ভোটগণনা শুরু হওয়ার ঘণ্টাদেড়েকের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায়, গুজরাটেবিজেপি তাদের সবচেয়ে ভালো ফল করতে চলেছে। এমনকি ২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি জিতেছিল ১২৭টি আসন। আর এবার তারা এগিয়ে ১৫৮টি আসনে। কংগ্রেস এগিয়ে মাত্র ১৬টি আসনে। আপ পাঁচটিতে। গুজরাট বিধানসভা ভোটে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়ার রেকর্ড এবার ভেঙে দিয়েছে বিজেপি। এর আগে কোনো দল বিধানসভা ভোটে এতগুলি আসনে জেতেনি।
এতদিন পর্যন্ত গুজরাটে বিজেপি-রসঙ্গে কংগ্রেসের লড়াই হতো। কিন্তু এবার গুজরাটে কেজরিওয়ালের আপ খুব গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনে লড়েছে। গত ছয় মাস ধরে কেজরিওয়াল সেখানে প্রচার করেছেন। জনসভা, রোড শো, বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার কিছুই বাকি রাখেননি। এর ফলে বিরোধী ভোট ভাগ হয়েছে। এই ভোটভাগের ফলে কংগ্রেসকে অনেক আসন হারাতে হয়েছে বলে প্রাথমিক ফলের পর দলের নেতারা অনুমান করছেন। গুজরাটে কংগ্রেসের ভোট গতবারের তুলনায় ১৫ শতাংশ কমেছে। আর আপ পেয়েছে ১৪ শতাংশ ভোট। ফলে আপ কংগ্রেসের ভোট অনেকটাই কেটেছে।
কেজরিওয়ালের আশা ছিল, গুজরাটে আপ অন্তত কংগ্রেসকে পিছনে ফেলে দুই নম্বর দল হবে। এখনো পর্যন্ত সেই আশা পূরণ হচ্ছে না। তারা সামান্য কয়েকটি আসনে জিততে পারে। ফলে মোদী-রাজ্যে বিজেপি-কে চ্যালেঞ্জ জানাতে গিয়ে খুব বেশি সাফল্য পাননি কেজরিওয়াল। তবে গুজরাটে আসন জেতাকে যদি বড় সাফল্য বলে ধরা হয়, তাহলে সেই সাফল্য আপ পেতে চলেছে।
দ্বিতীয় আরেকটি কারণ হলো, এবার কংগ্রেস থেকে হার্দিক প্যাটেল-সহ একগুচ্ছ নেতা ও বিধায়ক বিজেপি-তে চলে গেছেন। অল্পেশ ঠাকোরের মতো প্রভাবশালী নেতারাও সেখানে নাম লিখিয়েছেন। ফলে বিজেপি সেই আসনগুলিতে জিতেছে। এভাবেই ২৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পরও বিজেপি রেকর্ড সংখ্যা নিয়ে গুজরাটে ক্ষমতায় আসতে চলেছে। মোদী-শাহ প্রমাণ করে দিয়েছেন, গুজরাটে তাদের দূর্গে ভাঙন ধরাবার ক্ষমতা এখন কংগ্রেস বা আপের নেই। আগামী লোকসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reutersমোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: APদাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNIভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: APভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaনির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd হিমাচলে কংগ্রেস
এমনিতে এই পাহাড়ি রাজ্যের প্রবণতা হলো, সেখানে একবার কংগ্রেস ও একবার বিজেপি ক্ষমতায় আসে। সেইমতো এবার কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসার পালা। কিন্তু দেশজুড়ে কংগ্রেসের যা অবস্থা, তাতে তারা একটি রাজ্যে নিজের জোরে ক্ষমতায় আসছে, তা সাম্প্রতিককালে বিশেষ দেখা যায়নি। কিন্তু হিমাচলে তারা ক্ষমতায় আসছে।
হিমাচলে প্রথমদিকে কংগ্রেস ও বিজেপি-র মধ্যে প্রবল লড়াই চলছিল। কখনো কংগ্রেস এগিয়ে যাচ্ছিল, কখনো বিজেপি। হিমাচলে আপও লড়েছিল। কিন্তু তারা কোনো আসনে এগিয়ে নেই। যত সময় এগিয়েছে, ততই কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপি-র এগিয়ে থাকা আসনের পার্থক্যও বেড়েছে। এখন কংগ্রেস ৪০টি আসনে এগিয়ে, বিজেপি ২৫টিতে। ৩৫টি আসন পেলেই হিমাচলে সরকার গঠন করা যায়। গতবারের তুলনায় কংগ্রেসের আসনসংখ্যা ১৯টি বাড়ছে।
হিমাচলে আপ একটিও আসন পায়নি। তারা কংগ্রেসের ভোটও কাটতে পারেনি। ফলে কংগ্রেসের পক্ষ জয় পাওয়া সহজ হয়েছে।
তবে এখন থেকেই কংগ্রেস নিজের জয়ী বিধায়কদের সুরক্ষিত করার কাজ শুরু করে দিয়েছে। তারা বিধায়কদের চণ্ডীগড়ে নিয়ে যাচ্ছে। কংগ্রেসের আশঙ্কা, এই হারের পরেও বিজেপি কংগ্রেসের বিধায়ক ভাঙিয়ে সরকার গঠনের চেষ্টা করবে। অতীতে এইভাবে বেশ কয়েকটি রাজ্যে কংগ্রেস সবচেয়ে বড় দল হয়েও সরকার গঠন করতে পারেনি।
ফলে নাটকীয় কোনো পরিবর্তন না হলে,গুজরাটে বিপুল জয় পেলেও বিজেপি-র বিজয়রথ পাহাড়ি রাজ্যে আটকে যাচ্ছে।
জিএইচ/এসজি (পিটিআই)