গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করতে গিয়ে ৩০ ভাগ নারী শ্রমিক নিরাপত্তাহীনতায় ভু্গছেন৷ নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকার কারণেই তাদের এই শঙ্কা৷ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গার্মেন্টস কারখানায় নারী শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
ওই গবেষণায় এমন চিত্র ফুটে উঠেছে৷ তবে গার্মেন্টস মালিকরা নারী শ্রমিকদের এই শঙ্কার সঙ্গে একমত নন৷ তারা মনে করেন, গার্মেন্টসে কাজ করা শ্রমিকদের ৯৮ ভাগই নারী৷ সেখানে তাদের নিরাপত্তাহীন মনে করার কোন কারণ নেই৷ তাছাড়া কর্মকর্তারা সবসময়ই কারখানা তদারকি করেন৷
মহিলা পরিষদের ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৬ ভাগ নারী শ্রমিকই মনে করেন তাদের আর্থিক নিরাপত্তা নেই৷ তাদের আশংকা যে কোন সময় তারা কাজ হারাতে পারেন৷ অন্যদিকে মালিকদের পক্ষ থেকে নতুন ন্যূনতম মজুরি শতভাগ বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও প্রায় ৪০ শতাংশ নারী শ্রমিক ন্যূনতম মজুরি পাননি বলে জানিয়েছেন৷ অবশ্য শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে অসন্তুষ্টি আগের তুলনায় কমছে৷ এখন দুই-তৃতীয়াংশ নারী শ্রমিক তাদের মজুরি নিয়ে সন্তুষ্ট৷
পোশাক শিল্পে শ্রমশোষণ: ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ
দু মুঠো অন্নের সংস্থান করতে রানা প্লাজায় গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন এগোরো শ-রও বেশি মানুষ৷ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অনেকেরই বাকি জীবন কাটবে দুর্বিষহ কষ্টে৷ পোশাক শ্রমিকদের জীবনের এই নির্মমতার ইতিহাস কিন্তু অনেক দীর্ঘ৷
ছবি: DW/M. Mohseni
বৈশ্বিক শিল্প
প্রতিটি পোশাকে মিশে থাকে শ্রমিকের শ্রম-রক্ত-ঘাম৷ ১৯৭০-এর দশক থেকে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো এশিয়া আর ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিছু দেশ থেকে পোশাক কিনতে শুরু করে৷ খুব কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায় বলে দাম পড়ে কম, লাভ হয় বেশি৷ এমন সুযোগ ছাড়ে তারা! কম টাকায় পণ্য কিনবেন, ছবির মতো পোশক তৈরি হবে মিষ্টির দোকানে – তারপর আবার শ্রমিকের অধিকাররক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ করবেন – তাও কি হয়!
ছবি: picture-alliance/dpa
সবার জন্য পোশাক
বড় আঙ্গিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে, অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই শিল্পবিপ্লবের সময়টাতে৷ এখন বিশ্বাস করতে অনেকের হয়ত কষ্ট হবে, তবে ইতিহাস বলছে, শিল্পবিপ্লবের ওই প্রহরে ব্রিটেনের লন্ডন আর ম্যানচেস্টারও শ্রমিকদের জন্য ছিল আজকের ঢাকার মতো৷ শতাধিক কারখানা ছিল দুটি শহরে৷ শিশুশ্রম, অনির্ধারিত কর্মঘণ্টার সুবিধাভোগ, অল্প মজুরি, কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ – সবই ছিল সেখানে৷
ছবি: gemeinfrei
সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন কর্তৃত্বে
যুক্তরাষ্ট্রেও পোশাকশ্রমিকরা স্বর্গসুখে ছিলেন না সব সময়৷ সেখানেও এক সময় কারখানায় আগুন লাগলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ভেতরে রেখেই সদর দরজায় তালা লাগাতো৷ ১৯১১ সালে তাই নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে পুড়ে মরেছিল ১৪৬ জন শ্রমিক৷ মৃতদের অধিকাংশই ছিলেন নারী৷ মজুরি, কর্মঘণ্টা, কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা – কোনো কিছুই এশিয়ার এখনকার কারখানাগুলোর চেয়ে ভালো ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পোশাক শিল্পে চীন বিপ্লব
পোশাক রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চলছে সবচেয়ে কম খরচে পোশাক তৈরির প্রতিযোগিতা৷ রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থা সবচেয়ে ভালো৷ রপ্তানি সবচেয়ে বেশি, শ্রমিকদের মজুরিও খুব ভালো৷ চীনে একজন পোশাক শ্রমিক এখন মাস শেষে ৩৭০ ইউরো, অর্থাৎ, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শ্রমশোষণ কাকে বলে...
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সুমাংগলি৷ তামিল শব্দ ‘সুমাংগলি’-র অর্থ, ‘যে নববধু সম্পদ বয়ে আনে’৷ এলাকায় পোশাক এবং সুতা তৈরির প্রশিক্ষণের নামে খাটানো হয় প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মেয়েকে৷ দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা হাতে পান ৬০ ইউরো সেন্ট, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় ৬০ টাকা৷ সে হিসেবে মাস শেষে পান ১৮০০ টাকা৷ টাকাটা তাঁদের খুব দরকার৷ বিয়ের সময় বাবাকে তো যৌতুক দিতে হবে!
ছবি: picture-alliance/Godong
অধিকার আদায়ের করুণ সংগ্রাম
কম্বোডিয়াতেও অবস্থা খুব খারাপ৷ ৩ লক্ষের মতো পোশাক শ্রমিক আছে সে দেশে৷ কাজের পরিবেশ আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কেমন? মাসিক বেতন মাত্র ৫০ ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় বড় জোর ৫ হাজার টাকা৷ মালিকের কাছে শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদা প্রাপ্তি সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মিছিলে নেমে শ্রমিকরা মালিকপক্ষের গুলিতে মরেছেন – এমন দৃষ্টান্তও আছে সেখানে৷
ছবি: Reuters
ট্র্যাজেডি
গত ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের রানা প্লাজা ধসে পড়ায় মারা যান ১১শ-রও বেশি তৈরি পোশাককর্মী৷ দেয়ালে ফাটল ধরার পরও সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এতগুলো জীবন শেষ হওয়াকে বিশ্বের কোনো দেশই ভালো চোখে দেখেনি৷ ঘটনার পর জার্মানির এইচঅ্যান্ডএম, কেআইকে এবং মেট্রোসহ বিশ্বের ৮০টির মতো পোশাক কোম্পানি শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারী কারখানাগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷
ছবি: Reuters
আলোয় ঢাকা আঁধার
অভিজাত বিপণিবিতান কিংবা দোকানের পরিপাটি পরিবেশে ঝলমলে আলোয় ঝিকমিক করে থরে থরে সাজানো বাহারি সব পোশাক৷ দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়৷ ক্রেতাদের ক’জনের মনে পড়ে রানা প্লাজা কিংবা অতীতের ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যাহতদের কথা?
ছবি: DW/M. Mohseni
8 ছবি1 | 8
তৈরী পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমই'র সহসভাপতি আনোয়ারুল আজিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘কারখানায় যেখানে ৯৮ ভাগ নারী শ্রমিক কাজ করেন সেখানে তারা নিরাপত্তাহীনতায় কেন ভুগবেন? তাদের কোন অভিযোগ থাকলে তা কর্মকর্তাদের কাছে বলার সুযোগও রয়েছে৷' তাঁর মতে অনেক গবেষণা হয় কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন৷ তিনি বলেন, ‘ওই গবেষণায় বলা হয়েছে শতকরা ৮ ভাগ নারী শ্রমিকের বয়স ১৮ বছরের নীচে৷ আসলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সবগুলো গার্মেন্টসে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, একটি গার্মেন্টসে মাত্র একজন নারী শ্রমিক পাওয়া গেছে যার বয়স ১৮ বছরের কম৷ তাও সে তার মায়ের সঙ্গে ফ্যাক্টরিতে কাজ করে৷ এরকম দু'একটি ক্ষেত্রে হতে পারে৷ কিন্তু প্রশ্ন হল তারা ৮ শতাংশ কোথায় পেলেন আমরা বুঝতে পারি না৷'
শুক্রবার রাজধানীর একটি মিলনায়তনে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে মহিলা পরিষদ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সামিনা লুত্ফা ও ড. জাহিদ চৌধুরী এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন৷ সেখানে বলা হয়, গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র সদস্য এমন ১২টি কারখানার ১,০১৩ জন নারীর উপর এই জরিপ চালানো হয়েছে৷ জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮৭ শতাংশ নারী শ্রমিকের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি৷ জরিপে দেখা গেছে ৯৬ শতাংশ নারী শ্রমিকই ভাগাভাগি করে টয়লেট, গোসলখানা ও রান্নাঘর ব্যবহার করেন৷ এর মধ্যে প্রতি ২২ জন মিলে একটি টয়লেট ব্যবহার করেন৷
প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর বিজিএমইএ'র সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল-আলম চৌধুরী পারভেজ শিশু শ্রমসহ প্রতিবেদনের কয়েকটি বিষয়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন৷ তিনি বলেন, ‘শিশুশ্রম নিরসনে ১৯৯৫ সাল থেকেই বিজিএমইএ চুক্তিবদ্ধ৷ কোন কারখানার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এলে বিজিএমইএ থেকে সদস্যপদ চলে যাবে৷'
তবে প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর ওই আলোচনা সভায় অর্থনীতিবিদ ড. বিনায়ক সেন প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে গার্মেন্টস মালিকদের করছাড়সহ যে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়, তার কতটুকু শ্রমিকদের জন্য ব্যয় হচ্ছে?' তিনি বলেন, ‘সরকার ও বিজিএমইএ'র উদ্যোগে গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকের সংখ্যাসহ কয়েকটি বিষয়ের জন্য একটি সঠিক জরিপ করা দরকার৷' সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ছাড় দেয়া শুল্কের একটি অংশ, কারখানার কমপ্লায়েন্স তহবিল বাবদ একটি অংশ এবং ক্রেতার কাছ থেকেও শ্রমিকের কল্যাণে একটি অংশ আদায় করার উপায় বের করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান ড. বিনায়ক সেন৷
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ শ্রমিকদের পাশাপাশি মালিকদের নিয়েও একটি গবেষণা জরিপ চালানোর আহ্বান জানান৷ তিনি বলেন, ‘মালিকরা কত টাকা আয় করেন, তাদের ওই টাকা কোথায় কোথায় যায় তা নিয়েও একটি জরিপ হওয়া দরকার৷ সুইস ব্যাংক, কানাডা, মালয়েশিয়াসহ কোথায় কত টাকা যাচ্ছে তারও হিসাব আসা দরকার৷' এছাড়া গ্যাস, বিদ্যুত্, জমি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, স্বল্প সুদে ঋণ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেয়ার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান৷