পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে কলকাতা ও শহরাঞ্চলের স্কুলে নিয়মিত গান ও নাচের ক্লাস হয়। এখন বাধ সাধছে শূন্যপদ এবং ইঁদুর দৌড়ের চোখরাঙানি।
বিজ্ঞাপন
সময়ের সঙ্গে স্টিরিওটাইপের চশমা বদলেছে। বদলায়নি বাঙালি বাবা-মায়ের তাদের সন্তানকে নাচ গানের সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় করার তীব্র বাসনা। প্রতীকী ছবিছবি: Satyajit Shaw/DW
পপ কালচারে বাঙালি নারীকে যে স্টিরিওটাইপের আতস কাঁচ দিয়ে দেখা হতো তার মধ্যে বেণী দুলিয়ে, হারমোনিয়ামে সুর তুলে গান গাওয়া ছিল অপরিহার্য। সময়ের সঙ্গে স্টিরিওটাইপের চশমা বদলেছে। বদলায়নি বাঙালি বাবা-মায়ের তাদের সন্তানকে নাচ গানের সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় করার তীব্র বাসনা।
আমার এক বন্ধুর ছোট্ট মেয়ে লানা ডেল রে আর বিটলসের ভক্ত। সে সালভাতোরে শুনলে গলা ছেড়ে লা লা লা লা করে গান গায়। দুষ্টুমির মধ্যে হিয়র কামস দ্য সান বাজলে শান্ত হয়ে বসে পরে। সেই ছোট্ট মেয়ের বয়স আড়াই। তার বাবা-মায়ের ইচ্ছে সে ছোট থেকেই গান শিখুক। সেই মেয়ে এখনো প্লে স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ত হয়নি। ইতিমধ্যেই তার বাবা-মা কলকাতা তোলপাড় করে এমন স্কুল খুঁজছেন, যেখানেভালো গান শেখানো হয়।
ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সংগীত শেখায় সমস্যা কোথায়?
সংগীত শিক্ষকের বদলে আরো ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবি জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রর মতে, এটি বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা। ডয়চে ভেলেকে তাদের মতামত জানালেন বিভিন্ন মানুষ৷
ছবি: Imago/epd
পিছিয়ে নেওয়ার একটা চেষ্টা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এমিরেটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
খুবই দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত। সংগীত শিক্ষা তো সংস্কৃতি চর্চার অংশ। বিদ্যালয়ে সংস্কৃতি চর্চা হওয়া অত্যান্ত প্রয়োজনীয়। আমরা যে জায়গায় পৌঁছেছিলাম, সেখান থেকে পিছিয়ে নেওয়ার একটা চেষ্টা হচ্ছে। এটা মোটেই গ্রহণযোগ্য না। এটা নিয়ে বিতর্ক তৈরি করা হলে শিক্ষার অগ্রগতিকেই ব্যহত করা হবে।
ছবি: Sirajul Islam Chowdhury
সংগীতকে ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছে: রাশেদা কে চৌধুরী, উপদেষ্টা, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার
সংগীতকে ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করানোর একটা চেষ্টা হচ্ছে। যারা সংগীত বাদ দিয়ে ধর্ম শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার দাবি করছে, তারা আসলে চাইতে পারতেন সংগীতের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হোক। যেখানে ধর্মীয় শিক্ষক নেই, সেগুলো দ্রুত পূরণ করা হোক। তা না করে শুধুমাত্র বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা হচ্ছে। এতে শিক্ষা ব্যবস্থাই পিছিয়ে যাবে। সংগীত একটা বাচ্চার বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার জীবন গঠনে ভূমিকা রাখে।
ছবি: bdnews24.com
প্রতিটি স্কুলে সংগীত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে: অ্যাডভোকেট সালমা আলী, উপদেষ্টা, মহিলা আইনজীবী সমিতি
প্রতিটি স্কুলে সংগীত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু ছোট বাচ্চারা তো পরিবার থেকেই ধর্ম শিক্ষা পায়। তাই বরং সব স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। যেখানে স্কুলে ধর্ম শিক্ষা তুলে দেওয়ার দাবি ওঠার কথা, সেখানে সংগীত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার বিরোধিতা করা হচ্ছে। আমি মনে করি, শিশুর বিকাশের জন্য অবশ্যই সংগীত শিক্ষা থাকতে হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে সংগীতের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
ছবি: privat
বিরোধিতাকারীরা কূপমণ্ডুকতা করছে: শিরিন হক, নারী সংস্কার কমিশনের প্রধান
সরকার সংগীতের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাকে আমি স্বাগত জানাই। গ্রামের স্কুলগুলোতে তো গরিব শিক্ষার্থীরা সংস্কৃতি চর্চার বাইরে থাকে। যারা বিরোধিতা করছে, তারা কূপমণ্ডুকতা করছে। মানুষের জীবনে ধর্মীয় শিক্ষার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি সংস্কৃতি চর্চারও প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগের বিরোধিতা করে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের যে দাবি করা হচ্ছে, সেটা একেবারেই অমূলক।
ছবি: Shirin Parvin Haque
সমাজকে পিছনে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র: ডা. ফওজিয়া মোসলেম, সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
আমি নিজেই একটি স্কুল কমিটির দায়িত্বে আছি। সেখানে আমি দেখেছি, ধর্মীয় শিক্ষকের পোস্ট সেখানে আছে, সংগীত শিক্ষকের পোস্টও আছে। সংগীত শিক্ষার সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষার কোনো বিরোধ নেই। বরং সংগীত শিক্ষা না থাকাটা সমাজকে অনেক পিছিয়ে নিয়ে যাবে। সমাজকে সামনে নিতে সংগীতের চর্চাটা খুবই দরকার। যারা এর বিরোধিতা করছেন, তারা অত্যন্ত অন্যায়ভাবে বিরোধিতা করছেন। সমাজকে পিছনে নিয়ে যাওয়ার একটা ষড়যন্ত্র বলে আমি মনে করি।
ছবি: DW
সংগীতের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষক থাকা উচিত: মাইনুল হাসান সোহেল, সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি
বাংলা, অংক ও ইংরেজির মতো মৌলিক শিক্ষায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশ দুর্বল। এটা নিয়ে কোনো কথা হচ্ছে না। সরকারের উচিত, প্রাথমিক স্তরে সংগীতের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগসহ মৌলিক শিক্ষার মান বাড়াতে সংশ্লিষ্ট দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
ছবি: Private
‘সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বাতিল’ করতে হবে এমন দাবি জবরদখলী সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ: জাবির আহমেদ জুবেল, সাধারণ সম্পাদক, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী
সারা বিশ্বেই প্রাথমিকে শিশুকে সংগীতসহ ললিতকলায় পারদর্শী করে তোলায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বাংলাদেশে যখন প্রাথমিক শিক্ষায় এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, তখন ধর্মকে সামনে নিয়ে এসে ধর্মীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যে বিরোধিতা করছেন, তা অবান্তর। সকল ধর্মের ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ হতেই পারে, কিন্তু ‘সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বাতিল’ করতে হবে এমন দাবি শুধু অযৌক্তিকই নয়, বরং জবরদখলী সংস্কৃতিরই বহিঃপ্রকাশ।
ছবি: Privat
সংস্কৃতি একটি জাতির অস্তিত্ব ও আত্মার প্রকাশ: তাকিম শেখ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো মুক্তচিন্তার জায়গা, যেখানে একজন শিশু স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠবে। সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা থাকবে, যার মাধ্যমে একজন শিশু ধর্মীয় মূল্যবোধ, ধর্মীয় জ্ঞান, আচার-আচরণ শিখবে। আবার সেখানে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাও থাকবে। বাঙালির হাজার বছরের কৃষ্টি, লোকসংগীত, নৃত্য, বাউল, ভাটিয়ালি, জারি-সারি, যাত্রাপালা যা নদীমাতৃক এই দেশের মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
ছবি: Privat
সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব থাকলেও ধর্মের অনুসারীদের মতামত উপেক্ষা করা হচ্ছে: মুহাম্মদ মুঈনুদ্দিন গাউছ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ অপরিহার্য। অথচ ধর্মীয় শিক্ষকের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও সংগীত শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব থাকলেও দেশের নব্বই ভাগ মানুষ যে ধর্মের অনুসারী, তাদের মতামত উপেক্ষা করা হচ্ছে। এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের অনুসারীদের বিপরীতে গিয়ে দেশে নতুন সমস্যা তৈরি না করে।
শুধু ধর্মীয় বা নৈতিক মূল্যবোধ নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল জগত সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। ধর্ম শিক্ষকেরা যেমন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক গড়ে দেন, তেমনি সংগীত শিক্ষক শিক্ষার্থীর শিল্প-সংবেদন ও সৃজনশীলতাকে বিকশিত করতে পারেন। তাই আমি মনে করি, ধর্ম শিক্ষার ক্ষেত্রে যেমন কাউকে বাধা দেওয়া উচিত না, তেমনি যে সংগীত শিখতে চায়, তাকেও সেই সুযোগ করে দেওয়া উচিত।
ছবি: privat
যদি নতুন কোনো জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়, তাহলে কেন নয়: হোমায়রা আশরাফ অর্নি, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়েই একজন শিক্ষার্থীর আসল বিকাশ ঘটে, আপনি বাচ্চাকে যা শেখাচ্ছেন পরবর্তীতে তা নিয়েই তার আগ্রহ বাড়বে, সেই বিষয়ে কাজ করবে। আমার মতে, এই বয়সে সকল কিছু সম্পর্কে শিক্ষার্থীর ধারণা থাকা দরকার। ধর্মীয় শিক্ষক প্রতি বিদ্যালয়েই রয়েছে, যদি নতুন কোনো জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়, তাহলে কেন নয়?
ছবি: privat
11 ছবি1 | 11
সুরের জানলা
বিশেষজ্ঞদের মতে, সংগীত শিশুমনের বিকাশে সাহায্য করে। গান হোক বা নাচ -- ছোটবেলা থেকে এর চর্চা মোটর স্কিল বা পেশি সঞ্চালনের মাধ্যমে কোনো কাজ সম্পন্ন করার দক্ষতাকে উন্নত করে। চিন্তা করার মনন ঋদ্ধ করে। ভাষার উপর দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে। যৌথভাবে কাজ করার প্রতি আগ্রহ বাড়ায়। সংবেদনশীল মন গঠনে সাহায্য করে এবং সর্বোপরি সৃজনশীলতার জন্ম দেয়। মোটের উপর সংগীতচর্চা যে একটি শিশুকে উন্নততর মানুষ হওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে, সে বিষয়ে অসংখ্য গবেষণা, পরীক্ষা এবং তার ফলাফলের ইতিহাস আমাদের সামনে আছে। গোটা ভারতে বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি স্কুলে নিয়মিত গান, নাচ, বাদ্যযন্ত্র শেখানো হয়।
এত কিছু জেনে হোক বা অভ্যাসবশে -- সন্তানকে সংস্কৃতিমনষ্ক করে বড় করার প্রবণতার ইতিহাস আমাদের দীর্ঘদিনের। আমার বাবা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই গান চালিয়ে দিতেন। বাবা গানের ক্ষেত্রে উন্নাসিক ছিলেন। হিন্দুস্থানি ক্লাসিকাল হোক, বা রবীন্দ্রসংগীত, কিশোরী আমোনকর হন বা দেবব্রত বিশ্বাস, শুনতে ইচ্ছে করুক বা না করুক -- শোনার চেষ্টা থেকে রেহাই পাওয়া যেতো না। একটু বড় হয়ে আমি যে ধরনের গান শুনতাম তা বাবা পছন্দ করতেন না। কিন্তু কোনোদিন কোনো গান শুনতে বারণ করেননি। বহু বছর পর বুঝেছি বাবার আরোপ করা সেদিনের অভ্যেস জীবন দর্শনের একটা বড় দরজা খুলে দিয়েছিল। নানা সুরের মধ্যে দিয়ে পৃথিবী চিনতে শেখার হাতেখড়ি হয়েছিল বাবার বাজানো গানে। গান গাওয়ায় পারদর্শী না করতে পারলেও আমার বাবাই প্রথম দক্ষ শ্রোতা হওয়ার তালিম দিয়েছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গে অনেক সরকারি, আধা সরকারি স্কুলে গানের ক্লাস হয়। যেখানে হয় না, সেখানেও কোনো ছাত্র বা ছাত্রী গানকে লেখাপড়ার বিষয় হিসেবে বাছতে পারেন। ছবি: BSIP/picture alliance
গানের স্কুল, স্কুলের গান
স্কুলেও গান আমার পিছু ছাড়েনি। আমাদের সরকারি স্কুল। সপ্তাহে একদিন গানের দিদিমণির কাছে হাজিরা দিতে হতো। ক্লাস এইট পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষায় গানের নম্বর মূল নম্বরের সঙ্গে যুক্ত হতো। নবম শ্রেণি থেকে থেকে গান হলো অ্যাডিশনাল। কেউ চাইলে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে গান শিখতে এবং তা নিয়ে পড়াশোনা করতে পারতেন। সম্প্রতি এই নিয়মের খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। এখন নবম, দশমেও কেউ চাইলে গান নিয়ে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে পড়াশোনা চালাতে পারেন। তবে তার মূল্যায়ন করা হয় না।
ইলেভেন আর টুয়েলভ ক্লাসে অবশ্যই সংগীত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ছাত্র ছাত্রীরা এ নিয়ে পড়াশোনা করতে পারেন। অনেক সরকারি, আধা সরকারি স্কুলে গানের ক্লাস হয়। যেখানে হয় না, সেখানেও কোনো ছাত্র বা ছাত্রী গানকে লেখাপড়ার বিষয় হিসেবে বাছতে পারেন। সেক্ষেত্রে তাকে গান সংক্রান্ত সিলেবাস নিজের দায়িত্বে শেষ করতে হবে। স্কুল পরীক্ষার ব্যবস্থা করবে।
কলকাতায় সিংহভাগ বেসরকারি স্কুলে নাচ বা গান শেখানোর সুবন্দোবস্ত আছে। কনভেন্ট স্কুলগুলিতে ক্যারল এবং হাইমসের পাশাপাশি নিয়মিত গানের প্রশিক্ষণ চলে। সেখানে গানের ক্লাসে পাশ্চাত্য সংগীতের প্রভাব বেশি থাকলেও নাচের ক্লাসে ভারতীয় ক্লাসিকাল নাচ শেখানোর প্রবণতা বেশি।
গান শোনাটা মানুষের একার হয়ে গেছে: অনিন্দ্য
05:28
সুর কেটে যাওয়া শূন্যপদ
তবে রাজ্যের বিশাল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী যায় সরকারি এবং আধা সরকারি স্কুলে। কলকাতায় সাতটি এবং রাজ্যে ৬২টির মতো রাজ্য সরকার পরিচালিত স্কুল আছে। এছাড়াও আছে গভর্নমেন্ট স্পনসর্ড স্কুল। কলকাতায় তার সংখ্যা ৪০০-র উপর। প্রতিটি স্কুলেই সংগীত বিষয়টি পড়ানো হয়, এমনটা নয়। কিন্তু গানের সঙ্গে ছাত্র ছাত্রীদের নিবিড় যোগাযোগ থেকেই যায়। স্কুল শুরুর আগের প্রার্থনা সংগীত বাদ দিলেও সারা বছরে বহু অনুষ্ঠানে গান মুখ্য ভূমিকা নেয়। রবীন্দ্রজয়ন্তী হোক, স্বাধীনতা দিবস বা স্কুল ফেস্ট -- গান জানেন এমন শিক্ষক-শিক্ষিকারা গানে আগ্রহ আছে এমন ছাত্র-ছাত্রীদের মন দিয়ে গান তোলান। তাদের তদারকিতে চলে মহড়া এবং শেষে পরিবেশন।
এহেন সংগীতপ্রিয় রাজ্যে গান চর্চার সদিচ্ছা থাকলেও বাধ সাধছে অসংখ্য শূন্যপদ।নবম থেকে একাদশে শিক্ষকদের শূন্যপদের সংখ্যা আকাশছোঁয়া। ২০০৯ থেকে ২০১২ সালে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২০১৬ সালের শিক্ষক নিয়োগের প্যানেল বাতিল হয়েছে। যারা শিক্ষকতা করছিলেন, তাদের মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। স্বভাবতই, এই সহস্রাধিক শূন্যপদে সংগীত শিক্ষকদের সংখ্যাও কম না। বীরভূমের একটি স্কুলের এক হেডমাস্টার জানিয়েছেন, তাদের স্কুলে সংগীতে আগ্রহ থাকার কারণে এক অঙ্কের শিক্ষক সংগীতেরও ক্লাস নেন। সরকারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্বে থাকেন পাবলিক সার্ভিস কমিশন। সেখানেও শতাধিক শূন্যপদ। ২০১৭ থেকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা হয়নি। বাংলা, ইংরেজি, পদার্থবিদ্যার পাশাপাশি সংগীতের শিক্ষকেরও টান পড়েছে সরকারি স্কুলে।
বিজ্ঞাপন
ইঁদুর দৌড়ের যাঁতাকল
এর পাশাপাশি, আরেকটা প্রবণতার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। যে বাবা-মায়েরা পরম উৎসাহে ছেলে-মেয়েকে ছোটবেলায় সংস্কৃতিমনষ্ক করতে উদগ্রীব থাকেন, বোর্ড পরীক্ষা নাগালের মধ্যে চলে এলে তারা সন্তানের নাচের ক্লাস ছাড়িয়ে ঘাড় গুঁজে পড়তে বসানোর প্রস্তুতি নেন। অভিভাবকদের এই পরস্পরবিরোধী আচরণ প্রায় দৃষ্টিকটু লাগে। অনেক ক্ষেত্রেই এর ফল ভোগে সন্তানরা। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়ে। অনেক সংগীত অনুরাগী ছাত্র-ছাত্রী এই সময়ে সংগীতের হাত ছাড়েন। কেউ কেউ পরে ফিরে আসেন। অনেকে পারেন না।
তবে একথা অনস্বীকার্য, প্রথাগত তালিম থাকুক বা না থাক, সংগীতচর্চা বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। আমার বন্ধুর ছোট্ট মেয়ের মতো এমন অনেক ছোট্ট মানুষরা আছে, যারা পৃথিবী দর্শনের প্রথম চৌকাঠ পেরোয় সুরের হাত ধরে। পৃথিবীর যে-কোনো উন্নত দেশে লেখাপড়ার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চা পঠনপাঠনের নিবিড় অংশ। কেরিয়ার তৈরির ইঁদুর দৌড়ের জন্য ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, অর্থনীতি তো থাকবেই। উপায়হীনভাবে সেগুলো গলদ্ধকরণও করতে হবে। পঠন-পাঠনের এই প্রকাণ্ড বোঝার মধ্যে সংগীত চর্চা একমুঠো খোলা আকাশ উপহার দেয় আমাদের শিক্ষার্থীদের। সেই খোলা আকাশের দরজা যেন বন্ধ না হয়, তা দেখার দায়িত্ব আমাদের সবার।
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাখাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও বিক্ষোভ-প্রতিবাদ
গত নয় বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক শিক্ষা-কেলেঙ্কারি সামনে এসেছে। প্রতিবাদ হয়েছে। তদন্ত চলছে। আদালতে চলছে মামলা। সংবাদ শিরোনামে বেশি না এলেও এখনো চলছে শিক্ষাখাতকে দুর্নীতিমুক্ত করার দাবিতে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ.....
ছবি: Subrata Goswami/DW
২০১৬ সালে যা হয়েছিল
২০১৬ সালে শিক্ষক নিয়োগের জন্য পরীক্ষা নেয়া হয়। তারপর প্যানেল তৈরি করে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। অভিযোগ ওঠে, অনেক নিয়োগই বেআইনিভাবে হয়েছে, অযোগ্যরা বিপুল অর্থের বিনিময়ে চাকরি পেয়েছে। তারপর বিষয়টি নিয়ে মামলা হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
গ্রুপ ডি কর্মীর নিয়োগ নিয়েও কেলেঙ্কারি
২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশন(এসএসসি) সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে ১৩ হাজার গ্রুপ ডি কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়। প্যানেল তৈরি হয়। ২০১৯ সালে এই প্যানেলের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তারপরেও এই প্যানেল থেকে অন্তত ২৫ জনকে নিয়োগ করা হয়। আদালতে মামলা হয়। অভিযোগ করা হয়, ওই নিয়োগ বেআইনি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সিবিআই তদন্তের নির্দেশ
২০২১ সালের নভেম্বরে কলকাতা হাইকোর্ট শিক্ষা কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। রাজ্য সরকার তা ঠেকানোর জন্য আবেদন করে। কিন্তু সেই আবেদন খারিজ হয়ে যায়। ২০২২ থেকে শুরু হয় সিবিআই তদন্ত।
ছবি: Subrata Goswami/DW
পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেপ্তার
২০২২ সালের ২৩ জুলাই সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও তৃণমূল নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেপ্তার করে সিবিআই। পার্থ চট্টোপাধ্যায় এখনো জেলে বন্দি। সম্প্রতি, তার শরীর খারাপ হয়েছে। আদালত তাকে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করার নির্দেশ দিয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
গ্রেপ্তার অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়
পার্থর ঘনিষ্ঠ টলিউড অভিনেত্রী অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে ২১ কোটি টাকা উদ্ধার করে ইডি। এছাড়া এক কোটি ২০ লাখ টাকার গয়না উদ্ধার হয়। অর্পিতাকে গ্রেপ্তার করে ইডি। অর্পিতার আরেকটি বাড়ি থেকে ২৭ কোটি ৯০ লাখের ক্যাশ ও ছয় কেজি সোনা উদ্ধার হয়। অর্পিতা কিছুদিন আগে জামিন পেয়েছেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিধায়ক, নেতা, প্রশাসক গ্রেপ্তার
২০২২ সালের অগাস্টে বিশেষ পরামর্শদাতা কমিটির আহ্বায়ক শান্তিপ্রসাদ সিনহাকে সিবিআই গ্রেপ্তার করে। এসএসসি-র সচিব অশোক সেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আরেক কর্মকর্তা কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়, সুবীরেশ ভট্টাচার্যকেকেও গ্রেপ্তার করা হয়। বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যকে ইডি গ্রেপ্তার করে। সিবিআই আরেক বিধায়ক জীবন কৃষ্ণ সাহাকে গ্রেপ্তার করে। তাদের অনেকেই জামিন পেয়েছেন। উপরের ছবিটি মানিক ভট্টাচার্যের।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ওএমআর শিট কেলেঙ্কারি
নিয়োগ পরীক্ষা হয় ওএমআর(অপটিক্যাল মার্ক রিডার) শিটের মাধ্যমে। ফলে কম্পিউটার এই শিট পড়তে পারে এবং কোনোরকম কেলেঙ্কারি না হয়। কিন্তু ওএমআর শিটে কোনো প্রশ্নের জবাব না দিয়েও চাকরি পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। সিবিআই তদন্তে দেখা গেছে, ওমআর শিট পরে দল করা হয়েছে পরে আদালতে এসএসসি স্বীকার করে কিছু ক্ষেত্রে মার্কস মিলছে না।
ছবি: Subrata Goswami/DW
প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারি
প্রাথমিক স্তরে শিক্ষক নিয়োগের জন্য টেট পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে অভিযোগ ওঠে, টেট পরীক্ষায় পাস না করলেও ৩১০ জনকে চাকরি দেয়া হয়েছিল। এর জন্য এজেন্ট, সাব এজেন্ট নিয়োগ করা হয়েছিল। লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে তারা চাকরি দিয়েছে বলে সিবিআইের অভিযোগ। ২০১৬ থেকে ২০২২ পর্যন্ত তারা সক্রিয় ছিল।
ছবি: Subrata Goswami/DW
২৬ হাজার চাকরি বাতিলের রায়
২০২৪ সালে কলকাতা হাইকোর্ট রায় দেয়, ২০১৬ সালে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল, তাদের চাকরি বাতিল করা হবে। কারণ, এই নিয়োগ প্রক্রিয়াতে জালিয়াতি হয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মামলা সুপ্রিম কোর্টে
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানানো হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট জানতে চেয়েছিল, এই ২৬ হাজারের মধ্যে থেকে যোগ্য ও অযোগ্য প্রার্থীদের আলাদা করা সম্ভব কিনা। এসএসসি জানিয়েছে, সম্ভব। সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত রায় দেয়নি।
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Kachroo
রাজ্যের তিন হাজারের বেশি স্কুলে পড়ুয়া নেই
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের ইউনিফায়েড ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন প্লাস (ইউডিআইএসই+)রিপোর্ট ফর দ্য অ্যাকাডেমিক ইয়ার ২০২৩-২০২৪ প্রকাশিত হয়েছে। সেই রিপোর্ট জানাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের তিন হাজার ২৫৪টি স্কুলে কোনো ছাত্রছাত্রী নেই। সেখানে শিক্ষক আছেন ১৪ হাজার ৬২৭ জন। ভারতে এরকম দুরবস্থা আর কোনও রাজ্যের নেই। আর একজন শিক্ষক আছে এমন স্কুলের সংখ্যা ৬৩৬৬।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বন্ধ হওয়ার মুখে
২০২১ সালে রাজ্যে ৬৪টি স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ২০২২ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেছিলেন, ''বিভিন্ন স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সার্ভে করছি। কেন বন্ধ হচ্ছে, তা জানার চেষ্টা চলছে।'' ব্রাত্য বসু এই কথা বলার দুই বছর পর দেখা যাচ্ছে, রাজ্য়ে আরো কয়েক হাজার স্কুল বন্ধের মুখে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ড্রপ আউটের সমস্যা
রাজ্য সরকারের দাবি, প্রাথমিক ও উত্ত প্রাথমিকে পশ্চিমবঙ্গে ড্রপ আউটের সংখ্যা শূন্য। কিন্তু মাধ্যমিক স্তরে ড্রপ আউটের হার ১৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ, যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ছবি: str/dpa/picture alliance
চাকরিপ্রার্থীদের প্রতিবাদ
মেয়ো রোডে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে এসএসসি চাকরিপ্রার্থীরা তিন বছরের বেশি সময় ধরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। এখনো সেই বিক্ষোভ চলছে। একসময় প্রচুর হবু শিক্ষককে সেই বিক্ষোভে দেখা যেত। এখন সংখ্যাটা কমলেও বিক্ষোভ জারি আছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
অনেকগুলি মঞ্চে প্রতিবাদ
রানি রাসমণির মূর্তির কাছে দশটিরও বেশি প্রতিবাদমঞ্চ আছে। সেখানে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি, প্রাথমিক,. উচ্চপ্রাথমিকের চাকরিপ্রার্থীরা। এখানেও দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ চলছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
এসএফআইয়ের প্রতিবাদ
গত সোমবার বিধাননগরে শিক্ষা দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ দেখান বামপন্থি ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের সদস্যরা। তারা শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর কাছে গিয়ে জানাতে চায়, শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে ব্রাত্য বসু শূন্য পেয়েছেন। কিন্তু পুলিশ তাদের উপর লাঠি চালায়। অন্তত ৮০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাতে তাদের ছাড়া হয়।