প্রায় ৪২ বছরের স্বৈরশাসনের পর গাদ্দাফির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের সূচনা হয় লিবিয়ায়৷ এরপর গত তিন বছরে সেখানকার নারীরা চেষ্টা করছেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে৷ কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন তাঁরা৷
বিজ্ঞাপন
গাদ্দাফি পরবর্তী লিবিয়াতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনেক নারীই এখন ছোটখাটো ব্যবসা করতে পারছেন, যা আগে কল্পনাই করা যেত না৷ ত্রিপোলিতে এমন নারীদের সংখ্যা বেশি হলেও লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের চিত্রটা এখনও আগের মতোই৷ ধর্মান্ধতা এবং উগ্রপন্থি দলগুলোর আধিপত্যের কারণে নারীরা স্বাধীনভাবে কোনো ব্যবসা করতে পারছেন না সেখানে৷
লিবিয়া বিপ্লবের সাথে যুক্ত ছিলেন মাগডুলেইন আবাইদা৷ লড়াই থেমে যাওয়ার পর ২০১২ সালে নারী অধিকার সংস্থার সাথে কাজ শুরু করেন তিনি৷ বেনগাজি থেকে অন্য জঙ্গি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে তিনি প্রচারণা চালাতেন নারী অধিকারের পক্ষে৷
কিন্তু এই প্রচারণা করতে গিয়ে একটি দলের অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি৷ আবাইদা জানান, যে দলটি তাঁকে অপহরণ করেছিল তারা একটি ইসলামি কট্টরপন্থি দলের সদস্য ছিল৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানান, ঐ দলের সদস্যরা তাঁকে বলেছিল পশ্চিমা ভাবধারা নিয়ে যারা চলবে তাদের বিনষ্ট করা হবে৷
নিজভূমে পরবাসী
আরব বসন্তের তিন বছর পরও লিবিয়ার তাওয়ারঘা অঞ্চলের মানুষগুলো বাড়িতে ফিরতে পারেনি৷ তাওয়ারঘা এখন ভূতুড়ে শহর৷ এলাকা ছেড়ে গিয়ে মানুষগুলো অন্য কোনো জায়গাতেও বাড়ি তৈরি করতে পারছেন না৷ এ নিয়েই আমাদের আজকের ছবিঘর৷
ছবি: DW/K. Zurutzua
এখনো ভূতুড়ে শহর
২০১১ সালের গৃহযুদ্ধের শেষ দিকে তাওয়ারঘা শহরকেই ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি৷ এক পর্যায়ে তাওয়ারঘা দখল করে নেয় বিদ্রোহীরা৷ গাদ্দাফির নির্যাতনের প্রতিশোধ হিসেবে স্থানীয়দেরই বেছে নেয় তারা৷ পার্শ্ববর্তী মিসরাতার ওপর কয়েক মাস ধরে চলা হামলা-নির্যাতনের জন্য দায়ী করে তাওয়ারঘাবাসীদের ওপরও চালানো হয় হামলা৷ হামলা থেকে বাঁচতে দলে দলে এলাকা ছাড়ায় তাওয়ারঘা এখনো ভূতুড়ে শহর৷
ছবি: DW/K. Zurutzua
কন্টেইনারে বসবাস
ত্রিপোলি বিমানবন্দরের কাছের একটি শিবির৷ এখানে অনেক শরণার্থীকে ভবন নির্মাণের কাজে লাগানোর জন্য নিয়ে আসা প্লাস্টিক আর লোহার কেবিনে বাস করতে হয়৷ এক সময় এখানে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট তৈরির পরিকল্পনা ছিল৷ এলকাটি পার্ক, ছোট ছোট সেতু আর শপিং মলে ঘেরা৷
ছবি: DW/K. Zurutzua
হামলার শিকার আল-ফালাহ ক্যাম্প
গত ১৬ই নভেম্বর আল-ফালাহ শিবিরে আকস্মিকভাবে ঢুকে পড়ে তিন অস্ত্রধারী৷ আবু মুনতালিবসহ তিনজনের ওপর গুলি চালায় তারা৷ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনার আগের দিন তিন জন লোক আল-ফালাহ শিবিরে এসে সেখানে তাওয়ারঘার কেউ থাকে কিনা জানতে চেয়েছিল৷
ছবি: DW/K. Zurutzua
ক্রোধ আর হতাশা
ভদ্রমহিলা চিৎকার করে বলছিলেন, ‘‘আমাদের সব সময় ‘গাদ্দাফিপন্থী’ বলে ডাকা হয়৷ গায়ের রংয়ের জন্যও ওরা আমাদের ঘৃণা করে৷’’ এর কয়েক ঘণ্টা আগে তাঁর ভাইকে অপহরণ করে মিসরাতার বেসামরিক বাহিনী৷
ছবি: DW/K. Zurutzua
অস্থায়ী স্কুল
প্রায় চারশ শিক্ষার্থী রয়েছে ত্রিপোলির জানজৌর শিবিরের এই স্কুলে৷ লিবিয়া সরকার শরণার্থীদের জন্য ৫০০ ঘর তৈরি করে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে৷ তাওয়ারঘার স্থানীয় প্রশাসনের কর্মীদের পরিবারগুলো সরকারের এই উদ্যোগকে প্রত্যাখ্যান করেছে৷
ছবি: DW/K. Zurutzua
আশার আলো নেই
ত্রিপোলি বিমানবন্দরের কাছের একটি শিবিরের মুখপাত্র মাবরুক সুয়েসি (বাঁ দিকে)৷ তাঁর পাশেই দেখা যাচ্ছে জালিয়া সালেমাকে৷ গত নভেম্বরে জালিয়ার ছেলেকে অপহরণ করা হয়৷ সেই থেকে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ নেই জালিয়ার৷ মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সার্বিক পরিস্থিতিকে ‘মানবতাবিরোধী চলমান অপরাধ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে৷
ছবি: DW/K. Zurutzua
ঘা শুকাতে সময় লাগবে
বাস্তুচ্যূতদের জন্য বিশেষ কার্যালয়ের প্রধান ওয়াফা এলনাস৷ তাওয়ারঘা ছেড়ে আসা মানুষগুলো শিগগিরই নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে যেতে পারবেন বলে তিনি মনে করেন না৷ তিনি মনে করেন, তাওয়ারঘা থেকে যাঁরা চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরাও জানেন, এখন যে তাঁদের ঘৃণা করা হচ্ছে এর পেছনে অতীতে মিসরাতায় পরিচালিত তাঁদের কিছু কর্মকাণ্ডের অবদান রয়েছে৷ ওয়াফা এলনাসের ধারণা, এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে৷
ছবি: DW/K. Zurutzua
7 ছবি1 | 7
মুক্তির পর আবাইদা যুক্তরাজ্যের কাছে আশ্রয় চাইলে সেখানে ঠাঁই হয় তাঁর৷ তিনি জানান, লিবিয়ায় বিপ্লবের পর নারীদের অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে৷ বিপ্লবের আগে মানুষ রক্ষণশীল ছিল, কিন্তু সমাজব্যবস্থায় সে রক্ষণশীলতার ছাপ ছিল না৷ কিন্তু এখন অবস্থা ভিন্ন৷
তিনি জানান, বিপ্লবের সময় যে সমস্ত যোদ্ধা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁদের মনোভাব ছিল এমন যে, নারীরা শুধু যোদ্ধাদের জন্য রান্না করবে৷ এতটুকুই ছিল নারীদের প্রয়োজন৷ এমনকি তাঁদের বাধ্য করা হয়েছিল বিপ্লবে সরাসরি অংশ না নিতে৷
লিবিয়ার একটি আন্তর্জাতিক তহবিলের গবেষণা ব্যবস্থাপক রোলা আব্দুল লতিফ জানালেন, এখনও যেসব নারীরা আইনসহ বিভিন্ন পেশায় আছেন, তাঁদের সবসময় বেশ চাপের মধ্যে থাকতে হয়৷
আবাইদা মনে করেন, নারীদের রাজনীতি এবং নেতৃত্বের ভূমিকায় দেখতে সমাজ আজও প্রস্তুত নয়৷ তাই আরো পরিবর্তন দরকার এবং এতে অনেক সময় লাগবে৷
২০১২ সালে ওমনিয়া ইতায়ারি একটি প্রশিক্ষণ ও কনসাল্টেন্সি ফার্ম শুরু করেন, যেখানে নারীদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও আত্মসচেতনতা বাড়ানোর ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়৷ সম্প্রতি তিনি একটি পরীক্ষা করেছেন৷ তিনি ফেসবুকে তাঁর বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন লিবিয়া গঠনে নারীর ভূমিকা সম্পর্কিত ধারণা চেয়ে৷ কিন্তু এর জবাব যেগুলো পেয়েছেন, তাতে বিস্মিত হয়েছেন তিনি৷ নারী ও পুরুষ উভয়ই পরবর্তী প্রজন্মকে লিবিয়া গঠনের হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন৷
তিনি জানান, সবাই লিখেছেন, নারীদের ঘরে থাকা উচিত আর পরবর্তীতে দেশ চালাবে এমন প্রজন্মকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার মূল দায়িত্ব তাঁদের৷ তবে ইতায়ারি এও মনে করেন, এই সব নারীদের আশেপাশে কোনো সফল নারীর দৃষ্টান্ত নেই৷ আর সে কারণেই হয়ত তাঁরা কোনো উৎসাহ পান না৷