সোমবার গাজায় হিংসাত্মক ঘটনার নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্তের উদ্যোগ বানচাল করে দিলো মার্কিন প্রশাসন৷ গাজায় হামাস গোষ্ঠীকে দায়ী করেছে হোয়াইট হাউস৷ মঙ্গলবারও প্রতিবাদ-বিক্ষোভের আশঙ্কা রয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
গাজায় সোমবারের হিংসালীলার নিরপেক্ষ তদন্তের উদ্যোগ নিতে চেয়েছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ৷ কিন্তু অ্যামেরিকার আপত্তিতে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে৷ তবে মঙ্গলবারও নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবার কথা৷ মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসংঘের দূত নিকোলাই ম্লাদেনভ সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাবেন৷
সোমবার গাজা সীমান্তে ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলাকালীনইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে কমপক্ষে ৫৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও দুই হাজারেরও বেশি আহত হয়েছে৷ ২০১৪ সালের যুদ্ধের পর গাজায় এক দিনে এমন হিংসা দেখা যায়নি৷
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অনুমান, এ দিন প্রায় ৪০,০০০ ফিলিস্তিনি বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল৷ তাদের মধ্যে কিছু মানুষ পাথর ও বিস্ফোরক নিক্ষেপ করলে সৈন্যরাও পালটা পদক্ষেপ নেয় বলে সেনাবাহিনী দাবি করেছে৷ তাদের মতে, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে বন্দুকবাজদের তিনটি দলও মিশে ছিল৷ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, সৈন্যরা আত্মরক্ষায় গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল৷ তাঁর মতে, সব দেশেরই তার সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব রয়েছে৷
জেরুসালেম শহরে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের বিরুদ্ধে গত প্রায় ৬ সপ্তাহ ধরে সীমান্তে বিক্ষোভ চলছে৷ সোমবার দূতাবাস ভবন উদ্বোধনের দিন পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে৷ মঙ্গলবার ‘নকবা' বা বিপর্যয় দিবস উপলক্ষ্যে উত্তেজনা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ ৭০ বছর আগে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল সৃষ্টির সময়ে হাজার হাজার ফিলিস্তিনির ভিটেমাটি হারানাোর ঘটনার স্মৃতি জিইয়ে রাখতে প্রতি বছর এই দিনটি পালন করা হয়৷
শহরের পূর্বাংশের উপর ফিলিস্তিনিদের দাবি নস্যাৎ করে ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিকভাবে প্রবল সমালোচিত হয়েছে৷ তবে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র রাজ শাহ সোমবারের ঘটনায় ফিলিস্তিনি হামাস গোষ্ঠীকে ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের মৃত্যুর জন্য দায়ী করেন৷
অন্যদিকে হামাস নেতা মাহমুদ আল-জাহার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দায়ী করেন৷ ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ও সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করেছেন৷ ফিলিস্তিনি নেতা সায়েব এরেকাত বলেন, এই যুদ্ধাপরাধের অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত এবং আন্তর্জাতিক সমাজকে ফিলিস্তিনিদের আন্তর্জাতিক সুরক্ষার দায়িত্ব বহন করতে হবে৷
তুরস্ক ও দক্ষিণ আফ্রিকা সোমবারের হিংসার প্রতিবাদে ইসরায়েল থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতদের আপাতত প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক কর্মকর্তা ফেডেরিকা মোগেরিনি ‘আরও অবর্ণনীয় কষ্ট' এড়াতে সব পক্ষের উদ্দেশ্যে সংযমের ডাক দিয়েছেন৷ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর হিংসার তীব্র নিন্দা করেছেন৷ জার্মানিও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সব পক্ষের উদ্দেশ্যে সংযমের ডাক দিয়েছে৷
গাজার বিক্ষোভে ফিলিস্তিনি নারীদের ভূমিকা
বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতি জুম্মাবারে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি সীমান্তে প্রতিবাদ প্রদর্শন করে চলেছেন৷ সীমান্তে সংঘর্ষের ছবি মিডিয়া জুড়ে; অপরদিকে বেসামরিক, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও সমাবেশে প্রধানত পাওয়া যাবে ফিলিস্তিনি নারীদের৷
ছবি: Reuters/M. Salem
শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ
জুম্মাবারের প্রতিবাদ শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগে থেকেই তাঁবু খাটিয়ে বিক্ষোভ শিবির গড়া হয়েছিল৷ বিক্ষোভকারীরা এই পন্থায় গাজায় অসহনীয় মানবিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করতে চাইছিলেন৷ ৩০শে মার্চ ফিলিস্তিনিদের তথাকথিত ভূমি দিবসে সেই বিক্ষোভ গণআন্দোলনে পরিণত হয়৷ ঐ দিনটিতে ফিলিস্তিনিরা তাদের বিতাড়নের কথা স্মরণ করেন৷
ছবি: Reuters/M. Salem
বিক্ষোভ এক ধরনের উৎসব বৈকি
বিক্ষোভ শিবিরের অভ্যন্তরে নারীদের নানা কাজ৷ আন্দোলন শুরু হওয়া যাবৎ বেশ কয়েক শত ফিলিস্তিনি মহিলা ছেলে-মেয়ে সঙ্গে করে বিক্ষোভে যোগ দিতে আসছেন৷ তাঁদের মধ্যে অনেকে সীমান্তে সংঘাতপূর্ণ প্রতিবাদেও সামিল হন৷
ছবি: Reuters/S. Abo Elouf
শিল্পের স্থান সর্বত্র
ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পী রেহাম আল-এমাউয়ি মহিলা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ছবি আঁকেন৷ শিবিরে তাঁর মতো আরো অনেক শিল্পী আছেন৷ ইসরায়েল যে ফিলিস্তিনিদের প্রত্যাবর্তন করতে দিতে রাজি নয়, তার বিরুদ্ধে তাঁদের এই প্রতিবাদ৷ গাজা স্ট্রিপের বাসিন্দাদের ৭০ শতাংশ উদ্বাস্তু বা উদ্বাস্তুদের সন্তান-সন্ততি৷
ছবি: Reuters/S. Abo Elouf
সোশ্যাল মিডিয়াতে সক্রিয়
ফিলিস্তিনি নারীরা তাঁদের দুরবস্থার কথা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও জ্ঞাপন করেন – কেননা তাঁদের ঘিঞ্জি, দারিদ্র্যপূর্ণ গাজা স্ট্রিপ পরিত্যাগ করার কোনো উপায় নেই৷ ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় ৮০ শতাংশ ফিলিস্তিনি তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত হন অথবা পলায়ন করেন৷
ছবি: Reuters/S. Abo Elouf
শিবিরের জন্য রুটি তৈরি
ইসরায়েল উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তন করতে দিতে অরাজি৷ ১৯৯৩ সালের আন্তর্জাতিক আলাপ-আলোচনায় ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রস্তাবটিও বিবেচিত হয় – কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি৷ আজ পশ্চিম জর্ডান ও গাজা স্ট্রিপে দু’টি পৃথক ফিলিস্তিনি সরকার তাদের ঝগড়া-বিবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন, যার একটি ফল হলো দারিদ্র্য, বিশেষ করে গাজা স্ট্রিপে৷ তাই বিক্ষোভ শিবিরে নারীরা রুটি গড়ে বিতরণ করে থাকেন৷
ছবি: Reuters/S. Abo Elouf
বিক্ষোভকারীদের জন্য পানি
ইসরায়েলের সীমান্তে যাঁরা প্রতিবাদ প্রদর্শন করছেন, তাঁদের অধিকাংশ তরুণ ফিলিস্তিনি, যাঁদের ভবিষ্যতের কোনো আশা নেই৷ ইসরায়েল ও পশ্চিমি মিডিয়া এই প্রতিবাদের জন্য হামাসকে দায়ী করে থাকে – অপরদিকে হামাস সীমান্তে ইসরায়েলি সৈন্যদের সহিংসতার কথা বলে৷ যার ফলে সীমান্তে বিক্ষোভ দু’পক্ষের কট্টরপন্থিদের হাতে প্রচারণার অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
ছবি: Reuters/S. Abo Elouf
আহতদের পরিচর্যা
প্রতিবাদ শুরু হওয়া যাবৎ সীমান্তে বেশ কিছু ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন, শত শত ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন৷ গাজা স্ট্রিপে জনস্বাস্থ্যগত কাঠামো ভেঙে পড়তে চলেছে, হাসপাতালগুলি আহতদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে৷ ওষুধপত্র, বিদ্যুৎ বা বিশুদ্ধ পানি, সব কিছুর অভাব৷ স্বেচ্ছাসেবী মহিলারা ইসরায়েলি সৈন্যদের নিক্ষিপ্ত কাঁদানে গ্যাসে আহত ফিলিস্তিনিদের পরিচর্যা করছেন৷
ছবি: Reuters/S. Abo Elouf
ভূমিকা বদল?
প্রতিবাদ যেখানে সংঘর্ষের রূপ নিচ্ছে, সেখানেও ফিলিস্তিনি মহিলাদের পাওয়া যাবে৷ ১৮ বছর বয়সের তরুণী আয়া আবেইদ রয়টার্স সংবাদসংস্থাকে বলেছেন, ‘‘কেউ কেউ আমাদের বলেন: পুরুষরা যা করে, তা তোমরা করতে পারো না! অনেকের ভয় যে, আমরা আহত হতে পারি৷ অন্যরা আবার আমাদের একসঙ্গে লড়ার উৎসাহ দেন৷’’
ছবি: Reuters/M. Salem
রণাঙ্গণে
আন্দোলনের নাম ‘প্রত্যাবর্তনের জন্য মহান অভিযান’৷ আন্দোলন চলবে আগামী ১৫ই মে ইসরায়েলের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অবধি৷ একইভাবে ফিলিস্তিনিরা ‘নকবা’ বা স্বদেশ থেকে তাঁদের বিতাড়নের কথা স্মরণ করছেন: ওয়ার্কশপ বা থিয়েচারের সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির টায়ার পোড়ানো বা পাথর ছোঁড়াতেও ফিলিস্তিনি মহিলারা সামিল৷