৫০ দিন ধরে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ চলেছে৷ চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ধ্বংসস্তূপ৷ জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন বলেছেন, শুধু অর্থ দিয়ে দুর্দশা কমানো যাবে না৷ এই প্রথম পুনর্গঠনের বিষয়ে ঐকমত্য দেখা যাচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
প্রায় আড়াই বছরে গাজায় পা দেননি তিনি৷ গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন সেখানে গেলেন – ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের ধ্বংসলীলার মাত্রা নিজের চোখে দেখতে৷ হাজার-হাজার মানুষ সেখানে ভিটেমাটি হারিয়েছেন৷ অবকাঠামোর ব্যাপক মেরামতির প্রয়োজন৷ জলের সরবরাহ ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে৷
গাজার উত্তরে জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে জাতিসংঘের একটি স্কুল পরিদর্শন করেন বান৷ সাজাইয়া এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি৷ ৫০ দিনের যুদ্ধে এই এলাকায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে৷ বান বলেন, গাজায় আসা তাঁর জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল৷ ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য তাঁর বার্তা হলো, তারা একা নয়৷ ‘‘এই ধ্বংসলীলা বর্ণনা করা সম্ভব নয়'' – বলেন বান কি-মুন৷ গাজার পুনর্গঠনের প্রস্তুতি কেমন চলছে, সে বিষয়ে আরও জানতে চেয়েছিলেন তিনি৷ তার আগেই ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এক ত্রিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে পুনর্গঠনের সময়সীমা স্থির করতে পেরেছে জাতিসংঘ৷ মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে এর মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে৷ হামাস নির্মাণ কাজের মালমশলা যাতে অন্য কাজে ব্যবহার না করতে পারে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে তা নিশ্চিত করতে হবে৷ গাজা সফরের সময়ই বান কি-মুন জানিয়ে দেন যে, নির্মাণের মালমশলা বোঝাই প্রথম ট্রাকগুলি গাজার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে৷ ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও এএফপি-কে একই কথা জানিয়েছিল৷
দুটি ভিন্ন ক্ষেত্র
পুনর্গঠন চুক্তিতে জাতিসংঘের প্রকল্প ও ফিলিস্তিনি প্রকল্পের মধ্যে তফাত রাখা হয়েছে৷ জাতিসংঘের প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে বিস্তারিতভাবে না জানালেও চলবে৷ কিন্তু কোনো ফিলিস্তিনি ব্যবসায়ী মালমশলা আমদানি করতে চাইলে তাঁকে এক অনলাইন তথ্যভাণ্ডারে নিজের নাম নথিভুক্ত করতে হবে৷ পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও ইসরায়েল এই তথ্যভাণ্ডার যৌথভাবে পরিচালনা করে৷ সেখানে প্রত্যেক ব্যবসায়ী সম্পর্কে ভালো করে খোঁজখবর নেওয়া হয়৷ সব ধরনের পুনর্গঠনের উপর নজর রাখে জাতিসংঘের এক ‘টিম'৷ ২০০৮-২০০৯ সালের যুদ্ধের পর ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞার কারণে অর্ধেকের বেশি বাড়িঘর পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়নি৷ অথচ এর জন্য কোটি কোটি ডলার অর্থ সাহায্য এসেছিল৷ তখনকার ইসরায়েলি সরকার দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে বলেছিল, হামাস নির্মাণ কাজের মালমসলার অপব্যবহার করতে পারে৷ সেই সংশয় দূর করতেই নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছিলো৷ গাজার সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়েছিল ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাঁধে৷
গত ১২ই অক্টোবর আন্তর্জাতিক দাতাদের সম্মেলনে যুদ্ধের পর গাজার পুনর্গঠনের জন্য ৪৩০ কোটি ইউরো সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে৷ তবে এর অর্ধেক অর্থ সরাসরি গাজার পুনর্গঠনে ব্যয় করা হবে৷ বাকি অর্ধেক ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে গচ্ছিত থাকবে, যদিও তা ব্যয়ের জন্য কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করা হয় নি৷
গাজাবাসীর ‘লাইফলাইন’ টানেল নেটওয়ার্ক
গাজায় ইসরায়েলের হামলার অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হচ্ছে টানেলের কথা, যেগুলো হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলে প্রবেশের জন্য ব্যবহার করছে৷ এগুলো ধ্বংস করতে চায় ইসরায়েল৷ তবে এসব টানেল অন্য অনেক কাজেও ব্যবহার হচ্ছে৷
ছবি: picture alliance/landov
‘লাইফলাইন’ এবং চোরাচালানের পথ
ফিলিস্তিনিরা টানেল বা সুড়ঙ্গগুলোকে তাদের লাইফলাইন মনে করে, যদিও ইসরায়েল এগুলোকে বিবেচনা করে অস্ত্র চোরাচালান এবং চোরাগোপ্তা হামলার পথ হিসেবে৷ চারপাশ থেকে আবদ্ধ গাজার সঙ্গে বিশ্বের সংযোগের অন্যতম পথ এসব টানেল৷ এগুলো ব্যবহার করে এমনকি পশুও গাজায় নেয়া হয়৷
ছবি: Getty Images
নিজেদের ভূমিতে কারাবন্দি
গাজায় প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষের বাস৷ প্রতিবেশী দেশ ইসরায়েল এবং মিশর থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে উঁচু দেয়াল দিয়ে৷ সীমান্ত চেকপোস্টগুলোতে রয়েছে কড়া পাহারা৷ একসময় মিশরের রাফা সীমান্ত ব্যবহার করে গাজার বাইরে যেতে পারতো ফিলিস্তিনিরা৷ কিন্তু ২০০৭ সালের জুনে হামাস গাজার ক্ষমতা নেয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছে সেই সীমান্তও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণকাজ
আর তখন থেকে গাজাবাসী বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে একমাত্র টানেল বা সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে৷ এগুলো অধিকাংশক্ষেত্রে তৈরি করা হয় অনিরাপদ এবং সাধাসিধে উপায়ে৷ নির্মাণকাজে ব্যবহার হয় বেলচা এবং কাঠ৷ তরুণ ফিলিস্তিনিদের জন্য অর্থ উপায়ের অল্প কিছু মাধ্যমের একটি এই সুড়ঙ্গ খনন৷ তবে এই কাজে মৃত্যু ঝুঁকিও আছে৷
ছবি: Getty Images
গোপন প্রবেশপথ
টানেলে প্রবেশের পথ অধিকাংশক্ষেত্রে সাধারণ বাসাবাড়ির মধ্যে থাকে৷ মূলত বাইরে থেকে যাতে বোঝা না যায়, সেজন্য এই ব্যবস্থা৷ যারা এসব টানেল ব্যবহার করতে চান, তাদের এজন্য টাকা খরচ করতে হয়৷ ইসরায়েল মনে করে, গাজাবাসী টানেল ব্যবহারের জন্য যে টাকা খরচ করেন, তা অন্যান্য চাহিদা মেটাতে আরো ভালো কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images
নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র আনার পথ
ফিলিস্তিনিরা এসব টানেল ব্যবহার করে নির্মাণকাজের জন্য সিমেন্ট এবং অন্যান্য উপাদান গাজায় আনেন৷ ঘরবাড়ি তৈরি কিংবা সংস্কারে এগুলো দরকার হয়৷ এছাড়া ভোগ্যপণ্য, কাপড় এমনকি রকেট এবং বিস্ফোরকও টানেল দিয়েই গাজায় আসে৷
ছবি: DW/T. Krämer
সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে
গত ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে গাজায় টানেল রয়েছে৷ ১৯৭৯ সালে ইসরায়েল এবং মিশরের মধ্যে শান্তি চুক্তির পর রাফা শহরটি বিভক্ত হয়ে যায়৷ এর অর্ধেক চলে যায় মিশরের দখলে বাকিটা গাজার৷ তখন থেকেই শহরটির দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগ এবং মালামাল পরিবহণের উপায় হয়ে ওঠে সুড়ঙ্গ পথ৷
ছবি: Getty Images
মিসাইল থেকে বাঁচার উপায়
এখন অনেক সাধারণ টানেলেও যোগাযোগের আধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে৷ বিশেষ করে বিদ্যুৎ এবং টেলিফোনের কথা বলা যায়৷ সুড়ঙ্গ খননের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা মাটির উপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন টেলিফোনের মাধ্যমে৷ আর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী যখন আক্রমণ করে, তখন অনেক ফিলিস্তিনি জীবন বাঁচাতে বা লুকিয়ে থাকতে টানেলে আশ্রয় নেন৷
ছবি: Getty Images
মিশরও ধ্বংস করছে সুড়ঙ্গ
শুধুমাত্র ইসরায়েলই গাজার সুরক্ষা নেটওয়ার্ক ধ্বংসের চেষ্টা করছে না৷ মিশরও এগুলোর বিরোধী৷ সেদেশের সিনাই উপত্যকায়ও হামাসের হামলার অভিযোগ রয়েছে৷ তাই মিশরের সেনারাও বছরের পর বছর তাদের ভূখণ্ডের নীচে থাকা টানেল ধ্বংসের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: DW/S.Al Farra
মাটির নীচে বিপদ
শুধুমাত্র ইসরায়েলি সেনাদের হত্যার উদ্দেশ্যেও অনেক সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছে৷ ২০০৪ সালে হামাসের প্রকাশিত এই ছবিতে কিছু বিস্ফোরক দেখানো হয়েছে যা ব্যবহার করে সেবছরের ডিসেম্বরে ইসরায়েলের একটি সেনা ঘাঁটির নীচে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল৷ এতে পাঁচ ইসরায়েলি সেনা নিহত এবং দশজন আহত হন৷
ছবি: Getty Images
সুড়ঙ্গে মন্ত্রী
গাজা থেকে ইসরায়েলে প্রবেশের জন্য তৈরি এই সুড়ঙ্গটি ২০১৩ সালে প্রদর্শন করেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোসা ইয়ালন৷ ইসরায়েলের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, হামেস এই টানেল দিয়ে ইসরায়েলে হামলা এবং ইসরায়েলিদের অপহরণ করেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আক্রমণ চলছেই
ইসরায়েল দাবি করেছে, গাজায় কয়েক ডজন টানেল ধ্বংসে সক্ষম হয়েছে তাদের সেনাবাহিনী৷ গত আট জুলাই থেকে গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল৷ এতে বুধবার (৩০.০৭.১৪) পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে বারোশ’র বেশি মানুষ, যাদের অধিকাংশই নিরীহ ফিলিস্তিনি৷
ছবি: picture alliance/landov
11 ছবি1 | 11
প্রয়োজন সার্বিক সমাধানসূত্র
বান কি-মুন মনে করেন, গাজার পুনর্গঠন যথেষ্ট নয়৷ গাজা বারুদের স্তূপ হয়ে রয়েছে৷ ইসরায়েল ও মিশরের অবরোধের কারণে সাধারণ মানুষের কঠিন জীবনযাত্রারও উন্নতির প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তিনি৷ প্রয়োজন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরার অধিকার৷ মোটকথা এমন উন্নতি চাই, যার ফলে মানুষের সরাসরি উপকার হয়৷ গাজায় স্থিতিশীলতা এলে তা ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্যও ভালো হবে৷ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেন, এক সার্বিক সমাধানসূত্র ছাড়া হিংসার চক্র বন্ধ হবে না৷ কেরি বলেন, ‘‘অস্ত্রবিরতি মোটেই শান্তি নয়৷ আমাদের আলোচনার টেবিলে ফিরতে হবে এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষদের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে হবে৷ সেই সব সিদ্ধান্ত হতে হবে অস্ত্রবিরতির চেয়েও বড় পদক্ষেপ৷''