গাজার যেসব গোপন সুড়ঙ্গ থেকে ইসরায়েলের উপর আক্রমণ চালানো হয়ে থাকে, সেগুলিকে ধ্বংস করা ইসরায়েলের নিরাপত্তা নীতির ‘অত্যাবশ্যক উপাদান' বলে ঘোষণা করেছেন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী৷
বিজ্ঞাপন
সুড়ঙ্গগুলি দিয়ে প্রধানত গাজা স্ট্রিপে পণ্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে৷ তবে অনেক সময় আবার ইসরায়েলি রাজ্যাঞ্চলের উপর আক্রমণও চালানো হয়৷ ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী আভিগডর লিবারমান সুড়ঙ্গগুলিকে ধ্বংস করা নিরাপত্তা নীতির ‘অত্যাবশ্যক উপাদান' বলে অভিহিত করেছেন৷
লিবারমান রবিবার বলেন, ‘‘২০১৮ সালের মধ্যে আমরা হামাসের সব আক্রমণের সুড়ঙ্গ নির্মূল করব... হয়তো তার আগেই তা করতে পারব, কিন্তু লক্ষ্য হবে, এ বছর শেষ হওয়ার আগে সব ক'টি (সুড়ঙ্গ) ধ্বংস করা'' ৷
আফ্রিকান অভিবাসীদের ফেরত পাঠাতে ইসরায়েলের উদ্যোগ
01:15
‘‘আক্রণাত্মক সুড়ঙ্গগুলির জাল বিনষ্ট করা হামাসের কৌশলগত ক্ষমতা ক্রমাগত হ্রাস করার নীতির একটি অত্যাবশ্যক উপাদান,'' বলে লিবারমান ঘোষণা করেন৷
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) রবিবার জানায় যে, ইসরায়েলের উপর আক্রমণের জন্য হামাসের খোঁড়া একটি আন্তঃ-সীমান্ত সুড়ঙ্গ আইডিএফ-এর অভিযানে ধ্বংস হয়েছে৷ আইডিএফ মুখপাত্র জোনাথান কনরিকাস জানান যে, শনিবার ইসরায়েলি বিমানবাহিনী ‘সন্ত্রাস সুড়ঙ্গ'-টির গাজা প্রান্তের উপর আক্রমণ চালায়৷
‘ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘণ'
টুইটে আইডিএফ লিখেছে, এই সুড়ঙ্গগুলি নির্মাণ ও ব্যবহারের জন্য আইডিএফ হামাসকেই দায়ী মনে করে৷
সুড়ঙ্গ নির্মাণকে ‘‘গুরুতরতরভাবে ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘণ''-এর সঙ্গে তুলনা করে আইডিএফ বিবৃতিতে আরো বলেছে, ‘‘হামাস এর পরিণামের জন্য দায়ী'' এবং হামাস ‘‘বারংবার গাজার নাগরিকদের বিপদ ডেকে আনছে৷''
গাজা থেকে মিশর ও ইসরায়েলের দিকে যেসব সুড়ঙ্গ নির্মাণ করা হয়েছে, তার অধিকাংশ গাজা স্ট্রিপে চোরাচালানের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যার পটভূমিতে রয়েছে গাজা স্ট্রিপের উপর ইসরায়েলের অবরোধ৷ অপরদিকে ফিলিস্তিনি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি একাধিকবার এই সব সুড়ঙ্গ থেকে ইসরায়েলের উপর আক্রমণ চালিয়েছে, বিশেষ করে ২০১৪ সালের সংঘাতে৷
উত্তেজনা বাড়ছে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতমাসে একতরফাভাবে সিদ্ধান্তে নেন যে, জেরুসালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে৷ তারপর থেকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে৷
জার্মানি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের তরফ থেকে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলা হয় যে, এই সিদ্ধান্তের ফলে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বহু দশকব্যাপী সংঘাতের রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা দূরাহত হচ্ছে৷
কিন্তু ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য ইওয়াভ গালান্ট বলেছেন যে, ইসরায়েল ‘‘হামাসের সঙ্গে মুখোমুখি দ্বন্দ্ব কামনা করে না৷''
হামাস বর্তমানে গাজা স্ট্রিপ নিয়ন্ত্রণ করে৷ তারা ফিলিস্তিনি রাজ্যাঞ্চল থেকে উগ্রপন্থি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির কার্যকলাপ বরদাস্ত করে থাকে বলে ইতিপূর্বেও অভিযোগ শোনা গেছে৷
গাজাবাসীর ‘লাইফলাইন’ টানেল নেটওয়ার্ক
গাজায় ইসরায়েলের হামলার অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হচ্ছে টানেলের কথা, যেগুলো হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলে প্রবেশের জন্য ব্যবহার করছে৷ এগুলো ধ্বংস করতে চায় ইসরায়েল৷ তবে এসব টানেল অন্য অনেক কাজেও ব্যবহার হচ্ছে৷
ছবি: picture alliance/landov
‘লাইফলাইন’ এবং চোরাচালানের পথ
ফিলিস্তিনিরা টানেল বা সুড়ঙ্গগুলোকে তাদের লাইফলাইন মনে করে, যদিও ইসরায়েল এগুলোকে বিবেচনা করে অস্ত্র চোরাচালান এবং চোরাগোপ্তা হামলার পথ হিসেবে৷ চারপাশ থেকে আবদ্ধ গাজার সঙ্গে বিশ্বের সংযোগের অন্যতম পথ এসব টানেল৷ এগুলো ব্যবহার করে এমনকি পশুও গাজায় নেয়া হয়৷
ছবি: Getty Images
নিজেদের ভূমিতে কারাবন্দি
গাজায় প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষের বাস৷ প্রতিবেশী দেশ ইসরায়েল এবং মিশর থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে উঁচু দেয়াল দিয়ে৷ সীমান্ত চেকপোস্টগুলোতে রয়েছে কড়া পাহারা৷ একসময় মিশরের রাফা সীমান্ত ব্যবহার করে গাজার বাইরে যেতে পারতো ফিলিস্তিনিরা৷ কিন্তু ২০০৭ সালের জুনে হামাস গাজার ক্ষমতা নেয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছে সেই সীমান্তও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণকাজ
আর তখন থেকে গাজাবাসী বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে একমাত্র টানেল বা সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে৷ এগুলো অধিকাংশক্ষেত্রে তৈরি করা হয় অনিরাপদ এবং সাধাসিধে উপায়ে৷ নির্মাণকাজে ব্যবহার হয় বেলচা এবং কাঠ৷ তরুণ ফিলিস্তিনিদের জন্য অর্থ উপায়ের অল্প কিছু মাধ্যমের একটি এই সুড়ঙ্গ খনন৷ তবে এই কাজে মৃত্যু ঝুঁকিও আছে৷
ছবি: Getty Images
গোপন প্রবেশপথ
টানেলে প্রবেশের পথ অধিকাংশক্ষেত্রে সাধারণ বাসাবাড়ির মধ্যে থাকে৷ মূলত বাইরে থেকে যাতে বোঝা না যায়, সেজন্য এই ব্যবস্থা৷ যারা এসব টানেল ব্যবহার করতে চান, তাদের এজন্য টাকা খরচ করতে হয়৷ ইসরায়েল মনে করে, গাজাবাসী টানেল ব্যবহারের জন্য যে টাকা খরচ করেন, তা অন্যান্য চাহিদা মেটাতে আরো ভালো কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images
নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র আনার পথ
ফিলিস্তিনিরা এসব টানেল ব্যবহার করে নির্মাণকাজের জন্য সিমেন্ট এবং অন্যান্য উপাদান গাজায় আনেন৷ ঘরবাড়ি তৈরি কিংবা সংস্কারে এগুলো দরকার হয়৷ এছাড়া ভোগ্যপণ্য, কাপড় এমনকি রকেট এবং বিস্ফোরকও টানেল দিয়েই গাজায় আসে৷
ছবি: DW/T. Krämer
সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে
গত ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে গাজায় টানেল রয়েছে৷ ১৯৭৯ সালে ইসরায়েল এবং মিশরের মধ্যে শান্তি চুক্তির পর রাফা শহরটি বিভক্ত হয়ে যায়৷ এর অর্ধেক চলে যায় মিশরের দখলে বাকিটা গাজার৷ তখন থেকেই শহরটির দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগ এবং মালামাল পরিবহণের উপায় হয়ে ওঠে সুড়ঙ্গ পথ৷
ছবি: Getty Images
মিসাইল থেকে বাঁচার উপায়
এখন অনেক সাধারণ টানেলেও যোগাযোগের আধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে৷ বিশেষ করে বিদ্যুৎ এবং টেলিফোনের কথা বলা যায়৷ সুড়ঙ্গ খননের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা মাটির উপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন টেলিফোনের মাধ্যমে৷ আর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী যখন আক্রমণ করে, তখন অনেক ফিলিস্তিনি জীবন বাঁচাতে বা লুকিয়ে থাকতে টানেলে আশ্রয় নেন৷
ছবি: Getty Images
মিশরও ধ্বংস করছে সুড়ঙ্গ
শুধুমাত্র ইসরায়েলই গাজার সুরক্ষা নেটওয়ার্ক ধ্বংসের চেষ্টা করছে না৷ মিশরও এগুলোর বিরোধী৷ সেদেশের সিনাই উপত্যকায়ও হামাসের হামলার অভিযোগ রয়েছে৷ তাই মিশরের সেনারাও বছরের পর বছর তাদের ভূখণ্ডের নীচে থাকা টানেল ধ্বংসের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: DW/S.Al Farra
মাটির নীচে বিপদ
শুধুমাত্র ইসরায়েলি সেনাদের হত্যার উদ্দেশ্যেও অনেক সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছে৷ ২০০৪ সালে হামাসের প্রকাশিত এই ছবিতে কিছু বিস্ফোরক দেখানো হয়েছে যা ব্যবহার করে সেবছরের ডিসেম্বরে ইসরায়েলের একটি সেনা ঘাঁটির নীচে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল৷ এতে পাঁচ ইসরায়েলি সেনা নিহত এবং দশজন আহত হন৷
ছবি: Getty Images
সুড়ঙ্গে মন্ত্রী
গাজা থেকে ইসরায়েলে প্রবেশের জন্য তৈরি এই সুড়ঙ্গটি ২০১৩ সালে প্রদর্শন করেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোসা ইয়ালন৷ ইসরায়েলের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, হামেস এই টানেল দিয়ে ইসরায়েলে হামলা এবং ইসরায়েলিদের অপহরণ করেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আক্রমণ চলছেই
ইসরায়েল দাবি করেছে, গাজায় কয়েক ডজন টানেল ধ্বংসে সক্ষম হয়েছে তাদের সেনাবাহিনী৷ গত আট জুলাই থেকে গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল৷ এতে বুধবার (৩০.০৭.১৪) পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে বারোশ’র বেশি মানুষ, যাদের অধিকাংশই নিরীহ ফিলিস্তিনি৷