অত্যাধুনিক মডেলের গাড়ি দেখে অনেকেই মুগ্ধ হয়৷ গাড়ির নিজস্ব গুণাগুণের পাশাপাশি গাড়ির টায়ারের বৈশিষ্ট্যও অত্যন্ত জরুরি৷ জার্মানির এক বিশেষজ্ঞ তাঁর জ্ঞান ও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজে লাগিয়ে এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখছেন৷
বিজ্ঞাপন
গাড়ির টায়ার কতটা মজবুত, তা পরীক্ষা করা হয়৷ পরীক্ষার সময় পেশাদারি চালকরা চাকার সহ্যশক্তির সীমা পরখ করেন৷ এমন চরম অবস্থায় টায়ারের প্রতিক্রিয়া জানা প্রয়োজন৷ ওলে ইয়ানসন অন্যতম বিশেষজ্ঞ চালক৷ তাঁর মূল্যায়নের ভিত্তিতে স্থির হয়, নতুন কোন টায়ার বড় আকারে উৎপাদন করা হবে৷ গাড়ি চালানোর আদর্শ অনুভূতি সম্পর্কে তাঁর যেন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় রয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘টায়ারগুলির মধ্যে তফাত বুঝতে এক ধরনের বিশেষ সংবেদনশীলতা থাকা প্রয়োজন৷ পার্থক্য বের করতে অনেকগুলি টায়ারের তুলনা করা হয়৷ অনুভূতি অনুযায়ী আমরা কাজ করি৷’’
নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের উপর পুরোপুরি আস্থা আছে তাঁর৷ বাঁক নেবার সময় কেঁপে গেলে, জল বা বরফের উপর পিছলে গেলে অথবা টায়ারের শব্দ শুনলে সব কিছু মনে রাখতে হয়৷ নিখুঁত পরিমাপ যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষার পাশাপাশি গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতার মূল্যায়নও অত্যন্ত জরুরি৷ হাইটেক সেন্সর ভেজা রাস্তায় ব্রেক করার সময় টায়ারের প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করে৷ আদর্শ ‘ট্রিড’ থাকলে তবেই পিছলে যাবার আশঙ্কা কমবে৷ তবে গাড়ি চালানোর অনুভূতি বোঝার ক্ষেত্রে ওলে ইয়ানসন-এর মতো বিশেষজ্ঞ চালকের তুলনা নেই৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা অবশ্যই আমাদের শরীর, মন দিয়ে অনুভব করি৷ গাড়িতে বসে শরীরের বিভিন্ন অংশের স্পর্শ টের পাই৷ বিশেষ করে সিটে বসার পর৷ অর্থাৎ গোটা শরীর দিয়েই অনুভূতি আসে৷’’
জার্মানরা আজও যে সব গাড়ি নিয়ে পাগল...
এই সব মডেলের গাড়ি দেখে গাড়ি প্রেমিকদের চোখে আজও জল আসে৷ ফল্কসভাগেন থেকে বিএমডাব্লিউ, ওপেল থেকে মার্সিডিজ বেঞ্জ অবধি জার্মান গাড়ি নির্মাতারা নানা ‘কাল্ট মডেল’ তৈরি করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Kneffel
ফল্কসভাগেন বিটল (১৯৩৮)
এক কথায় ‘ওল্ড ফেইথফুল’৷ সর্বসাকুল্যে দু’কোটি দশ লাখের বেশি বিটল তৈরি হয়েছে৷ ফল্কসভাগেন বিটল সম্ভবত বিশ্বের প্রখ্যাততম মোটরগাড়ি৷ ১৯৩৮ থেকে ২০০৩ সাল অবধি বিটল-এর ডিজাইন বিশেষ বদলায়নি৷ ‘হার্বি’ ফিল্মটার কথা মনে করুন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফল্কসভাগেন টি-ওয়ান (১৯৫০)
...বলতে বোঝায় ফল্কসভাগেন ক্যাম্পার ভ্যান, যা হিপি আন্দোলনের সময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল৷ জার্মানরা এর নাম দিয়েছিলেন ‘বুলি’৷ সে-যাবৎ এক কোটির বেশি ফল্কসভাগেন বাস বিক্রি হয়েছে, যার মধ্যে টি-ওয়ান মডেলের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮ লাখ৷
ছবি: DW/M. Reitz
মেসারস্মিট কেবিন স্কুটার (১৯৫৩)
মেসারস্মিট যে আদতে এয়ারোপ্লেন তৈরি করত, তিন চাকার এই এয়ায়োডাইনামিক গাড়িটির চেহারা দেখলেই তা বোঝা যায়৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিমান তৈরি বন্ধ হয়ে যায়, কাজেই মেসারস্মিট কিছুদিন ইঞ্জিনিয়ার ফ্রিটৎস ফেন্ড-এর সঙ্গে ‘ফ্লিটৎসার’ গাড়ির মডেলটি নিয়ে কাজ করে৷ তবে ১৯৫৬ সালের মধ্যেই মেসারস্মিট আবার বিমান উৎপাদনে ফেরে৷
ছবি: picture alliance/dpa/H. Galuschka
মার্সিডিজ ৩০০ এসএল (১৯৫৪)
গাড়িটার ডাকনাম হয়েছিল ‘গালউইং’ বা ‘গাঙচিলের পাখা’, কারণ দরজাগুলো ঠিক সেভাবেই ওপরের দিকে খুলত৷ ৩০০ এসএল সিলভার অ্যারো রেসিং কার-গুলো থেকেই মার্সিডিজ বেঞ্জ আবার মোটর রেসিং-এ ফেরে৷ লে মান্সের ২৪ ঘণ্টার মোটর দৌড় আর ক্যারেরা প্যানঅ্যামেরিকানা রেসিং ইভেন্টে জেতার পর ৩০০ এসএল গাড়ির একটি রাস্তায় চলা ও চালানোর মতো মডেল বার করা হয়৷
ছবি: Daimler AG
বিএমডাব্লিউ ইসেটা (১৯৫৫)
১৯৫৫ থেকে ১৯৬২ সাল অবধি ভালোই রোজগার করেছে বিএমডাব্লিউ এই ‘বাবল কার’ বা ‘বুদবুদ গাড়ি’-টি তৈরি করে৷ সস্তার কিন্তু কাজের এই মিনিগাড়িটিতে একটি মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন লাগানো ছিল৷ খুলতে হতো সামনে, ঠিক একটা ফ্রিজিডেয়ারের মতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Kneffel
পোর্শে নাইন-ইলেভেন (১৯৬৩)
ভাবলেই আশ্চর্য লাগে, পোর্শে ৯১১ স্পোর্টিং মডেলটি চলে আসছে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে! মোটরগাড়ির ইতিহাসে খুব কম মডেলই এতদিন ধরে চলে৷ তার উঁচু করা হেডলাইট আর পিছনদিকে নীচু বুট দেখলেই নাইন ইলেভেনকে চেনা যায়৷
ছবি: picture-alliance//HIP
মার্সিডিজ বেঞ্জ ৬০০ (১৯৬৪)
টেলিফোন, এয়ার কন্ডিশনিং আর ফ্রিজ লাগানো এই জার্মান লাক্সারি সেডানটি সত্তর আর আশির দশকে পোপ থেকে শুরু করে জন লেনন অবধি সেলিব্রিটিদের খুব প্রিয় ছিল৷ এমনকি ১৯৫৫ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যখন রাষ্ট্রীয় সফরে জার্মানিতে আসেন, তখন জার্মান সরকার মাননীয় অতিথির জন্য একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ ৬০০ ভাড়া করেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ট্রাবান্ট ৬০১ (১৯৬৪)
ফল্কসভাগেন বিটল পশ্চিম জার্মানিতে যা ছিল, পূর্ব জার্মানিতে ট্রাবান্ট ৬০১ ছিল ঠিক তাই৷ প্লাস্টিকের বডি আর টু-স্ট্রোক ইঞ্জিন সংযুক্ত এই ‘ট্রাবি’ ছিল এক হিসেবে পূর্ব জার্মানির প্রতীক৷ আজও প্রায় ৩৩,০০০ ‘ট্রাবি’ জার্মানির পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷
ছবি: Imago/Sven Simon
ভার্টবুর্গ ৩৫৩ (১৯৬৬)
আইসেনাখ শহরের কাছে ভার্টবুর্গ দুর্গ, তারই নামে নাম রাখা হয়েছিল পূর্ব জার্মানির এই দ্বিতীয় আইকনিক গাড়িটির৷ তৈরি হতো প্রধানত রপ্তানির জন্য, যেমন হাঙ্গেরি অথবা ব্রিটেনে৷ তবে পশ্চিম জার্মানিতে ভার্টবুর্গ গাড়ির বিশেষ চাহিদা ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/ZB/J. Wolf
ওপেল মান্টা (১৯৭০)
সৃষ্টি হয়েছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য একটি স্পোর্টস মডেল হিসেবে – পরে সেটাই জার্মানির ‘ইয়ং ম্যান’-দের কাছে অভীপ্স বস্তু হয়ে দাঁড়ায়৷ মান্টা চালকদের নিয়ে জার্মানিতে অসংখ্য রসিকতা আছে: বিশেষ করে মান্টা চালকদের বুদ্ধি – অথবা তার অভাব নিয়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফল্কসভাগেন গল্ফ (১৯৭৪)
১৯৭৪ সালে ফল্কসভাগেন কোম্পানি তাদের প্রথম গল্ফ মডেল বার করে – সুবিখ্যাত বিটল গাড়ির উত্তরসূরি হিসেবে৷ কমপ্যাক্ট হলেও, গল্ফ ছিল বেশ ‘স্পোর্টি’ আর তেলও খেতো কম – যা সত্তরের দশকের ‘অয়েল ক্রাইসিসে’ খুবই কাজে লেগেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
11 ছবি1 | 11
আদর্শ টায়ারের রহস্য লুকিয়ে রয়েছে ট্রিড-এর মধ্যে৷ ব্রেক করার সময় টায়ার যেন রাস্তা কামড়ে ধরে এবং দ্রুত গতির সময় যেন যতটা সম্ভব কম ঘর্ষণ হয়৷ প্রথমে হাতে করে পরিকল্পিত টায়ারের প্রোটোটাইপ তৈরি করা হয়৷ ইঞ্জিনিয়ার ড. হল্গার লাঙেবলেন, ‘‘হাতে খোদাই করে প্রোটোটাইপ তৈরি করতে বেশ পরিশ্রম করতে হয়৷ অত্যন্ত সূক্ষ্ম সেই ডিজাইন৷ রবারের মতো নরম ও নমনীয় উপকরণের ক্ষেত্রে কাজটা বেশ জটিল৷ তবে এটা বলতেই হবে, যে ভালো কারিগর আজও যন্ত্রের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষ৷’’
টায়ারের ট্রিড কতটা নিখুঁত হবে, কারিগরের দক্ষতার উপর তা নির্ভর করে৷ একটি নমুনা তৈরি করতে প্রায় ৪০ ঘণ্টা সময় লাগে৷ সবকিছু একেবারে নিখুঁত হতে হবে৷ প্রত্যেক ধরনের টায়ারের ট্রিড তার গুণাগুণ অনুযায়ী হতে হবে৷ নতুন মডেলের গাড়ির জন্য একটি টায়ার যথেষ্ট নয়৷ হাতে খোদাই করে এমন চারটি টায়ার তৈরি করতে হয়৷ হুবহু এক ডিজাইনের হতে হবে৷
ওলে ইয়ানসন সব পার্থক্য ধরতে পারেন৷ তাঁর বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে রায় দিতে পারেন, নতুন মডেল উৎপাদনের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে কিনা৷ ট্রিড-এ প্রত্যেকটি ত্রুটি তিনি ধরতে পারেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এক ধরনের দু’টি টায়ারের মধ্যে সরাসরি তুলনা করার সময় দু'রকম খোদাই করা ট্রিড থাকলে আমি ঠিক বুঝতে পারি৷ এটাই আমার পেশা, তফাত বোঝা আমার কাজ৷ এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার আলাদা মূল্য রয়েছে৷’’
পরীক্ষার সময় ওলে ইয়ানসন-কে নতুন প্রোটোটাইপের দুর্বলতাগুলি শনাক্ত করতে হয়৷ কারণ তাঁর সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে, সেই প্রোটোটাইপ বড় আকারে উৎপাদন করা হবে কিনা৷ তাঁর ক্ষমতার উপর ভরসা করা যায় বৈকি৷
দরিদ্র দেশ, বিলাসবহুল গাড়ি
দরিদ্র দেশের প্রায় সব ট্যাক্সি চালকেরই রয়েছে জার্মানির বিলাসবহুল মার্সিডিজ গাড়ি, যেগুলো ৮০ দশকের তৈরি এবং ডিজেলে চলে৷
ছবি: DW/B. Darame
গিনি বিসাউ-এর সব ট্যাক্সিই মার্সিডিজ
গিনি বিসাউ আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলির একটি৷ এটি বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলিরও অন্যতম৷ এখানে সকল ট্যাক্সি চালকেরই রয়েছে মার্সিডিজ বেনৎস-এর গাড়ি৷ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশ হলেও তাঁরা চালান জার্মানির ডাইমলার বেনৎস কোম্পানির বিলাসবহুল মার্সিডিজ গাড়ি৷
ছবি: DW/B. Darame
দীর্ঘদিন চলে ডিজেল মডেলের মার্সিডিজ
মালিক এবং চালকদের কাছে মার্সিডিজের এই পুরনো মডেলের গাড়ি খুবই পছন্দের, যেগুলোতে আজকের দিনের অত্যাধুনিক সুযোগসুবিধা নেই এবং সহজে মেরামত করা যায়৷ বলা যায় বিসাউ-এর চার লক্ষ জনসংখ্যার যানবাহন বাস এবং ট্যাক্সি – প্রায় সবই মার্সিডিজ কোম্পানির গাড়ি৷
ছবি: DW/B. Darame
আমাদু ১৯৯৯ সাল থেকে এই মার্সিডিজটিই চালাচ্ছে
জার্মান প্রবাসী এক ব্যক্তি ১৯৯৭ সালে এই মার্সিডিজটি পাঠিয়েছিলেন তাঁর পরিবারকে সাহায্য করার জন্য পূর্বের শহর বাফাটাতে৷ ‘‘১৯৯৯ সালে গাড়িটি বিসাউ এ আনা হয়েছে , তারপর থেকেই আমি চালাই৷ আমি এটা চালিয়ে যা পাই তা দিয়ে আমার পরিবারের দু’বেলার খাওয়া-দাওয়া চলে যায়৷’’
ছবি: DW/B. Darame
যৌথ বিনিয়োগ
মার্সিডিজ ট্যাক্সির মালিক মোট ৭ জন৷ ৪২-১১-সিডি ট্যাক্সির এই নম্বরটি শহরের সবাই এক কথায় চেনে৷ গাড়ি চালানোর ব্যবসা ভালো চললে মাসে ৭৫ ইউরো রোজগার হয়, যা বিসাউবাসীদের জন্য অনেক টাকা৷ কারণ গড়ে তাঁদের আয় মাসে ৫০ ইউরোর কম৷
ছবি: DW/B. Darame
নির্দিষ্ট রুটের জন্য মার্সিডিজ ট্রাক
ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের ট্যাক্সিগুলো বিভিন্ন রাস্তায় চলে৷ মার্সিডিজ ট্রাকগুলো ট্রাকের নির্দিষ্ট রুটে চলে৷ তাছাড়া ‘টোকা-টোকা’ নামের এই হলুদ, নীল মিনিবাসগুলোও চলে৷ ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত জার্মানির ব্রেমেনে ২১০ ডি মডেলের ৯৭০.০০০ গাড়ি তৈরি করা হয়েছিল৷ বর্তমানে ভারতের কারখানায় এই গাড়ি তৈরি হচ্ছে৷
ছবি: DW/B. Darame
সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি আমদানি
মিনিবাস বা ট্যাক্সি যাই হোক না কেন, সব সময়ই সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি আমদানি করা হয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গাড়িগুলো প্রতিবেশী দেশ জাম্বিয়ার বন্দর হয়ে ইউরোপ থেকে আফ্রিকায় আনা হয়৷ আফ্রিকায় আসার পর সেনেগাল হয়ে বিসাউ এ আসে৷ এবং সেখানেই আফ্রিকান নাগরিকদের পছন্দমতো গাড়ির রং বদলানো হয়৷