মাটি খুঁড়ে পাওয়া তিন-তিনটি লোহার সিন্দুক নিয়ে প্রত্যাশা এবং জল্পনা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতাকে নিয়ে গিয়েছিল কৈশোরের কল্পনার রাজ্যে৷ কিন্তু সেটা ফের বাস্তব জগতে ফিরিয়ে আনবে বলেই৷
বিজ্ঞাপন
গুপ্তধন নিয়ে মানুষের কল্পনা চিরকালই যুক্তি-বুদ্ধির বাঁধনছাড়া৷ যদিও এমন একটা সময় সত্যিই ছিল, যখন গুপ্তধন উদ্ধার ছিল একটা বাস্তব ঘটনা৷ সে মিশরের পিরামিডের অভ্যন্তরের গুপ্ত কক্ষে লুকিয়ে রাখা সোনা হোক বা ইনকাদের লুকনো সোনার ভান্ডার, ডাকাতির ভয়ে মাটির তলায় পুঁতে রাখা বিত্তবানের সঞ্চয় হোক বা মাঝসাগরের কোনো নির্জন দ্বীপে জলদস্যুদের লুকিয়ে রাখা লুঠের মাল – একটা সময় দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা এই সব গুপ্তধনের হদিস পেতেন৷ হঠাৎ খুঁজে পাওয়া যেত গভীর সমুদ্রে সলিল সমাধি হওয়া জলদস্যু জাহাজের গর্ভে সঞ্চিত থাকা সোনা৷ অথবা কোনো পুরনো রাজপ্রাসাদের পাতাল ঘর বা ধর্মস্থানের গুপ্ত গর্ভগৃহ থেকে আবিষ্কৃত হত গুপ্তধন! আর সেইসব ঘটনা থেকে জন্ম নিত গল্প, গুজব, রটনা৷ সাহিত্য থেকে সিনেমা, বহু কাহিনিই একসময় তৈরি হয়েছে সেই কল্পনাকে আশ্রয় করে৷
প্রচণ্ড গরমে কাহিল কলকাতা
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় সপ্তাহান্তে পারদ চড়েছে প্রায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস! সেখানকার মানুষ কীভাবে এই গরমের মোকাবিলা করছে, ছবিঘরে রয়েছে তারই কিছু দৃশ্য৷
মজার কথা হচ্ছে, আধুনিক সময়ও সেই গুপ্তধনের স্বপ্নের হাতছানিকে অস্বীকার করতে পারে না৷ সম্ভবত সেটাই হয়েছিল ছয় বছর আগে, দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাট অঞ্চলে একটি জমি খুঁড়তে গিয়ে শ্রমিকের শাবল-গাঁইতি শক্ত কিছুতে লেগে ঠং করে আওয়াজ তুলেছিল! গুপ্তধনের নানা সত্যি-মিথ্যে গল্পের কল্যাণে মাটির তলা থেকে এই ধাতব শব্দ পাওয়ার পরবর্তী ঘটনাগুলো সবার জানা৷ কাজেই সবাই ভেবে নিলেন, এর পরেই মাটি খুঁড়ে পাওয়া যাবে সোনার মোহরে বোঝাই পিতলের ঘড়া অথবা স্বর্ণালংকারে ভর্তি সিন্দুক অথবা হয়ত আরও দুর্মূল্য কোনো প্রত্নদ্রব্য৷ কী আশ্চর্য, হলোও তাই! মাটির গভীরে পুঁতে রাখা, একটি নয়, তিন তিনটি দশাসই চেহারার লোহার সিন্দুক উদ্ধার হলো সেখান থেকে৷ তিনটি সিন্দুকই এমন ভারি যে ‘ক্রেন' আনতে হলো তাদের জমিতে তুলে আনার জন্য৷
এবার, যে জমিটি খোঁড়া হচ্ছিল, সেটি তার কিছুদিন আগেই হাতবদল হয়েছিল৷ পুরনো মালিক যিনি, সিন্দুক উদ্ধারের খবর পেয়েই তিনি দৌড়ে আসেন এবং সিন্দুক তিনটির মালিকানা দাবি করেন৷ এদিকে যিনি জমিটি কিনেছেন, তিনি উদ্ধার হওয়া সিন্দুকের দখল ছাড়তে রাজি নন৷ কারণ দুজনেই নিঃসন্দেহে ভাবছিলেন, মাটিতে পোঁতা সিন্দুক যখন, গুপ্তধন না হয়ে যায় না! ওঁদের ঝগড়া থানা-পুলিশ এবং আদালত পর্যন্ত গড়ায়৷ মামলা চলে পরের ছয় বছর ধরে, সিন্দুক জমা থাকে গড়িয়াহাট থানার জিম্মায়৷ নিয়মিত আদালতে দৌড়োদৌড়ি এবং উকিলের পিছনে লক্ষাধিক টাকা খরচ করার পর, সম্প্রতি মামলার রায় যায় ওই জমির পুরনো মালিকের পক্ষে৷ কিন্তু সিন্দুকে রক্ষিত সম্পদ যে আসলে কী, তা কারো জানা না থাকায় আদালত নির্দেশ দেয় ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ বিভাগ, বা আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এবং ভূতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ বিভাগ, অর্থাৎ জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে, গড়িয়াহাট থানায় তিনটি সিন্দুক খুলে দেখা হবে৷
কলকাতার হাতে টানা রিকশার একাল
কলকাতার কোনো কোনো জায়গায় এখনো হাতে টানা রিকশার চল রয়েছে৷ যদিও সংখ্যাটা দিনদিন কমছে৷ আর কতদিন থাকবে? চলুন জানার চেষ্টা করি এই ছবিঘরে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
যবে থেকে শুরু
হাতে টানা রিকশার উদ্ভাবন ১৬ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, জাপানে৷ ১৯ শতকে যানটি গোটা এশিয়ায় বহুল ব্যবহৃত এক গণ-বাহন হয়ে দাঁড়ায়৷ ১৮৮০ সালে ভারতে প্রথম রিকশা চালু হয় হিমাচল প্রদেশের সিমলায়৷ সেখান থেকে হাতে টানা রিকশা চলে আসে কলকাতায়৷ ১৯১৪ সাল নাগাদ কলকাতায় ভাড়াটে রিকশার চলন হয়৷ এরপর এত বছর পরেও কলকাতার কোনো কোনো অঞ্চলে টিকে আছে এই হাতে টানা রিকশা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
প্রধান সড়ক থেকে গলিতে
কলকাতার প্রধান সড়কপথগুলোতে এখন অবশ্য আর রিকশা চলাচলের অনুমতি দেয় না পুলিশ৷ তার প্রথম কারণ রিকশার মতো ধীরগতির যানের কারণে রাস্তায় যানজট তৈরি হয়৷ তবে অন্য আর একটি কারণ হলো, আজকের দিনে রিকশার সওয়ারি হওয়া নিরাপদও নয়৷ ফলে কিছুটা বাধ্য হয়েই রিকশারা আশ্রয় নিয়েছে পুরনো কলকাতার গলি-ঘুঁজিতে, যেখানে ব্যস্ত ট্রাফিকের তাড়াহুড়ো নেই৷ রিকশায় চড়ে দুলকি চালে সফর করাও উত্তর কলকাতার অনেক বাসিন্দারই এখনও পছন্দসই৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
এখনো ব্যবহারের কারণ
আধুনিক কোনো যন্ত্রচালিত যানের সঙ্গে গতি বা স্বাচ্ছন্দ্যে পাল্লা দিতে পারে না আদ্যিকালের রিকশা৷ তা-ও এটি কী করে কলকাতায় থেকে গেল, তার কিছু নির্দিষ্ট কারণ আছে৷ এখনও অনেক বয়স্ক মানুষ রিকশা চড়তে পছন্দ করেন কারণ, এই যানটি তাঁদের জন্য যাকে বলে একেবারে হ্যাসল-ফ্রি৷ ঠিক একই কারণে অনেক বাড়ির বাচ্চারাও স্কুলে যাওয়ার সময় রিকশায় চড়ে যায়৷ তবে কলকাতা শহরে রিকশার সবথেকে বড় উপযোগিতা বোঝা যায় বর্ষায়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
রিকশার ওয়ার্কশপ
যেহেতু শহরের রাস্তায় এখনও রিকশা চলে, মেরামতির জন্য রিকশার নিজস্ব হাসপাতালও নেই নেই করে এখনও দু-একটি টিকে আছে৷ এগুলো বিশেষভাবে হাতে টানা রিকশার মেরামতির জন্যই৷ অন্য কোনও কাজ এখানে হয় না৷ তবে আজকাল অসুবিধে হয়, কারণ রোজগার প্রতিদিনই কমছে৷ কাজ জানা লোকেরও অভাব৷ যদিও বা লোক পাওয়া গেল, তাদের দেওয়ার মতো যথেষ্ট কাজ পাওয়া যায় না৷ দোকানের মালিক শুয়ে বসেই দিন গুজরান করেন৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
কাঠ দিয়ে তৈরি চাকা
রিকশা তৈরি বা মেরামতিতে কিন্তু এখনও সেই পুরনো পদ্ধতিই বহাল৷ রিকশার চাকা যেমন এখনও কাঠ দিয়েই তৈরি হয়৷ মাঝখানের অংশটা যথারীতি লোহার, কিন্তু বাকি চাকার জন্য কারিগরদেরই জোগাড় করে আনতে হয় উঁচু মানের কাঠ যা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা শহরের খানা-খন্দে ভরা এবড়ো খেবড়ো রাস্তা দিয়ে রিকশাকে গড়গড়িয়ে নিয়ে যাবে৷ সওয়ারিকে নিয়ে রিকশা যাতে ভেঙে না পড়ে, তার জন্য ভালো কাঠ বা লোহা যেমন দরকার, তেমনই দরকার ওস্তাদ কারিগর৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
খড় দিয়ে তৈরি বসার গদি
সওয়ারিদের যাতে কষ্ট না হয়, সেজন্যও রিকশাওয়ালারা সমান যত্নবান৷ যাত্রীদের বসার গদিটি যাতে ঠিকঠাক থাকে, এর জন্য নিয়মিত তার পরিচর্যা হয়৷ কাপড় আর রঙিন প্লাস্টিকের তৈরি এই গদির খোলে কী থাকে জানেন তো? না, তুলো বা ফোম নয়, নির্ভেজাল খড়৷ প্রকৃতি-বান্ধব উপাদান ব্যবহার করার এমন নমুনা কি আর কোনো শহুরে যানের ক্ষেত্রে দেখেছেন? রিকশা দূষণ ছড়ায় না, এটাও একটা খেয়াল রাখার মতো বিষয়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
অমানবিক
তবু হাতে টানা রিকশা উঠে যাচ্ছে কলকাতা থেকে৷ কারণ, একজন মানুষ আর একজন মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, এটা অনেকের কাছেই খুব অমানবিক মনে হয়৷ সাইকেল রিকশাতে যদিও একই ঘটনা ঘটে, কিন্তু সেক্ষেত্রে চালক প্যাডেলের মাধ্যমে কিছুটা যান্ত্রিক সুবিধা পান৷ যদিও এই রিকশা নিয়ে রোমান্টিকতার কোনো শেষ নেই৷ পরিচালক বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ ছবির গোটা ক্লাইম্যাক্স সিনটিই গড়ে উঠেছে দুটি হাতে টানা রিকশার রেষারেষির মধ্য দিয়ে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
সময় কি বিদায় নেয়ার?
তাই দিনের শেষে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় যখন ছায়া দীর্ঘতর হয়, আর রাস্তার একধারে স্থবির হয়ে অপেক্ষায় থাকে সওয়ারি না পাওয়া একটি রিকশা, ব্যস্ত শহর তার পাশ দিয়ে ছুটে যেতে যেতে তার কর্কশ কলরবে যেন বারবার মনে পড়িয়ে যায়, এবার সময় হয়েছে বিদায় নেওয়ার৷ আধুনিক সময়ের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না রিকশা৷ সে কারণেই রাজপথ থেকে সরে গিয়ে তাকে মুখ লুকোতে হয়েছে গলিতে৷ খুব শিগগিরই বোধহয় সেই আড়ালটুকুও যাবে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
8 ছবি1 | 8
সংবাধমাধ্যম মারফৎ এবং লোকের মুখে মুখে সেই খবর ছড়িয়ে যায় এবং নির্ধারিত দিন সকাল থেকেই গড়িয়াহাট থানার সামনে ভিড় জমতে শুরু করে৷ সবাই স্বচক্ষে গুপ্তধন উদ্ধার দেখে জীবন সার্থক করতে এসেছে৷ একটা সময় ভিড় এমন বেড়ে যায় যে থানার ফটকের সামনে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়৷ কিন্তু লোকের উৎসাহ তাতে আদৌ কমে না বরং আশেপাশের বাড়ির ছাদে, বারান্দায়, পাঁচিলে, এমনকি থানার পাঁচিলে এবং রাস্তার ধারের গাছেও লোকে চড়ে বসে থাকে৷ তার মধ্যেই সিন্দুক খোলার প্রক্রিয়া শুরু করে পুলিশ৷ প্রথমে শাবলের চাড় দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা হয়, কিন্তু মজবুত লোহার সিন্দুক তাতে এতটুকুও টোল খায় না৷ তখন নিয়ে আসা হয় বৈদ্যুতিক করাত এবং গ্যাস কাটার৷
বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টার পর প্রথম সিন্দুকটি খোলা গেলে, তার ভিতর থেকে পাওয়া যায় একটি কাগজের খামে রাখা কিছু সেলাই করার সূচ৷ আর্কিওলজিকাল সার্ভের বিশেষজ্ঞরা খতিয়ে দেখে জানান, সূচগুলি ইস্পাতের এবং সেগুলি ক্যানাডায় তৈরি৷ আপাতদৃষ্টিতে তাদের আর কোনো বিশেষত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ ওই সূচ ছাড়া তিনটি সিন্দুক থেকে এর পর একে একে বেরোয় কিছু পুরনো চিঠি লেখার কাগজ এবং আরও একটি খামের মধ্যে চারটি পাঁচ টাকার নোট, অর্থাৎ সাকূল্যে মোট কুড়িটি টাকা৷ প্রথম সিন্দুকে সঞ্চিত সূচ ভাণ্ডারের খবর বাইরে আসতেই ভিড় পাতলা হতে শুরু করেছিল, শেষ সিন্দুক যখন খোলা হচ্ছে, তখন বাইরে লোক প্রায় নেই!
জমির সাবেক মালিক কিঞ্চিত হা-হুতাশ করেছেন যে ছয় বছর ধরে মামলা লড়ে, বহু টাকা খরচ করেও গুপ্তধন পাওয়ার স্বপ্নের বেলুনে সূচ ফুটল! তবে সবথেকে হতাশ হয়েছেন বোধহয় ওই মানুষগুলো, যাঁরা, ওই গুপ্তধনের এক কানাকড়ি পাবেন না জেনেও ভিড় করেছিলেন, স্রেফ একটা স্বপ্নপূরণের সাক্ষী থাকতে৷