বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে এক সাংবাদিককে গাছে বেঁধে নির্যাতনের মূল হোতা স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার ভাই ও একজন ইউপি সদস্য৷ তারা ওই এলাকায় প্রশাসনের চোখের সামনেই নদী থেকে অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ৷
বিজ্ঞাপন
নির্যাতনে আহত দৈনিক ‘সংবাদ’-এর তাহিরপুর প্রতিনিধি কামাল হোসেন এখন সুনামগঞ্জ জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন৷ তারা মাথা ও কপালসহ শারীরের বিভন্ন স্থানে আঘাতে চিহ্ন আছে৷ তিনি একই সঙ্গে উপজেলা প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদকও৷
তিনি হাসপাতাল থেকে টেলিফোনে জানান, তাহিরপুরের বাদাঘাট ইউনিয়নের ঘাঘটিয়া এলাকায় যাদুকাটা নদীতে অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলনের খবর পেয়ে সোমবার দুপুরের দিকে সেখানে যান৷ গিয়ে দেখেন শ্রমিক নিয়োগ করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা পাথর ও বালু তুলছেন৷ তিনি প্রথমে পুলিশকে খবর দেন৷ পুলিশ তাকে ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেয়ার অনুরোধ করে৷ এরপর তিনি খবরের জন্য ছবি তোলেন ও ভিডিও করেন৷ তখন সেখানে উপস্থিত এই অবৈধ ব্যবসার ‘গডফাদার’ মাহমুদ আলি কোথাও ফোন করে৷ এরপরই সে সাংবাদিক কামালের কাছে গিয়ে জামার কলার ধরে তার হাতে থাকা ভোজালি দিয়ে মাথায় কোপ দিলে তিনি সরে গেলে তার কপালে লাগে৷
কামাল হোসেন
ওই সময় তারা সেখানে ২০-৩০ জন ছিলেন৷ এরপর তাকে রড দিয়ে আঘাত ও কিল ঘুষি দেয়া হয়৷ তখন তিনি জ্ঞান হারান৷
কামাল জানান, ‘‘যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি দেখি আমাকে হাত-পা বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ পাশের বাদাঘাট চকবাজারে নিয়ে গিয়ে গাছের সাথে বাঁধা হয়৷ আমি প্রতিবাদ করলে তারা আবারো মারপিট করে৷’’
খবর পেয়ে দুপুর দুইটার দিকে আরেকজন সাংবাদিক আবির হাসান পুলিশ নিয়ে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে তাহিরপুর উপজেলা হাসপাতাল ও সেখান থেকে সুনামঞ্জ জেলা হাসপাতালে নিয়ে যান৷ আবির হাসান জানান, ‘‘আমরা সেখানে গিয়ে তাকে গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থাতেই পাই৷ তবে পুলিশ যাওয়ার আগেই দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়৷’’
আহত সাংবাদিক কামাল অভিরযোগ করেন, তার ওপর হামলার মূল পরিকল্পনাকারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মোশাররফ তালুকদারের ভাই মুশাহিদ তালুকদার ও স্থানীয় ইউপি মেম্বার মনির উদ্দিন৷ তারও ঘটনাস্থলে ছিলেন৷ তাদের নির্দেশেই হামলা হয়েছে৷ তারা অনেক দিন ধরেই অবৈধভাবে পাথর ও বালু তোলার সঙ্গে জড়িত৷ তাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা আছে৷ বাধ কাটার মামলাও আছে৷ প্রতি বছরই তাদের এই অবৈধ কাজ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে রিপোর্ট হয়, কিন্তু কোনো কাজ হয় না৷
তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মোশাররফ তালুকদার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন,‘‘আমরা ভাই মুশাহিদ ঘটনার সময় সেখানে ছিলোনা৷ আর মনির মেম্বার অকে জনপ্রিয়৷ সে তিন বারের মেম্বার৷’’ তবে তিনি বলেন,তারা পাঁচ ভাই৷ মুশাহিদ সবার ছোট৷ সবাই প্রাপ্ত বয়স্ক৷ যার যার ব্যবসা স্বাধীনভাবে করে৷ সে কি করে সব সে জানেনা৷ এলাকার অনেকেই গোপনে এবং রাতে পাথর ও বালু তোলে৷ তিনি নিজে পাথরের ব্যবসা করেন৷
মোশাররফ তালুকদার
এই ঘটনায় মোট পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে৷ আসামিরা হলেন, মাহমুদ আলী শাহ, রইস উদ্দিন, দীন ইসলাম, মুশাহিদ তালুকদার ও মনির উদ্দিন মেম্বার৷ পুলিশ সন্দেহজনকভাবে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে৷ তবে এজাহারভুক্ত কাউকেই এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি৷ থানার সাব-ইন্সপেক্টর দীপঙ্কর বিশ্বাস জানান, ‘‘এজাহারভুক্তরা পলাতক আছে৷ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে৷’’
আহত সাংবাদিক কামাল জানান, তার পরিবারের সদস্যরা এখন আতঙ্কের মধ্যে আছেন৷ মামলা করায় তার বাড়িতে হামলার আশঙ্কা করছেন তিনি৷
তাহিরপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি আমিনুল ইসলাম জানান, তারা মঙ্গলবার উপজেলায় প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন৷ আসামিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন৷ তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘মফস্বল সাংবাদিকদের কোনো ধরনেরই নিরাপত্তা নাই৷ আর্থিক বা শারীরিক কেনোটাই না৷ অধিকাংশ সাংবাদিক বেতন পান না৷ আবার প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও দুর্বৃত্তদের চাপের মুখে থাকতে হয়৷’’ তার মতে, হামলা হুমকি এড়াতে সাংবাদিকদের একসঙ্গে চলার বিকল্প নাই৷
দেশে দেশে সাংবাদিক নির্যাতন
বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনা বেড়েই চলছে৷ এ রকম গুরুত্বপূর্ণ ১০ ঘটনা নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/J. Thys
হত্যা
রাজনৈতিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও সন্ত্রসী কর্মকাণ্ড বিষয়ে সোচ্চার মেক্সিকোর সাংবাদিক মিরোস্লাভা ব্রিচ ভেলডুসিয়া গত মার্চ মাসে খুন হয়৷ জানা যায়, এ ধরণের সামাজিক অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই হুমকি দেয়া হচ্ছিল তাঁকে৷
ছবি: EPA
অষ্টমবারের মতো গ্রেপ্তার!
অষ্টমবারের মতো গ্রেপ্তার হলেন ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা৷ গত শুক্রবার ফিলিপাইনের ম্যানিলা বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয় তাঁকে৷ পরে জামিনে মুক্ত হন তিনি৷ তার আগে, মানহানির অভিযোগ এনে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আটক করা হয়েছিল তাঁকে৷ গত সপ্তাহে মারিয়া রেসার বিরুদ্ধে বিদেশি গণমাধ্যমের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে মামলা দায়ের করে সরকার৷
ছবি: Reuters/E. Lopez
একদিনেই বিচারের রায়!
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছড়ানোর অভিযোগে ভিয়েতনামের নারী সাংবাদিক ট্রান থি গা’র বিচার করা হয়৷ বিচারের রায় একদিনেই দেয়া হয়েছে এবং এতে তাঁকে নয় বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ সরকারের দুর্নীতি ও পরিবেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ভিডিও প্রতিবেদন করেছিলেন থি গা৷
ছবি: Reuters
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
নয় বছর ধরে কারাগারে বন্দি আছেন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত কিরগিজস্তানের সাংবাদিক আজিমজন আসকারভ৷ মানবাধিকারের বিষয়ে তাঁর করা কিছু প্রতিবেদন রুষ্ট করে দেশটির সরকারকে৷
ছবি: Sherzod Askarov
বিব্রতকর অবস্থায় ভারতীয় সাংবাদিক
ভারতীয় নারী সাংবাদিক রানা আইয়ুব দেশটির বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে কাজ করেন৷ নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন তিনি৷ তাঁর ছবি ফটোশপ করে পর্নোগ্রাফি বানিয়ে তা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে৷ সাথে দেয়া হচ্ছে তাঁর মোবাইল নম্বরও৷
ছবি: Marie Claire South Africa
আইনি সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে না
ডিসেম্বর মাসে নিকারাগুয়ার পুলিশ দেশটির ‘১০০% নেটিসিয়াস’ নামে টেলিভিশন চ্যানেলে হানা দিয়ে মিগুয়েল মুরা ও লুসিয়া পিনেডা উবেনা নামের দুই সাংবাদিককে আটক করে৷ তাঁদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও সহিংসতা ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়৷ মামলা চলছে তাঁদের বিরুদ্ধে, তবে যথাযথ আইনি সহযোগিতা পাননি এ দুই সাংবাদিক৷ (ছবিতে মিগুয়েল মুরাকে দেখা যাচ্ছে)
ছবি: 100% Noticias
গ্রেপ্তারের হুমকি
আটকে থাকা সহকর্মীদের মুক্তির জন্য লড়াই করে যাওয়া দক্ষিণ সুদানের জুবা মনিটর সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক আন্না নিমিরানো প্রতিনিয়তই গ্রেপ্তার হওয়ার আতঙ্কে থাকেন৷ সহকর্মীদের মুক্তির দাবিতে এ লড়াইয়ের জন্য তাঁকে গ্রেপ্তারের হুমকি দেয়ার পাশাপাশি পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়ারও হুমকি দিচ্ছে সরকার৷
ছবি: IWMF
বিচার ছাড়াই আটকে থাকা
মোজাম্বিকের উত্তরাঞ্চলে সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত এক পরিবারের ছবি তোলার অপরাধে আটক করা হয় দেশটির সাংবাদিক আমাডে আবুবাকারকে৷ গত জানুয়ারি মাসে আটক হওয়া এ সাংবাদিককে এখনও বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি৷ (ছবিতে মোজাম্বিকের গণমাধ্যমকর্মীদের দেখা যাচ্ছে)
ছবি: DW/A. Sebastiao
অপহরণের শিকার
অপহরণ, নজরদারি ও মানসিক নির্যাতনসহ সব অত্যাচারই সহ্য করতে হয়েছে কলম্বিয়ার প্রবীণ অনুসন্ধানী সাংবাদিক ক্লাউডিয়া ডুকুকে৷ ক্লাউডিয়াকে নির্যাতনের অপরাধে সরকারের তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তকাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল আদালত৷
ছবি: DW
কারাগারে নির্যাতন
গত ফেব্রুয়ারি মাসে সুদান সরকার দেশটির আল-তায়ার পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ওসমান মারঘানিকে আটক করে৷ আটক অবস্থায় তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়ে বলে জানা যায়৷ কেন তাঁকে আটক করা হয়েছে, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু বলেননি কর্তৃপক্ষ৷ আটক হওয়ার আগে, দেশটির সরকারবিরোধী আন্দোলন বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন তিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Shalzy
বাকস্বাধীনতা রক্ষায় ডয়চে ভেলে
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাংবাদিকদের উপর নির্যাতনের বিষয়ে সোচ্চার ডয়চে ভেলে৷ এরই অংশ হিসেবে ‘ওয়ান ফ্রি প্রেস কোয়ালিশন’ নামে গণমাধ্যম উন্নয়ন বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে যুক্ত হয়েছে ডয়চে ভেলে৷ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে প্রতিমাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ওয়ান ফ্রি প্রেস কোয়ালিশন৷ সাংবাদিক নির্যাতনের ১০টি ঘটনা নিয়ে এপ্রিলের এ সংখ্যাটি প্রকাশ করেছে তারা৷