গান্ধী পরিবারের নামে তিনটি ট্রাস্টের বিরুদ্ধে এ বার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানালো কেন্দ্রীয় সরকার। যা নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ফের সরাসরি গান্ধী পরিবারকে আক্রমণ কেন্দ্রের বিজেপি শাসিত সরকারের। বুধবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে গান্ধী পরিবারের সঙ্গে জড়িত তিনটি ট্রাস্টের বিরুদ্ধে বিশেষ তদন্ত করা হবে। অভিযোগ, তিনটি ট্রাস্টই নানাবিধ আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। কংগ্রেস অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে পাল্টা আক্রমণ করেছে কেন্দ্রীয় সরকারকে। তাদের বক্তব্য, লাদাখ সমস্যা থেকে চোখ ঘোরানোর জন্যই কেন্দ্রীয় সরকার এ কাজ করেছে।
নেহরু-গান্ধী পরিবার স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। পরবর্তীকালে তাঁর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর পুত্র রাজীবও দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। অনেকেরই অভিযোগ, স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেসকে কুক্ষিগত করে রেখেছে এই গান্ধী পরিবার। এখনও কংগ্রেসের প্রধান সোনিয়া গাঁধী। তাঁর দুই সন্তান রাহুল গান্ধী এবং প্রিয়ঙ্কা গান্ধীও দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে।
গান্ধী পরিবার নিয়ে বিতর্ক বহু দিনের। তবে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে একাধিকবার ব্যক্তিগত আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। মোদী-সহ বিজেপি নেতারা সরাসরি আক্রমণ করেছেন রাহুল, প্রিয়ঙ্কা এবং সোনিয়াকে। শুধু তাই নয়, প্রিয়ঙ্কার স্বামী রবার্ট বঢরার সংস্থাকেও একাধিকবার নাস্তানাবুদ করেছে প্রশাসন। তবে রাজীব গান্ধী এবং ইন্দিরা গান্ধীর নামে তৈরি হওয়া ট্রাস্টের বিরুদ্ধে এর আগে কখনও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়নি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, এটাও কার্যত ব্যক্তিগত আক্রমণেরই সামিল।
ভারত চলে বাপের নামে
বংশ নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয় ভারতে৷ কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন ভারতের বৈশিষ্ট্যই বংশপরম্পরা৷ রাজনীতি থেকে শুরু করে খেলা, ব্যবসা-বাণিজ্য, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সাম্রাজ্য নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: ANNE-CHRISTINE POUJOULAT/AFP/Getty Images
আম্বানির রাজত্ব
বিখ্যাত শিল্পপতি ধীরুভাই আম্বানি যে সাম্রাজ্য গড়ে গিয়েছিলেন, উত্তরাধিকারসূত্রে তার সম্রাট বনেছেন মুকেশ এবং অনীল আম্বানি৷ বাবার রাজ্য বেশ ভালোভাবেই সামলাচ্ছেন তাঁরা৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগিয়েও নিচ্ছেন বহুদূর৷
ছবি: picture-alliance/AP
বচ্চন, দ্য বচ্চন
অমিতাভ বচ্চন সম্পর্কে নতুন করে কাউকে কিছু বলার নেই৷ গত শতাব্দীর ৭০-এর দশক থেকে যে বচ্চন রাজত্ব শুরু হয় বলিউডে, এখনও তা টলাতে পারেনি কেউই৷ তাঁর নামের অংশীদার হয়েই বড় পর্দায় এসেছেন অভিষেক বচ্চন৷ অনেকেই মনে করেন, অমিতাভের ছেলে না হলে বর্তমান অবস্থানে আসা কঠিনই হতো জুনিয়র বচ্চনের৷
ছবি: ANNE-CHRISTINE POUJOULAT/AFP/Getty Images
ছোট দেওল, বড় দেওল
বলিউডের আরেক শীর্ষ অভিনেতা ধর্মেন্দ্র৷ জনপ্রিয় এই অভিনেতার বংশধরেরা অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও নাম কামিয়েছেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে৷ সানি দেওল ও ববি দেওলের কিছু ছবি হিট হলেও তুখোড় অভিনয়শিল্পীদের সাথে প্রতিযোগিতায় বেশ পিছিয়েই পড়েন তাঁরা৷ চলচ্চিত্রে অভিনেত্রী হিসেবে নাম কামিয়েছেন ধর্মেন্দ্রর মেয়ে ইশা দেওলও৷
ছবি: Ambalika Misra
কাপুর খানদান
কাপুরদের রাজত্বের ইতিহাস অন্য অনেকের চেয়ে বেশ লম্বা৷ ব্রিটিশ শাসনামলে যখন নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগ ছিল, তখন হিন্দি সিনেমার পথিকৃৎদের একজন ছিলেন পৃথ্বিরাজ কাপুর৷ চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য পদ্মভূষণ দেয়া হয় তাঁকে৷ তাঁকে দিয়েই শুরু কাপুর বংশের চার প্রজন্মের রাজত্ব৷ রাজকাপুর, তাঁর ছেলে ঋষি কাপুর এবং সর্বশেষ এখন রণবীর কাপুর আনন্দ দিয়ে চলেছেন বলিউড ভক্তদের৷
ছবি: DW
প্রযোজনা, পরিচালনা, অভিনয়
বাবা মহেশ ভাট বিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং পরিচালক৷ কিন্তু মেয়ে আলিয়া ভাট সেদিকে না গিয়ে সোজা অভিনয়ে৷ শুধু নাম নয়, মেধাতেও যে বাপের চেয়ে কোন অংশে কম না, তা এখনও প্রমাণ করে চলেছেন আলিয়া ভাট৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Samad
গান্ধী বংশ
ভারতের রাজনীতি, নেহেরুর গড়ে যাওয়া রাজত্ব এবং কংগ্রেস দায়িত্ব এখন রাহুল গান্ধীর কাঁধে৷ কংগ্রেস পরবর্তীতে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসলে রাহুলই হতে পারেন প্রধানমন্ত্রী৷
ছবি: UNI
উত্তর প্রদেশের যাদব
মুলায়েম সিং যাদবের ‘বংশের সুনাম রক্ষা’ করছেন অখিলেশ যাদব৷ সভাপতি হিসেবে বাবার সমাজবাদী দলের হাল তো ধরেছেনই, বাবার মতো হয়েছেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও৷
ছবি: Imago/Hindustan Times
বিহারের যাদব
বিহার প্রদেশের আরেক যাদব, রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবের ছোট ছেলে তেজস্বী যাদব৷ জোট সরকারের সময় উপমুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: Imago/Hindustan Times/A. Yadav
কাশ্মিরের মুফতি
জম্মু ও কাশ্মীরের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি৷ সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মোহাম্মদ সাঈদের মেয়ে মেহবুবা৷ রাজ্যটিতে তিনিই প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী৷ সমর্থকরা তাঁকে সম্মান করে ‘বাজি’ বলে ডাকেন, উর্দুতে যার অর্থ ‘বড় বোন’৷
ছবি: Imago/Hindustan Times/N. Kanotra
জম্মুর আবদুল্লাহ
জম্মু ও কাশ্মীরের আরেক নেতা ফারুক আবদুল্লাহর ছেলে ওমর আব্দুল্লাহ৷ তিনিও বাবার কাছ থেকে শুধু রাজনীতিই নয়, পেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর পদও৷
ছবি: picture-alliance/epa/F. Khan
আল্লা রাখার উত্তরাধিকার
শুধু উপমহাদেশ নয়, তবলায় জাদু দেখিয়ে পুরো বিশ্বকেই তাক লাগিয়েছিলেন আল্লা রাখা৷ তাঁর সন্তান ওস্তাদ জাকির হোসেন ধরে রেখেছেন সেই বংশপরম্পরা, ছড়িয়ে যাচ্ছেন তবলার ম্যাজিক৷
ছবি: AP
বাপ কা বেটি
উপমহাদেশের আরেক গর্ব পণ্ডিত রবিশংকর৷ এই সিতার মায়েস্ত্রোর যোগ্য কন্যা আনুশকা শংকর৷ বিশ্বের নামকরা সিতারবাদকদের মধ্যে অন্যতম স্থান দখলে নিয়েছেন আনুশকা৷
ছবি: AP
গীতা ফোগাট
আমির খানের চলচ্চিত্র দঙ্গল-এর সৌজন্যে মোটামোটি সবাই এখন জানেন গীতা ফোগাটের নাম৷ বিখ্যাত কুস্তিগীর মহাবীর ফোগাটের মেয়ে গীতা ভারতের হয়ে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় কুস্তিতে স্বর্ণপদক পাওয়া নারী৷
ছবি: Imago/Hindustan Times
বিচারক চন্দ্রচূড়
ওয়াই ভি চন্দ্রচূড় ছিলেন ভারতে প্রখ্যাত প্রধান বিচারপতি৷ তাঁর ছেলে ধনঞ্জয় চন্দ্রচূড়ও আইনজ্ঞ হিসেবে ধরে রেখেছেন সুনাম৷ ধনঞ্জয়ও এখন ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি৷
ছবি: Imago/Hindustan Times
14 ছবি1 | 14
যে তিনটি ট্রাস্টের বিরুদ্ধে তদন্তের কথা বলা হয়েছে সেগুলি হলো, রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশন, রাজীব গান্ধী চ্যারিটেবল ট্রাস্ট এবং ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অভিযোগ, এই ট্রাস্টগুলি আইন ভেঙে বিদেশ থেকে টাকা নিয়েছে। আয়কর দেওয়ার ক্ষেত্রেও গরমিল করেছে। এমনকী, টাকা নয়-ছয় বা মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগও রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানিয়েছে, এনফোর্সমেন্ট ডিরোক্টোরেটের একজন স্পেশাল অফিসার তদন্ত করবে।
বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা আরও বড় অভিযোগ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রী রিলিফ ফান্ড থেকেও এই সংস্থাগুলিকে টাকা পাইয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, ১৯৯১ সালে মনমোহন সিংহ যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তখন বাৎসরিক বাজেটেও রাজীব গান্ধী ট্রাস্টের নামে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন, যা বেআইনি। তার আগে বিজেপির অভিযোগ ছিল, চীনের কাছ থেকে রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশন ৯০ লাখ টাকা পেয়েছে।
কংগ্রেস স্বাভাবিক ভাবেই এই সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় সরকার বর্তমান সমস্যাগুলি থেকে চোখ ঘোরানোর জন্যই এ কাজ করছে। লাদাখে ভারত-চীন সীমান্ত বিতর্ক থেকে তারা মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে চাইছে। পাশাপাশি কংগ্রেসের কোনও কোনও নেতা সরাসরি নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করছেন। তাঁদের বক্তব্য, করোনা-কালে প্রধানমন্ত্রী রিলিফ ফান্ডকে সামনে না রেখে মোদী একটি নতুন ফান্ড তৈরি করেছেন। পিএম কেয়ার ফান্ড। যে ফান্ডের কোনও অডিট হবে না। অভিযোগ, সেই ফান্ডের টাকা থেকে গুজরাটে ভেন্টিলেটর কেনার টাকা দেওয়া হয়েছে। সেই ভেন্টিলেটরগুলি আসলে অকেজো বলে অভিযোগ। কংগ্রেসের অভিযোগ, পিএম কেয়ার ফান্ড থেকে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। ওই তহবিলবেও বিদেশি অর্থ আসার অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, এ বছরের শেষেই বিহারে ভোট। আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন। এই পরিস্থিতিতে নতুন কিছু সামনে আনতে মরিয়া বিজেপি। করোনা লকডাউন এবং লাদাখ সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নতুন বিষয়কে ভোটের এজেন্ডা হিসেবে সামনে আনার জন্যই গান্ধী পরিবারের ট্রাস্টের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, যদি সত্যিই এই ট্রাস্টগুলিতে অনিয়ম হয়ে থাকে, তা হলে এত দিন কেন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?