গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় শুক্রবার থেকে মসজিদগুলো স্বাভাবিকভাবে খুলে দেয়ার ঘোষণা কার্যকর হবে না বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী এম আব্দুল্লাহ৷
ছবি: Rayhanul Isalm Akhanda
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেছেন, ‘‘গাজীপুরের মেয়র সরকারের আদেশ অমান্য করেছেন৷ তিনি আমাদের ফোন ধরছেন না৷ আমরা প্রশাসনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিচ্ছি৷’’
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ‘‘ওনার ঘোষণায় কিছু আসে যায় না৷ এই ঘোষণা দেয়ার কোনো এখতিয়ার মেয়রের নেই৷’’
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম মঙ্গলবার এক ভিডিও বার্তায় সামাজিক দূরত্ব মেনে নগরের মসজিদগুলোতে শুক্রবার থেকে নামাজ পড়ার ঘোষণা দেন৷
বুধবার ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য জানিয়ে তার বর্তমান সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে মেয়র বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাইডলাইন ফলো করে আমরা মসজিদে নামাজ পড়ার সুযোগ দেবো৷’’ এরপর তিনি আর কোনো কথা না বলে ফোন লাইন কেটে দেন৷ তারপর বারবার চেষ্টা করেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি৷
করোনা প্রতিরোধে সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী সাধারণ নামাজে ৫ জন, জুমার নামাজে ১০ জন এবং তারাবির নামাজে ১২ জনের বেশি অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়৷ ধর্মমন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত দেশের সব মসজিদ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে৷
তাঁর ঘোষণায় সরকার ক্ষুব্ধ: ধর্ম প্রতিমন্ত্রী
This browser does not support the audio element.
বুধবার টেলিফোনে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘গাজীপুরের মেয়র যে ঘোষণা দিয়েছেন তা সরকারের নির্দেশনার বিরুদ্ধে যায়৷ তার সঙ্গে ওই ঘোষণার পর আমরা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি৷ তিনি আমাদের ফোন ধরছেন না৷ আমরা গাজীপুরের প্রশাসন এবং পুলিশকে বলে দিয়েছি৷ এখন তারাই ব্যবস্থা নেবেন৷ কোনোভাবে গাজীপুরের মেয়রের মসজিদ খুলে দেয়ার ঘোষণা কার্যকর হবে না৷ তার ঘোষণায় সরকার ক্ষুব্ধ৷ সরকারের নির্দেশের বাইরে কিছু হওয়ার সুযোগ নেই৷ মেয়র নিজেই আরেকটি ঘোষণা দিয়ে মসজিদ খুলে দেয়ার ঘোষণা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবেন৷’’
এদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আনিস মাহমুদও গাজীপুর জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগের কথা জানিয়ে বলেন, ‘‘সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মসজিদ স্বাভাবিকভাবে নামাজ পড়ার জন্য খুলে দেয়ার সুযোগ নেই৷ মেয়র সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়েছেন৷ সরকারের সিদ্ধান্তই বহাল থাকবে৷’’
এর আগে মঙ্গলবার রাতে ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে গাজীপুরের মেয়র বলেন, ‘‘পোশাক কারখানা যেহেতু খুলে দেয়া হয়েছে তাই আমি মসজিদও খুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছি৷ আমার এলাকায় কোনো করোনা আক্রান্ত নেই৷ তাহলে মসসিদে নামাজ পড়া বন্ধ থাকবে কেন? রমজানের সময় সবার মসজিদে নামাজ পড়তে দেয়ার সুযোগ থাকা উচিত৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘মসজিদে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নামাজ পড়া হবে৷ মসজিদের বাইরে কেউ নামাজ পড়তে পারবেন না৷ এক এলাকার লোক অন্য এলাকার মসজিদে নামাজ পড়তে পারবেন না৷’’
রমজানের সময় সবাইকে মসজিদে নামাজ পড়তে দেয়ার সুযোগ থাকা উচিত: মেয়র
This browser does not support the audio element.
তবে বুধবার গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম সরবারের নির্দেশনা পাওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, ‘‘শুক্রবার যাতে স্বাভাবিক নামাজের জন্য মসজিদ খোলা না হয় সে ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নেবো৷ সরকারের যে নির্দেশনা তা বহাল রাখতে আমরা সবকিছু করবো৷’’
এ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো বক্তব্য জানা যায়নি৷
তবে গাজীপুরের মেয়রের মসজিদ খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তকে হঠকারী এবং অবিবেচনাপ্রসূত বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-র মহাসচিব অধ্যাপপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী৷ তিনি একইসঙ্গে পোশাক কারখানা খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তেরও বিরোধিতা করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘গাজীপুরের মেয়র না বুঝে অথবা রাজনৈকিভাবে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগোনোর জন্য মসজিদ খুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন৷ এটা হলে ভয়াবহ বিপর্যয় হবে৷ তিনি জানেন না যে, তার এলাকায় করোনা আক্রান্ত কেউ আছেন কিনা৷ কারণ, উপসর্গ ছাড়াই অনেক করোনায় আক্রান্ত আছেন৷ তাদের একজনও যদি মসজিদে যান তাহলে সবার মধ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ আর সাধারণ মাস্ক পরে বা কথিত সামাজিক দূরত্ব মেনে সব সময় করোনা প্রতিরোধ করা যায় না৷ যারা মসজিদে নামাজ পড়তে যাবেন, তারা এটা কিভাবে মানবেন! তখন তো প্রতিযোগিতা তৈরি হবে৷ আর এক এলাকার মসজিদ খুলে দিলে সারাদেশে এর প্রভাব পড়বে৷ সবাই ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লগিয়ে মসজিদ খুলে দিতে চাইবে৷’’
পোশাক কারখানা খুলে দেয়াকেও তিনি অবিবেচনাপ্রসূত মনে করেন৷ তার কথা. ‘‘যদি খুলতেই হতো, তাহলে পোশাক শ্রকিদের সবাইকে প্রথমে ১৪ দিনের কোয়ারান্টিনে রাখতে হতো৷ তারপর যারা আক্রান্ত নন তাদের কারখানার ভিতরে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঢুকতে দিতে হতো৷ কিন্তু তা করা হয়নি৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এরইমধ্যে আমরা কয়েকজন পোশাক শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত বলে খবর পেয়েছি৷ একজন তো টেস্ট দিয়ে কারখানায় চলে গেছেন৷ এখন জানা গেছে, তার করোনা পজিটিভ৷ এই পরিস্থিতিতে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে এখন করেনা ছড়ানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে৷’’
প্রসঙ্গত, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে মোট আটটি থানা এলাকায় সরকারি হিসেবে ৬৭৫টি মসজিদ আছে৷
করোনায় রোজা, করণীয় কী?
মুসলিমদের সবচেয়ে পবিত্র মাস রমজান এসেছে৷ কিন্তু করোনা মহামারি এবারের রমজানকে দিয়েছে অন্য এক রূপ৷ নিজে ও প্রিয়জনকে নিরাপদে রেখে কিভাবে পালন করা যাবে এ মাস?
ছবি: DW/H. Ur Rashid Swapan
করোনাকালে রমজান, কিছু পরামর্শ
রমজান মাসকে বিশ্বজুড়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা দেখে থাকেন দানশীলতা, সংযম, আত্মশুদ্ধি ও প্রার্থনার মাস হিসেবে৷ একসঙ্গে নামাজ পড়া ও সারাদিনের রোজা শেষে ইফতার ভাগাভাগি করে নেয়াকেও দেয়া হয় গুরুত্ব৷ কিন্তু চলমান করোনা মহামারি এবারের রমজানকে সবার সামনে হাজির করেছে একটু অন্যভাবে৷ সব দেশের জন্যই এ বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid Swapan
রোজা রাখতে ঝুঁকি নেই
রোজা রাখলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে, এমন কোনো তথ্য এখনও কোনো গবেষণায় পাওয়া যায়নি৷ ফলে স্বাভাবিক সময়ের মতোই রোজা রাখতে সুস্থ মানুষের কোনো বাধা নেই৷ কিন্তু ধর্মীয় বিধি অনুযায়ীও নানা রোগের ক্ষেত্রে রোজা রাখায় ছাড় দেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ কেউ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ সেক্ষেত্রে চিকিৎসক ও ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid Swapan
পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত পানি
কোভিড-১৯ এর কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কার হয়নি৷ ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপরই এখন পর্যন্ত ভরসা৷ তাই সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতার ও সেহরিতে নানা ধরনের সুষম খাবারের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে৷ এছাড়া গরমের ফলে পানিশূন্যতা দূর করতে ইফতার ও সেহরির মধ্যে পর্যাপ্ত পানিও পান করা খুব জরুরি৷
ছবি: Colourbox/Haivoronska_Y
শারীরিক কার্যক্রমে জোর
অন্যসময় রোজা রেখেও কাজকর্ম করার ফলে শরীরে রক্ত চলাচল ও অন্যান্য কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকতো৷ কিন্তু করোনার কারণে মানুষের চলাচল সীমিত হওয়ায় কমেছে শারীরিক কার্যক্রমও৷ এজন্য বিজ্ঞানীরা জোর দিচ্ছেন বাসার মধ্য়েই নিয়মিত হালকা ব্যায়াম বা হাঁটাচলা করার জন্য৷ তা না হলে রোজায় শরীরে পড়তে পারে বিরূপ প্রভাব৷
ছবি: Colourbox
শুভেচ্ছা ও সম্ভাষণ
কারো সঙ্গে দেখা হলে হাত মেলানোর রীতি থাকলেও, এবার শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সম্ভাষণ জানানোর ওপর জোর দেয়া হচ্ছে৷ অনেক দেশে ধর্মীয় আচার ও সংস্কৃতি অনুযায়ী সালাম দেয়া, মাথা নাড়া বা বুকে হাত দিয়ে সম্ভাষণ জানানো হয়৷ এ বছর করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে এমন সম্ভাষণকেই স্বাগত জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরাও৷
ছবি: DW/A. Ansari
ঝুঁকিতে থাকাদের বিশেষ ব্যবস্থা
নভেল করোনা ভাইরাস সব বয়সের মানুষকে আক্রান্ত করলেও সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরা৷ এছাড়া যারা ডায়বেটিস, রক্তচাপ, হৃদযন্ত্রের রোগ, শ্বাসকষ্ট ও ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য রোগে ভুগছেন, তারাও রয়েছেন কোভিড-১৯ এ সবচেয়ে ঝুঁকিতে৷ ফলে রমজানের সময়টাতে এই ব্যক্তিদের সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
সামাজিক দূরত্ব
বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও তারাবিসহ অন্যান্য নামাজ মসজিদের বদলে বাসায় পড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে৷ কিন্তু তারপরও ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিনসহ যাদের মসজিদে যেতেই হবে, তাদেরও নিজেদের মধ্যে অন্তত এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে৷ এছাড়া ইফতার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাকাটার জন্য যারা দোকানে বা বাজারে যাবেন, তাদেরও ভিড় এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid Swapan
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
প্রতিবার নামাজের আগে ওজুর ফলে এমনিতেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত হয়৷ কিন্তু এবার একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলছেন চিকিৎসকেরা৷ শুধু পানির বদলে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে সাবান ব্যবহারের৷ মসজিদেও পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্নতা সরঞ্জাম, টিস্যু, ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিন রাখার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে৷ পাশাপাশি প্রতিবার নামাজের আগে-পরে কার্পেটসহ মসজিদ ভবনের অন্যান্য ব্যবহার্য বস্তু পরিষ্কার করারও আহ্বান জানানো হচ্ছে৷
ছবি: Imago Images/allover-mev
যাকাত ও সদকা
রমজান মাসে মুসলিমদের দানশীলতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়৷ তবে যাকাত বা সদকা দেয়ার সময়ও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে৷ যাতে একসঙ্গে বেশি মানুষ জড়ো না হন, সেজন্য এলাকার সবাই মিলে বা কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শৃঙ্খলাবদ্ধ উপায়ে পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: DW/H.U.R. Swapan
মানসিক স্বাস্থ্য
লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব ইত্যাদি মানতে গিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য পড়ছে হুমকির মুখে৷ রমজানে ধর্মপ্রাণ মানুষ মসজিদে যেতে ও সামাজিক যোগাযোগ বেশি পছন্দ করেন৷ কিন্তু এ বছর তাদেরকে থাকতে হচ্ছে কড়া বিধিনিষেধের মধ্যে৷ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও যে আত্মশুদ্ধি, প্রার্থনা, দান, সেবা, সবই করা সম্ভব তা প্রচার করার জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারে পাশাপাশি ধর্মীয় নেতাদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷