গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে নতুন করে তিন দিনের যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে৷ ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার পর উভয়পক্ষ নতুন যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়৷ এখনও পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি৷
বিজ্ঞাপন
এর আগেও মিশরের মধ্যস্থতায় তিন দিনের যুদ্ধবিরতি হয়েছিল, কিন্তু শুক্রবার সকালে বিরতি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুই পক্ষ লড়াই শুরু করে দেয়৷ গাজা থেকে চালানো জঙ্গি হামলা বন্ধ করার কথা বলে ৮ জুলাই থেকে ভূখণ্ডটিতে বিমান হামলার মাধ্যমে অভিযান শুরু করে ইসরায়েল৷ পরে শুরু হয় স্থল অভিযান৷ একমাসেরও বেশি সময় ধরে চলা এ লড়াইয়ে অন্তত দুই হাজার মানুষ নিহত হন৷
আহত-নিহতের সংখ্যা
নিহতদের মধ্যে ১৯৩৫ জন ফিলিস্তিনি বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ৷ এঁদের মধ্যে অন্তত ১৪০৮ জন বেসামরিক, তাঁদের মধ্যে আবার ৪৪৯ জন শিশু, ২৪৩ জন নারী ও ৮৭ জন প্রবীণ রয়েছেন৷ অন্যদিকে ইসরায়েলি পক্ষে ৬৭ জন নিহত হয়েছেন, যাঁদের ৬৪ জন সেনা সদস্য, বাকি তিনজন বেসামরিক৷ এই বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে একজন থাই নাগরিক রয়েছেন৷ এছাড়া আহত অন্তত ১০,০০০৷ শুক্রবার যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ২০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং হামাসের মর্টার হামলায় দুই ইসরায়েলি আহত হয়েছেন৷
গাজাবাসীর ‘লাইফলাইন’ টানেল নেটওয়ার্ক
গাজায় ইসরায়েলের হামলার অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হচ্ছে টানেলের কথা, যেগুলো হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলে প্রবেশের জন্য ব্যবহার করছে৷ এগুলো ধ্বংস করতে চায় ইসরায়েল৷ তবে এসব টানেল অন্য অনেক কাজেও ব্যবহার হচ্ছে৷
ছবি: picture alliance/landov
‘লাইফলাইন’ এবং চোরাচালানের পথ
ফিলিস্তিনিরা টানেল বা সুড়ঙ্গগুলোকে তাদের লাইফলাইন মনে করে, যদিও ইসরায়েল এগুলোকে বিবেচনা করে অস্ত্র চোরাচালান এবং চোরাগোপ্তা হামলার পথ হিসেবে৷ চারপাশ থেকে আবদ্ধ গাজার সঙ্গে বিশ্বের সংযোগের অন্যতম পথ এসব টানেল৷ এগুলো ব্যবহার করে এমনকি পশুও গাজায় নেয়া হয়৷
ছবি: Getty Images
নিজেদের ভূমিতে কারাবন্দি
গাজায় প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষের বাস৷ প্রতিবেশী দেশ ইসরায়েল এবং মিশর থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে উঁচু দেয়াল দিয়ে৷ সীমান্ত চেকপোস্টগুলোতে রয়েছে কড়া পাহারা৷ একসময় মিশরের রাফা সীমান্ত ব্যবহার করে গাজার বাইরে যেতে পারতো ফিলিস্তিনিরা৷ কিন্তু ২০০৭ সালের জুনে হামাস গাজার ক্ষমতা নেয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছে সেই সীমান্তও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণকাজ
আর তখন থেকে গাজাবাসী বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে একমাত্র টানেল বা সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে৷ এগুলো অধিকাংশক্ষেত্রে তৈরি করা হয় অনিরাপদ এবং সাধাসিধে উপায়ে৷ নির্মাণকাজে ব্যবহার হয় বেলচা এবং কাঠ৷ তরুণ ফিলিস্তিনিদের জন্য অর্থ উপায়ের অল্প কিছু মাধ্যমের একটি এই সুড়ঙ্গ খনন৷ তবে এই কাজে মৃত্যু ঝুঁকিও আছে৷
ছবি: Getty Images
গোপন প্রবেশপথ
টানেলে প্রবেশের পথ অধিকাংশক্ষেত্রে সাধারণ বাসাবাড়ির মধ্যে থাকে৷ মূলত বাইরে থেকে যাতে বোঝা না যায়, সেজন্য এই ব্যবস্থা৷ যারা এসব টানেল ব্যবহার করতে চান, তাদের এজন্য টাকা খরচ করতে হয়৷ ইসরায়েল মনে করে, গাজাবাসী টানেল ব্যবহারের জন্য যে টাকা খরচ করেন, তা অন্যান্য চাহিদা মেটাতে আরো ভালো কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images
নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র আনার পথ
ফিলিস্তিনিরা এসব টানেল ব্যবহার করে নির্মাণকাজের জন্য সিমেন্ট এবং অন্যান্য উপাদান গাজায় আনেন৷ ঘরবাড়ি তৈরি কিংবা সংস্কারে এগুলো দরকার হয়৷ এছাড়া ভোগ্যপণ্য, কাপড় এমনকি রকেট এবং বিস্ফোরকও টানেল দিয়েই গাজায় আসে৷
ছবি: DW/T. Krämer
সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে
গত ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে গাজায় টানেল রয়েছে৷ ১৯৭৯ সালে ইসরায়েল এবং মিশরের মধ্যে শান্তি চুক্তির পর রাফা শহরটি বিভক্ত হয়ে যায়৷ এর অর্ধেক চলে যায় মিশরের দখলে বাকিটা গাজার৷ তখন থেকেই শহরটির দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগ এবং মালামাল পরিবহণের উপায় হয়ে ওঠে সুড়ঙ্গ পথ৷
ছবি: Getty Images
মিসাইল থেকে বাঁচার উপায়
এখন অনেক সাধারণ টানেলেও যোগাযোগের আধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে৷ বিশেষ করে বিদ্যুৎ এবং টেলিফোনের কথা বলা যায়৷ সুড়ঙ্গ খননের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা মাটির উপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন টেলিফোনের মাধ্যমে৷ আর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী যখন আক্রমণ করে, তখন অনেক ফিলিস্তিনি জীবন বাঁচাতে বা লুকিয়ে থাকতে টানেলে আশ্রয় নেন৷
ছবি: Getty Images
মিশরও ধ্বংস করছে সুড়ঙ্গ
শুধুমাত্র ইসরায়েলই গাজার সুরক্ষা নেটওয়ার্ক ধ্বংসের চেষ্টা করছে না৷ মিশরও এগুলোর বিরোধী৷ সেদেশের সিনাই উপত্যকায়ও হামাসের হামলার অভিযোগ রয়েছে৷ তাই মিশরের সেনারাও বছরের পর বছর তাদের ভূখণ্ডের নীচে থাকা টানেল ধ্বংসের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: DW/S.Al Farra
মাটির নীচে বিপদ
শুধুমাত্র ইসরায়েলি সেনাদের হত্যার উদ্দেশ্যেও অনেক সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছে৷ ২০০৪ সালে হামাসের প্রকাশিত এই ছবিতে কিছু বিস্ফোরক দেখানো হয়েছে যা ব্যবহার করে সেবছরের ডিসেম্বরে ইসরায়েলের একটি সেনা ঘাঁটির নীচে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল৷ এতে পাঁচ ইসরায়েলি সেনা নিহত এবং দশজন আহত হন৷
ছবি: Getty Images
সুড়ঙ্গে মন্ত্রী
গাজা থেকে ইসরায়েলে প্রবেশের জন্য তৈরি এই সুড়ঙ্গটি ২০১৩ সালে প্রদর্শন করেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোসা ইয়ালন৷ ইসরায়েলের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, হামেস এই টানেল দিয়ে ইসরায়েলে হামলা এবং ইসরায়েলিদের অপহরণ করেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আক্রমণ চলছেই
ইসরায়েল দাবি করেছে, গাজায় কয়েক ডজন টানেল ধ্বংসে সক্ষম হয়েছে তাদের সেনাবাহিনী৷ গত আট জুলাই থেকে গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল৷ এতে বুধবার (৩০.০৭.১৪) পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে বারোশ’র বেশি মানুষ, যাদের অধিকাংশই নিরীহ ফিলিস্তিনি৷
ছবি: picture alliance/landov
11 ছবি1 | 11
কায়রোতে আলোচনা
ইসরায়েল গাজা যুদ্ধ বন্ধে সোমবার মিশরের রাজধানী কায়রোতে আরো আলোচনার জন্য প্রতিনিধিরা যেতে শুরু করেছেন৷ ইসরায়েলি এক কর্তৃপক্ষ বলেছেন, ‘‘এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনি গেরিলাদের সাথে চলা এই যুদ্ধ বন্ধে আলোচনায় বসবে তারা৷'' ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, রবিবার স্থানীয় সময় রাত ৯টায় যুদ্ধবিরতি কার্যকরের কিছুক্ষণ আগে তেল আভিভে একটি রকেট হামলা হয়৷ অন্যদিকে হামাসও স্বীকার করেছে রোববার রাতে তারা একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল৷
হামাসের এক কর্মকর্তাও জানিয়েছেন যে, তারা কায়রোর আমন্ত্রণ সমর্থন করেছে এবং আলোচনার জন্য সেখানে উপস্থিত থাকবে৷ তবে হামাসের প্রধান দাবি, গাজার উপর থেকে ইসরায়েলের অবরোধ তুলে নিতে হবে৷ এর ফলেই ফিলিস্তিনিদের জীবনে প্রকৃত শান্তি আসবে বলে জানিয়েছে তারা৷ ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রীও বলেছেন, কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছে তারা৷
স্বাভাবিক জীবন
সোমবার সকাল থেকে নিজেদের বাড়ি-ঘরের অবস্থা দেখতে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ছুটে গেছেন গাজার মানুষ৷ স্থানীয় এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘ঈশ্বরই জানেন এ যুদ্ধ কবে শেষ হবে৷ এটাকে ইদুঁর-বিড়াল লড়াই হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি, যা কখনো শেষ হবার নয়৷''
গাজা কিশোরীর জনপ্রিয়তা
গাজায় যখন অবিরাম ইসরায়েলি বোমা হামলা চলছে, তখন সেখানকার এক কিশোরী ফারাহ বাকের নিজের স্মার্টফোন ব্যবহার করে সেই বিধ্বংসী ছবি ও ভিডিও ধারণ করে টুইটারে পোস্ট করছেন৷ এর মাধ্যমেই ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন তিনি৷
১৬ বছর বয়সি এই কিশোরী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়৷ যেখানে তার ফলোয়ার বা বন্ধু সংখ্যা ছিল মাত্র ৮০০, সেখানে এখন তার অনুসরণকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার৷ সে বর্তমানে গাজা সিটির শিফা হাসপাতালে অবস্থান করছে৷ তার বাবা একজন মেডিকেল সার্জন৷ সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফারাহ বলেন, ‘‘আমি বিশ্বকে জানাতে চাই কি পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আছি আর এখানে আসলেই কি ঘটছে৷'' তার অ্যাকাউন্ট @Farah_Gazan৷