গুজরাট দখলে রাখতে সক্ষম হবে বিজেপি?
১৫ ডিসেম্বর ২০১৭গুজরাট বিধানসভা নির্বাচন শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদী বনাম রাহুল গান্ধী লড়াইয়ে পরিণত হয়েছিল৷ বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সর্বস্ব পণ করে গুজরাট নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রাহুল গান্ধী৷ দাবি করেছিলেন, ‘‘নির্বাচনের ফল দেখে সবাই চমকে যাবেন৷ হৈ হৈ করে জিতবে কংগ্রেস৷'' কিন্তু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রত্যেকটি ‘বুথ-ফেরত সমীক্ষা' ঠিক উল্টোটাই বলছে৷ সমীক্ষা জানাচ্ছে, এবার ভোটের ফলাফলে চমক কিছু নেই৷ গত তিনবারের মতো এবারও নিজের গড় ধরে রাখতে সক্ষম হবেন নরেন্দ্র মোদী৷ আর শুধু গুজরাট নয়, কংগ্রেসের হাত থেকে হিমাচল প্রদেশও ছিনিয়ে নিচ্ছে ভারতীয় জনতা পার্টি৷ এবার কি তবে বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কাছে হার মানবে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতায় ভর করে থাকা কংগ্রেস?
অবশ্য এটা ঠিক যে, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের ঘোষণা মতো ১৫০টি আসন পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হয়নি গুজরাটে৷ মোট ১৮২ আসনের গুজরাত বিধানসভায় বিজেপি মেরেকেটে ১০০ থেকে ১১৫টি আসন পেতে পারে৷ এরপরেও এবারের লড়াইটা খুব তুল্যমূল্য ছিল৷ বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় পর্বের ভোটগ্রহণ মিটতেই এবিপি নিউজ-সিএসডিএস তাদের সমীক্ষা রিপোর্ট পেশ করে৷ তারা বলছে, বিজেপি পাবে ১১৭টি আসন, কংগ্রেস ৬৪টি৷ যার অর্থ ২০১২ সালের ভোটের তুলনায় দু'টি আসন বেশি পাচ্ছে বিজেপি৷ কংগ্রেসের আসনও তিনটি বেড়েছে বটে, কিন্তু তারা লড়াইয়েই নেই৷ বাকি সমীক্ষাগুলির হিসেবে বিজেপি এবার সবচেয়ে বেশি ১৪৬টি এবং সর্বনিম্ন ৯৯টি আসন পেতে পারে৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘যদি গুজরাটে কংগ্রেসের সত্যই পরাজয় ঘটে, তাহলে তার প্রধান কারণ হলো গুজরাটে কংগ্রেসের প্রাদেশিক নেতা না থাকা৷ তাছাড়া মোদী আবারও নিজেকে ‘লার্জার দ্যন লাইফ' প্রমাণ করতে সক্ষম হলেন৷ তবে এতকিছুর পরেও বলতে হয়, কংগ্রেস এবং রাহুল গান্ধী বিজেপি তথা মোদীকে যথেস্ট বেগ দিতে সক্ষম হয়েছে৷ মনে রাখবেন, পশ্চিমবঙ্গে ২০০১ সালেই বামফ্রন্ট সরকার বিদায় নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল৷ কিন্তু শেষে বামেদের সাংগঠনিক শক্তির কাছে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা হার মেনেছিল৷ এক্ষেত্রেও অনেকটা তাই হয়েছে৷''
প্রকাশ্যে অবশ্য এই সমীক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না কংগ্রেস নেতারা৷ পিছিয়ে থাকা দলের নেতারা সাধারণত যেমন বলেন, সেই সুরেই কংগ্রেস নেতা রাজীব শুক্লের মন্তব্য, ‘‘গুজরাটের মানুষ বিজেপির শাসনে ত্রস্ত৷ তাই সমীক্ষার সময়েও ভয়ে সত্যি বলেন না৷'' তাঁর দাবি, গুজরাটে কংগ্রেস ১১০টির মতো আসন পাবে আর হিমাচলে টক্কর কাঁটায় কাঁটায়৷
রাজীবের মন্তব্যকে কটাক্ষ করে বিজেপি নেতা শাহনওয়াজ হুসেন বলেন, ‘‘হারের দায় এখন ভোটারদের ঘাড়ে ঠেলার চেষ্টা করছে কংগ্রেস৷'' সরকারি ফল ঘোষণার আগেই গুজরাটে পরাজয় একপ্রকার মেনে নেওয়ার দিকেই এগোচ্ছে কংগ্রেস৷ শুক্রবার ব্যবহৃত ভিভিপ্যাটের ২৫ শতাংশ ‘ক্রশ চেক' করার আর্জি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন গুজরাট প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি ভরতসিং সোলাঙ্কি৷ সুপ্রিম কোর্ট সেই আর্জি খারিজ করে দিয়েছে৷ তবে এখানে প্রশ্ন উঠেছে, কংগ্রেস নেতারা মুখে বুথ ফেরৎ সমীক্ষায় ভরস আনা থাকার কথা বললেও মনে মনে তা বিশ্বাস করছেন৷ তা না হলে ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট নিয়ে সন্দেহ হলো কেন কংগ্রেসের? জয়ের ব্যাপারে নিশ্চয়তা থাকলে ফল ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করল না কেন কংগ্রেস?
গুজরাটের সংবাদমাধ্যমগুলি অবশ্য অন্য কথা বলছে৷ তাদের মতে, বিজেপির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে কংগ্রেস৷ একটি চ্যানেল তো আবার কংগ্রেসকে জিতিয়েই দিয়েছে৷
বুথ ফেরৎ সমীক্ষা না মেলার উদাহরণও অবশ্য আছে৷ বিহারে বুথ-ফেরত সমীক্ষা মেলেনি৷ আম আদমি পার্টির নেতারাও বলছেন, দিল্লিতে তো ডাহা ফেল হয়েছিল সমীক্ষা৷ প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশি এ দিনও টুইট করে বলেছেন, ‘‘আমি বরাবরই বলে এসেছি, দায়িত্বে থাকার সময়েও বলেছি — কেবলমাত্র মনোরঞ্জন চ্যানেলগুলিতেই বুথ-ফেরত সমীক্ষা সম্প্রচার করা উচিত৷'' তবে ভোটারদের মনোভাব বুঝতে এই ধরনের সমীক্ষা করা হয়ে থাকে৷
হিমাচলেও বিজেপির জয় দেখছে সব সমীক্ষা৷ এবিপি নিউজের মতে, ৬৮ আসনের বিধানসভায় ৩৮টি আসন পাবে বিজেপি৷ কংগ্রেস ২৯টি৷ বাকি সমীক্ষাগুলি বিজেপিকে আরও অনেকটাই এগিয়ে রেখেছে৷ একটি সমীক্ষার মতে, বিজেপি ৬২টি আসনও পেয়ে যেতে পারে৷
সোমবার ভোটবাক্স খোলার পরে যদি এই ছবিই বহাল থাকে, তা হলে মোট ১৯টি রাজ্যে ক্ষমতায় আসবে বিজেপি৷ সামনের বছর আরও কয়েকটি বিধানসভা ভোট এবং ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে যা আরও অক্সিজেন জোগাবে মোদীকে৷ আর শনিবার আনুষ্ঠানিক ভাবে কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব নিতে চলা রাহুলের পক্ষে সেটা হবে বড়সড় ধাক্কা৷ তিনি গুজরাতে জয়ের স্বপ্ন অতি বড় কংগ্রেস সমর্থকও দেখছিলেন না৷ তাঁদের আশা ছিল, বিজেপিকে একশ'র নীচে বেঁধে রাখা যাবে৷
প্রশ্ন হলো, মাত্র দশ দিন আগেও গুজরাটে বিজেপির দ্রুত জমি হারানোর যে ছবি জনমত সমীক্ষায় উঠে এসেছিল, তা আজ উল্টে গেল কী করে? সমীক্ষকদের মতে, পাতিদার আন্দোলনের জেরে বিজেপিকে খেসারত দিতে হলেও সব পাতিদার কংগ্রেসের সঙ্গে যাননি৷ আবার কংগ্রেস পাতিদারদের সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির ক্ষোভকে সুকৌশলে কাজে লাগিয়েছে বিজেপি৷ রাহুলের প্রচার সত্ত্বেও যুব ভোট পুরোপুরি হাতছাড়া হতে দেয়নি তারা৷ আর শেষ বাজারে মোদীর ঝোড়ো প্রচার ফারাক গড়েছে৷
এদিকে নির্বাচনের শেষ দফায় বিতর্কে জড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী৷ নিজের বুথে গিয়ে ভোট দেওয়ার পর নরেন্দ্র মোদী ‘রোড শো' করেছেন৷ তাই নিয়ে আবার জাতীয় রাজনীতি উত্তাল৷ মোদীকে বেকায়দায় ফেলতে আসরে নেমেছে কংগ্রেস৷ বিধিভঙ্গের অভিযোগ তুলেই রাহুল গান্ধীর দল ক্ষান্ত হয়নি৷ তাদের নিশানায় নির্বাচন কমিশনও৷ কংগ্রেসের অভিযোগ, ‘‘নির্বাচন কমিশন আসলে বিজেপির হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে৷''