1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গান ভালোবেসে গান

Indien Delhi | Shamayita Chakraborty DW-Korrespondentin
শময়িতা চক্রবর্তী
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে কলকাতা ও শহরাঞ্চলের স্কুলে নিয়মিত গান ও নাচের ক্লাস হয়। এখন বাধ সাধছে শূন্যপদ এবং ইঁদুর দৌড়ের চোখরাঙানি।

সময়ের সঙ্গে স্টিরিওটাইপের চশমা বদলেছে। বদলায়নি বাঙালি বাবা-মায়ের তাদের সন্তানকে নাচ গানের সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় করার তীব্র বাসনা। প্রতীকী ছবিছবি: Satyajit Shaw/DW

পপ কালচারে বাঙালি নারীকে যে স্টিরিওটাইপের আতস কাঁচ দিয়ে দেখা হতো তার মধ্যে বেণী দুলিয়ে, হারমোনিয়ামে সুর তুলে গান গাওয়া ছিল অপরিহার্য। সময়ের সঙ্গে স্টিরিওটাইপের চশমা বদলেছে। বদলায়নি বাঙালি বাবা-মায়ের তাদের সন্তানকে নাচ গানের সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় করার তীব্র বাসনা।    

আমার এক বন্ধুর ছোট্ট মেয়ে লানা ডেল রে আর বিটলসের ভক্ত। সে সালভাতোরে শুনলে গলা ছেড়ে লা লা লা লা করে গান গায়। দুষ্টুমির মধ্যে হিয়র কামস দ্য সান বাজলে শান্ত হয়ে বসে পরে। সেই ছোট্ট মেয়ের বয়স আড়াই। তার বাবা-মায়ের ইচ্ছে সে ছোট থেকেই গান শিখুক। সেই মেয়ে এখনো প্লে স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ত হয়নি। ইতিমধ্যেই তার বাবা-মা কলকাতা তোলপাড় করে এমন স্কুল খুঁজছেন, যেখানেভালো গান শেখানো হয়।

 

সুরের জানলা

বিশেষজ্ঞদের মতে, সংগীত শিশুমনের বিকাশে সাহায্য করে। গান হোক বা নাচ -- ছোটবেলা থেকে এর চর্চা মোটর স্কিল বা পেশি সঞ্চালনের মাধ্যমে কোনো কাজ সম্পন্ন করার দক্ষতাকে উন্নত করে। চিন্তা করার মনন ঋদ্ধ করে। ভাষার উপর দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে। যৌথভাবে কাজ করার প্রতি আগ্রহ বাড়ায়। সংবেদনশীল মন গঠনে সাহায্য করে এবং সর্বোপরি সৃজনশীলতার জন্ম দেয়। মোটের উপর সংগীতচর্চা যে একটি শিশুকে উন্নততর মানুষ হওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে, সে বিষয়ে অসংখ্য গবেষণা, পরীক্ষা এবং তার ফলাফলের ইতিহাস আমাদের সামনে আছে। গোটা ভারতে বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি স্কুলে নিয়মিত গান, নাচ, বাদ্যযন্ত্র শেখানো হয়। 

এত কিছু জেনে হোক বা অভ্যাসবশে -- সন্তানকে সংস্কৃতিমনষ্ক করে বড় করার প্রবণতার ইতিহাস আমাদের দীর্ঘদিনের। আমার বাবা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই গান চালিয়ে দিতেন। বাবা গানের ক্ষেত্রে উন্নাসিক ছিলেন। হিন্দুস্থানি ক্লাসিকাল হোক, বা রবীন্দ্রসংগীত, কিশোরী আমোনকর হন বা দেবব্রত বিশ্বাস, শুনতে ইচ্ছে করুক বা না করুক -- শোনার চেষ্টা থেকে রেহাই পাওয়া যেতো না। একটু বড় হয়ে আমি যে ধরনের গান শুনতাম তা বাবা পছন্দ করতেন না। কিন্তু কোনোদিন কোনো গান শুনতে বারণ করেননি। বহু বছর পর বুঝেছি বাবার আরোপ করা সেদিনের অভ্যেস জীবন দর্শনের একটা বড় দরজা খুলে দিয়েছিল। নানা সুরের মধ্যে দিয়ে পৃথিবী চিনতে শেখার হাতেখড়ি হয়েছিল বাবার বাজানো গানে। গান গাওয়ায় পারদর্শী না করতে পারলেও আমার বাবাই প্রথম দক্ষ শ্রোতা হওয়ার তালিম দিয়েছিলেন।  

পশ্চিমবঙ্গে অনেক সরকারি, আধা সরকারি স্কুলে গানের ক্লাস হয়। যেখানে হয় না, সেখানেও  কোনো ছাত্র বা ছাত্রী গানকে লেখাপড়ার বিষয় হিসেবে বাছতে পারেন। ছবি: BSIP/picture alliance

গানের স্কুল, স্কুলের গান

স্কুলেও গান আমার পিছু ছাড়েনি। আমাদের সরকারি স্কুল। সপ্তাহে একদিন গানের দিদিমণির কাছে হাজিরা দিতে হতো। ক্লাস এইট পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষায় গানের নম্বর মূল নম্বরের সঙ্গে যুক্ত হতো। নবম শ্রেণি থেকে থেকে গান হলো অ্যাডিশনাল। কেউ চাইলে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে গান শিখতে এবং তা নিয়ে পড়াশোনা করতে পারতেন। সম্প্রতি এই নিয়মের খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। এখন নবম, দশমেও কেউ চাইলে গান নিয়ে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে পড়াশোনা চালাতে পারেন। তবে তার মূল্যায়ন করা হয় না।

ইলেভেন আর টুয়েলভ ক্লাসে অবশ্যই সংগীত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ছাত্র ছাত্রীরা এ নিয়ে পড়াশোনা করতে পারেন। অনেক সরকারি, আধা সরকারি স্কুলে গানের ক্লাস হয়। যেখানে হয় না, সেখানেও  কোনো ছাত্র বা ছাত্রী গানকে লেখাপড়ার বিষয় হিসেবে বাছতে পারেন। সেক্ষেত্রে তাকে গান সংক্রান্ত সিলেবাস নিজের দায়িত্বে শেষ করতে হবে। স্কুল পরীক্ষার ব্যবস্থা করবে।

কলকাতায় সিংহভাগ বেসরকারি স্কুলে নাচ বা গান শেখানোর সুবন্দোবস্ত আছে। কনভেন্ট স্কুলগুলিতে ক্যারল এবং হাইমসের পাশাপাশি নিয়মিত গানের প্রশিক্ষণ চলে। সেখানে গানের ক্লাসে পাশ্চাত্য সংগীতের প্রভাব বেশি থাকলেও নাচের ক্লাসে ভারতীয় ক্লাসিকাল নাচ শেখানোর প্রবণতা বেশি। 

গান শোনাটা মানুষের একার হয়ে গেছে: অনিন্দ্য

05:28

This browser does not support the video element.

সুর কেটে যাওয়া শূন্যপদ   

তবে রাজ্যের বিশাল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী যায় সরকারি এবং আধা সরকারি স্কুলে।  কলকাতায়  সাতটি এবং রাজ্যে ৬২টির মতো রাজ্য সরকার পরিচালিত স্কুল আছে। এছাড়াও আছে গভর্নমেন্ট স্পনসর্ড স্কুল। কলকাতায় তার সংখ্যা ৪০০-র উপর। প্রতিটি স্কুলেই সংগীত বিষয়টি পড়ানো হয়, এমনটা নয়। কিন্তু গানের সঙ্গে ছাত্র ছাত্রীদের নিবিড় যোগাযোগ থেকেই যায়। স্কুল শুরুর আগের প্রার্থনা সংগীত বাদ দিলেও সারা বছরে বহু অনুষ্ঠানে গান মুখ্য ভূমিকা নেয়। রবীন্দ্রজয়ন্তী হোক, স্বাধীনতা দিবস বা স্কুল ফেস্ট -- গান জানেন এমন শিক্ষক-শিক্ষিকারা গানে আগ্রহ আছে এমন ছাত্র-ছাত্রীদের মন দিয়ে গান তোলান। তাদের তদারকিতে চলে মহড়া এবং শেষে পরিবেশন।

এহেন সংগীতপ্রিয় রাজ্যে গান চর্চার সদিচ্ছা থাকলেও বাধ সাধছে অসংখ্য শূন্যপদ।নবম থেকে একাদশে শিক্ষকদের শূন্যপদের সংখ্যা আকাশছোঁয়া। ২০০৯ থেকে ২০১২ সালে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২০১৬ সালের শিক্ষক নিয়োগের প্যানেল বাতিল হয়েছে। যারা শিক্ষকতা করছিলেন, তাদের মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। স্বভাবতই, এই সহস্রাধিক শূন্যপদে সংগীত শিক্ষকদের সংখ্যাও কম না। বীরভূমের একটি স্কুলের এক হেডমাস্টার জানিয়েছেন, তাদের স্কুলে সংগীতে আগ্রহ থাকার কারণে এক অঙ্কের শিক্ষক সংগীতেরও ক্লাস নেন। সরকারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্বে থাকেন পাবলিক সার্ভিস কমিশন। সেখানেও শতাধিক শূন্যপদ। ২০১৭ থেকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা হয়নি। বাংলা, ইংরেজি, পদার্থবিদ্যার পাশাপাশি সংগীতের শিক্ষকেরও টান পড়েছে সরকারি স্কুলে।

ইঁদুর দৌড়ের যাঁতাকল

এর পাশাপাশি, আরেকটা প্রবণতার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। যে বাবা-মায়েরা পরম উৎসাহে ছেলে-মেয়েকে ছোটবেলায় সংস্কৃতিমনষ্ক করতে উদগ্রীব থাকেন, বোর্ড পরীক্ষা নাগালের মধ্যে চলে এলে তারা সন্তানের নাচের ক্লাস ছাড়িয়ে ঘাড় গুঁজে পড়তে বসানোর প্রস্তুতি নেন। অভিভাবকদের এই পরস্পরবিরোধী আচরণ প্রায় দৃষ্টিকটু লাগে। অনেক ক্ষেত্রেই এর ফল ভোগে সন্তানরা। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়ে। অনেক সংগীত অনুরাগী ছাত্র-ছাত্রী এই সময়ে সংগীতের হাত ছাড়েন। কেউ কেউ পরে ফিরে আসেন। অনেকে পারেন না।  

তবে একথা অনস্বীকার্য, প্রথাগত তালিম থাকুক বা না থাক, সংগীতচর্চা বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। আমার বন্ধুর ছোট্ট মেয়ের মতো এমন অনেক ছোট্ট মানুষরা আছে, যারা পৃথিবী দর্শনের প্রথম চৌকাঠ পেরোয় সুরের হাত ধরে। পৃথিবীর যে-কোনো উন্নত দেশে লেখাপড়ার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চা পঠনপাঠনের নিবিড় অংশ। কেরিয়ার তৈরির ইঁদুর দৌড়ের জন্য ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, অর্থনীতি তো থাকবেই। উপায়হীনভাবে সেগুলো গলদ্ধকরণও করতে হবে। পঠন-পাঠনের এই প্রকাণ্ড বোঝার মধ্যে সংগীত চর্চা একমুঠো খোলা আকাশ উপহার দেয় আমাদের শিক্ষার্থীদের। সেই খোলা আকাশের দরজা যেন বন্ধ না হয়, তা দেখার দায়িত্ব আমাদের সবার।  

 

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ