপ্রধান ক্রান্তীয় অরণ্যের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ আর বাকি – সর্বত্র বন কেটে ভুট্টার ক্ষেত বসানো হচ্ছে৷
ইসাবাল হ্রদের তীরে যতদূর চোখ যায়, পাম গাছের আবাদ৷ সান্তা রোসা বালান্দ্রায় কিন্তু নতুন করে বনায়ন করা হচ্ছে৷ হিমেনেজ পরিবারের বাগানে নতুন গাছগুলোর ছায়ায় এখন কোকোর চাষ হচ্ছে – যা খেতেও ভালো, তেমন বিক্রি করা যায়৷ হাইডি গার্সিয়া বলেন, ‘‘এই কৃষি-ও-বনায়ন পদ্ধতি শুধু পরিবেশের পক্ষেই কল্যাণজনক নয় – এর অর্থনৈতিক দিকটাও রয়েছে৷ চাষের জমির জন্য পরিবারগুলোকে জঙ্গলের উপর হাত বসাতে হচ্ছে না৷ কাজেই তা জঙ্গলকে বাঁচাতেও সাহায্য করছে৷''
মধুর বন সুন্দরবন
সুন্দরবন মানেই শুধু সুন্দরী গাছ আর রয়েল বেঙ্গল টাইগার নয়৷ সেখানে পাওয়া যায় সুস্বাদু মধুও৷ সেগুলো যারা সংগ্রহ করেন তাদের বলা হয় মৌয়াল৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir Uz Zaman
মধু সংগ্রহের মরসুম
প্রতিবছর এপ্রিল থেকে জুন, এই তিনমাস মধু সংগ্রহ করা হয়৷ এ সময় বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে দল বেঁধে বনে প্রবেশ করেন মৌয়ালরা৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir Uz Zaman
দোয়াদরুদ পড়ে নেয়া
মধু সংগ্রহ করতে যাওয়ার আগে বিশেষ প্রার্থনা করে নেন মৌয়ালরা৷ কারণ সেখানে বাঘের ভয়ের পাশাপাশি আছে ডাকাতের ভয়৷ কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যান৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir Uz Zaman
কয়েকজনের দল
মৌয়ালরা বন বিভাগ থেকে কয়েকজন মিলে একটি দল গঠন করে মধু সংগ্রহ করতে যাওয়ার অনুমতি পান৷ এরপর নৌকা করে প্রায় মাসখানেকের জন্য বেরিয়ে পড়েন৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir Uz Zaman
নিয়মকানুন
মধু সংগ্রহের কিছু নিয়মনীতি ঠিক করে দিয়েছে বন বিভাগ৷ যেমন মৌচাক থেকে মৌমাছি সরানোর সময় আগুনের ধোঁয়া ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু অভিযোগ আছে মৌয়ালরা অনেক সময় নিয়ম না মেনে মৌচাকে আগুন ধরিয়ে দেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir Uz Zaman
মধু উৎপাদন হ্রাস
অনেকসময় নিয়মনীতি না মেনে মধু ও মোম সংগ্রহ করায় বিভিন্ন প্রজাতির মৌমাছির বংশ ধ্বংস হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে৷ এতে সুন্দরবন থেকে দিন দিন মধু সংগ্রহের পরিমাণ কমছে বলে জানা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir Uz Zaman
বনে আগুন
মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে কখনও কখনও সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনাও ঘটে৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir Uz Zaman
মৌয়ালদের দুর্দশা
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মধু ও মোম আনতে যান মৌয়ালরা৷ কিন্তু এরপর যে টাকা পান তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাতে হয় তাদের৷ নৌকা ভাড়া ও বনদস্যুদের চাঁদা দিতেই আয়ের একটা বড় অংশ চলে যায় মৌয়ালদের৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir Uz Zaman
7 ছবি1 | 7
মধুর চাষ
মৌমাছিরাও জঙ্গল বাঁচানোর কাজে সক্রিয়৷ তেরো বছরের দেইনার হিমেনেজ এই এলাকার সবচেয়ে কম বয়সের মধুচাষি৷ তার বাবার কাছ থেকে এই কাজ শিখেছে সে৷ এই কাজ করার পাশাপাশি স্কুলেও যায় সে৷
মৌমাছি পালক দেইনার হিমেনেজ বললেন, ‘‘আমার এই ছোট্ট জীবগুলোকে নিয়ে কাজ করতে ভালো লাগে৷ ভবিষ্যতে আমি আরো অনেক শিখতে চাই৷ মৌমাছি পুষে আমি টাকা রোজগার করি; মধু বিক্রি করি; এভাবে আমি আমার প্রশিক্ষণের ফি দিতে পারি৷''
মধু আহরণের জন্য মৌমাছিদের জঙ্গলে পর্যাপ্ত ফুলের মধু খুঁজে পাওয়া চাই৷ কিছু কিছু এলাকার বনায়ন ছাড়াও সান্তা রোসা বালান্দ্রা-র মানুষেরা ৯৫ হেক্টর সাবেক জঙ্গল ফেলে রেখেছে – এখানে যাতে কেউ গাছ না কাটে বা আগুন না ধরায়, তার দেখাশোনা করেন স্থানীয় বাসিন্দারাই৷ এভাবে এখানকার বহু গাছ আর জীবজন্তুও রক্ষা পায়৷ এছাড়া এই জঙ্গল বৃষ্টির জল ধরে রাখে – একেবারে ইসাবাল হ্রদের ধারের জলাভূমি অবধি৷
মানুষকে সাহায্য করার মানে প্রকৃতিকেও সাহায্য করা৷ হিমেনেজ পরিবার আজ প্রায় স্বনির্ভর বলা চলে৷হেক্টর হিমেনেজ বলেন, ‘‘যেভাবে একটা বাচ্চা হাঁটতে শেখে৷ প্রথমে বার বার পড়ে যায়, কিন্তু শেষমেষ হাঁটতে পারে৷ আমরা যা কিছু শিখেছি, আমাদের পরিশ্রম আর আমাদের ইচ্ছা, এ সব ব্যর্থ হয়নি৷ ভবিষ্যতে আমরা অন্যের সাহায্য ছাড়াই আরো অনেকদূর যেতে পারি৷''
জঙ্গল যে কত মূল্যবান, তা সকলেই জানেন৷ যখন এই ২৭টি পরিবারের সদস্যরা জঙ্গলের মাঝখানে তাদের পবিত্র স্থানটিতে একত্রিত হন, তখন তারা পিতা ঈশ্বর ও মাতা পৃথিবীর প্রতি তাদের প্রার্থনা জানান৷