ইউরোপ-অ্যামেরিকায় কিশোর-কিশোরীদের খেলার একটা বিশেষ জায়গা হলো ট্রি হাউস বা গাছ-বাড়ি৷ এবার ছেলেবেলার সেই ‘খেলাঘর’ প্রাপ্তবয়স্কদের হোটেল হয়ে ফিরে এসেছে, বেশ চড়া দামে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির একেবারে পুব কোণায়, পোল্যান্ডের সীমান্তের কাছে জঙ্গলের মধ্যে একটা গ্রাম, যেন কোনো ফ্যান্টাসি ফিল্মের দৃশ্যপট! গাছের সঙ্গে লাগোয়া ন'টি কাঠের বাড়ি, যে গুলোতে সিঁড়ি কিংবা মই দিয়ে চড়তে হয়৷ এটাই হল ‘গাছ-বাড়ির হোটেল' যার পোশাকি নাম সংস্কৃতি-দ্বীপ তপোবন৷
ড্রেসডেন শহর থেকে আগত দুই বান্ধবী, লিজা কিয়র্স্টেন এবং পাউলিনা উর্সিনস এখানে গাছের মাথায় রাত কাটাতে চান৷ এই রূপকথার কাঠের বাড়িগুলোর মতো দেখতে হোটেলে এক রাতের ভাড়া ১৮০ ইউরো কিংবা তার বেশি হতে পারে৷
প্রত্যেকটি গাছ-বাড়ি কোনো একটি বিষয় ও রূপকথার কোনো কাল্পনিক চরিত্রকে নিয়ে সৃষ্টি৷ আরামের উপকরণ সব বাদ দেওয়া হয়েছে: এখানে না আছে কলের জল, না বিদ্যুৎ, না হিটিং৷ টেলিভিশন, ইন্টারনেট কিংবা রুম সার্ভিসও অনুপস্থিত৷ তবে ও সব বাদ দিয়ে থাকতে রাজি হলে, চারতলা উঁচু থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মন ভরানো যাবে৷
‘ট্রি হোটেল'
২০০৫ সালে ইয়ুর্গেন ব্যার্গমান এই ‘ট্রি হোটেল'-টি তৈরি করেন৷ ইয়ুর্গেন হলেন শিল্পী৷ গাছ-বাড়ির বেশ কয়েকটি তৈরি হয়েছে তাঁর নিজের নকশায়৷ জার্মান পর্যটন পুরস্কার বিজয়ী ইয়ুর্গেন ব্যার্গমান বলেন: ‘‘আমি ছোটবেলায় এই ধরনের সব গাছ-বাড়ি দেখে বড় হয়েছি৷ আমি নিজেও বস্তুত একটি গাছ-বাড়িতে থাকি, আমার অফিসও একটি গাছ-বাড়িতে৷ আমার অতিথিদেরও আমি সে সুযোগ দিতে চাই৷''
এখান থেকে দু'শো কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে রাজধানী বার্লিন: সেখানে পাওয়া যাবে হালফ্যাশনের গাছ-বাড়ি৷ চার মিটার উচ্চতায়; বাড়ির দেয়াল অ্যালুমিনিয়ামের পাতে মোড়া৷ বাড়ি দু'টি ভাড়া নেওয়া যায়; ভাড়া পড়ে সপ্তাহে ৮০০ ইউরো কিংবা তার বেশি৷ শোবার ঘর, বসবার ঘর আর স্নানের ঘর মিলিয়ে প্রায় ৩০০ স্কোয়্যার ফুট৷ গাছ-বাড়ি দু'টির মালিক কলিয়া স্টেগেমান তাঁর শৈশবের স্বপ্ন পূর্ণ করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রতিটি কিশোর এ ধরনের একটি গাছ-বাড়ি তৈরির স্বপ্ন দেখে বলে আমার ধারণা৷ আমার ক্ষেত্রে সেটা আমার বয়সের অনুপাতে এই চেহারা নিয়েছে৷ আসলে এটা খেলা, অরণ্য প্রকৃতি, জানার কৌতূহল, এ সব মিলিয়ে একটা কিছু৷ হয়ত নতুন কিছু পরীক্ষা করে দেখার আনন্দ; আবার আরামপ্রদ, প্রথাগত বাড়ি তৈরি করার আত্মপ্রসাদটাও রয়েছে৷''
জার্মানির বাগানে বাংলাদেশের গাছ
১৯৮০ সালে ‘ফ্রিডেন্সভাল্ড’ বা শান্তির বাগানটি তৈরি করা হয়েছে, যেখানে বিশ্বের ১৪২টি দেশের গাছ লাগানো হয়েছে বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে৷ এখানে এতগুলো দেশের গাছ পাশাপাশি থাকবে, বেড়ে উঠবে, সহাবস্থান করবে৷
ছবি: imago/Photoshot/Balance
লাল সবুজ পতাকা
জার্মানির কোলন শহরের অভিজাত এলাকা রোডেনকির্শেন৷ সেই এলাকারই এক কোণে তৈরি করা হয়েছে ২৬ হেক্টর জমি জুড়ে সুন্দর একটি বাগান৷ এই বাগানে আছে বাংলাদেশের একটি গাছ৷
ছবি: Mohammad Zahidul Haque
শান্তির বাগানে সহাবস্থান
১৯৮০ সালে ‘ফ্রিডেন্সভাল্ড’ বা শান্তির বাগানটি তৈরি করা হয়েছে, যেখানে বিশ্বের ১৪২টি দেশের গাছ লাগানো হয়েছে বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে৷ এখানে এতগুলো দেশের গাছ পাশাপাশি থাকবে, বেড়ে উঠবে, সহাবস্থান করবে৷ গাছ লাগানোর মধ্য দিয়ে জার্মানির সাথে এই দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্ক গাঢ় হবে – এমন ভাবনা থেকেই কিন্তু এই উদ্যোগ৷
ছবি: DW/N. Sattar
সারা বছরই মানুষের ভিড়
যে কোনো ঋতুতেই এখানে প্রচুর লোকজন আসেন বেড়াতে, হাঁটতে বা জগিং করতে৷ গাছগুলো এমনভাবে সাড়ি বেঁধে লাগানো যেন ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়৷ বাংলাদেশ, ভারত, অ্যামেরিকা, আফ্রিকা যে কোনো দেশের গাছেই সে দেশের পতাকা লাগানো আছে৷ কোনো কোনো দেশের আবার একটি নয়, অনেকগুলো গাছ রয়েছে শান্তির প্রতীক হিসেবে৷
ছবি: DW/N. Sattar
বসন্ত
বসন্ত যে এসে গেছে, সেটা বাগানের গাছটিই বলে দিচ্ছে৷ ভাবতে এখন হয়ত অবাকই লাগবে যে গাছটি শীতকালে একেবারেই ন্যাড়া ছিল৷ আসলে জার্মানিতে কখন কোন ঋতু চলে তা গাছের দিকে তাকালেই বোঝা যায়৷ যদিও এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তা অনেকটাই বদলে গেছে৷
ছবি: DW/N. Sattar
মুক্ত হাওয়া
গ্রীষ্মের মিষ্টি সকালে এমনি করেই শান্তির বাগানে এসে মুক্ত হাওয়া সেবন করে নেয় মেয়েটি৷ এতে তার মনে হয়, সে যেন সারাদিন শান্তিতে থাকতে পারে৷ আজকের এই যান্ত্রিক জীবনে এটা খুবই প্রয়োজন, তাই নয় কী?
ছবি: Fotolia/Fotowerk
ভালোবাসার ফুল
শান্তির বাগানে এসে সুন্দর একটি জায়গা খুঁজে নিয়ে প্রেমিকাকে ফুল উপহার দিচ্ছেন, যেন তাকে সারা জীবন শান্তিতে রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে৷
ছবি: Fotolia/TeresaYehPhotography
সাদা বালির লেক
শান্তির বাগানে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে সবই পরিবর্তন হয়৷ তবে এই সাদা বালির অংশটুকুর কোনো পরিবর্তন হয় না, সব সময় সাদাই থাকে৷ এখানে বাচ্চারা খেলতে খুবই ভালোবাসে৷ বছরের যে কোনো সময়ই তাই দেখা যায় তাদের৷
ছবি: DW/N. Sattar
মিনি পাহাড়
বালির লেকের একটু ওপরেই খানিকটা জায়গা পাহাড়ের মতো উঁচু-নীচু৷ যেখানে শীতকালে বাচ্চারা বরফ দিয়ে খেলতে ভালোবাসে৷ মাঝে মধ্যে বড়রাও কিন্তু সঙ্গ দেন এই অপার আনন্দে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
একটুখানি বিশ্রাম
বাগানের শুরুতেই ১৪২টি দেশের গাছ লাগানো হয়েছে আর ভেতরে দিকে করা হয়েছে একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন৷ পুরো গার্ডেন হেঁটে ক্লান্ত? তাহলে তো চাই একটুখানি বিশ্রাম! তবে হঠাৎ যদি বৃষ্টি আসে তাহলে ছাতাটি কিন্তু বড় কাজে দেয়৷
ছবি: DW/N. Sattar
রডোডেনড্রন
শান্তির বাগানের একটা বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে নানা রং-এর রডোডেনড্রন ফুলের গাছ৷ এ বছর অবশ্য এখনো সব গাছে ফুল ফোটেনি৷
ছবি: DW/N. Sattar
বেড়ানোর মধ্যেই কাজ
অনেকক্ষণ খোঁজার পর ছাত্রীরা পেয়ে গেছে শিক্ষকের নাম বলে দেওয়া গাছটি, যে গাছ সম্পর্কে গত সপ্তাহেই ক্লাসে আলোচনা করা হয়েছে৷ স্বাভাবিকভাবেই, এখন তারা মহা খুশি৷
ছবি: DW / Gaby Reucher
অসুস্থ গাছ
গাছটা কি সত্যি অসুস্থ? পরীক্ষা করে দেখছে৷ এভাবেই কিন্তু নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখা হয় বিশাল বাগানের প্রতিটি গাছ৷
ছবি: picture alliance/empics
পুরো পরিবার
সপ্তাহান্তেই কেবল পুরো পরিবারের একসাথে হওয়ার সুযোগ৷ তাই সবাই মিলে শান্তির বাগানে এসেছে৷ উদ্দেশ্য ছোটবেলা থেকেই যেন বাচ্চাদের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক গড়ে উঠে৷ এই বাগানে এই একই লক্ষ্য নিয়ে ছোট্ট একটি কিন্ডারগার্টেনও করা হয়েছে৷
ছবি: Bilderbox
গাছ কাটা
গাছের যত্নের কোনো ত্রুটি নেই৷ অসুস্থ গাছকে সময় মতো কেটে ফেলা হয়৷ তবে একটা গাছ কাটা মানেই কিন্তু আর একটা গাছ লাগানো৷ বলা যায় একেবারে সঙ্গে সঙ্গেই!
ছবি: imago/Photoshot/Balance
14 ছবি1 | 14
ডিজাইনার গাছ-বাড়ি
সুইডেনের বোডেন পৌর এলাকাটি মেরুবৃত্তের ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে৷ কেন্ট ও ব্রিটা লিন্ডভাল ২০১০ সালে এখানে তাঁদের ‘ট্রি হোটেল'-টি খোলেন৷ কেন্ট লিন্ডভাল বলেছেন: ‘‘গাছের মগডালে এ সব জিনিস করাটা একটা মজার ব্যাপার....এখানে আমাদের চারপাশে একটিই বস্তু আছে: একগাদা গাছ৷ কাজেই আমাদের তা নিয়েই কিছু একটা করতে হয়েছে৷''
মাটি থেকে ছ'মিটার উঁচুতে ছ'টি ডিজাইনার গাছ-বাড়ি – প্রত্যেকটি বাড়ি একক ও অনন্য; প্রতিটি বাড়িই ভিন্ন ভিন্ন স্থপতির নকশা অনুযায়ী তৈরি৷ কটেজ-গুলো ১৬০ থেকে ৫৬০ স্কোয়্যার ফুট৷ আসবাবপত্র যথাসম্ভব কম – কিন্তু দামি৷ দু'জনের থাকার এক রাত্তিরের ভাড়া ৫০০ ইউরো কিংবা তার বেশি৷ কেন্ট লিন্ডভাল জানালেন: ‘‘আমরা চেয়েছিলাম একটা ডিজাইনার পরিবেশ প্রেজেন্ট করতে৷ ট্রি হাউসে থাকার অভিজ্ঞতাকে আনন্দদায়ক, সুন্দর একটা কিছু হতে হবে৷''
বগুড়ার এক অন্যরকম হোটেল
02:26
যে বাড়ি বাতাসে দোলে
ফেরা যাক জার্মানির গাছ-বাড়ি হোটেলে৷ লিজা কিয়র্স্টেন ও তাঁর বান্ধবী হোটেল-সংলগ্ন অ্যামিউজমেন্ট পার্কে দিনটা কাটিয়েছেন৷ লিজা কিয়র্স্টেন বলেন: ‘‘একটা সাধারণ হোটেলে তো সবসময়েই ঘর নেওয়া যায়, সব জায়গাতেই৷ অবশ্যই সেখানে আরাম অনেক বেশি৷ কিন্তু এখানে আছে অ্যাডভেঞ্চার, নতুন সব অভিজ্ঞতা৷ আমরা একটা জঙ্গলের মধ্যে রয়েছি – এমনকি বাড়িটাও দোলে! সেটাই তো একটা দারুণ ব্যাপার৷''
গাছ-বাড়ি হোটেলগুলো পরস্পরের থেকে যতই অন্যরকম হোক না কেন, একটি বিষয়ে তারা এক: সন্ধ্যায় বাতাসের শব্দ আর পাতার মর্মরে অতিথিদের চোখে ঘুম নেমে আসতে বাধ্য৷