গুম হওয়া দুই ব্যক্তির পরিবার যা বলছেন
৩০ আগস্ট ২০১৮সাজেদুল ইসলাম সুমন ও তাঁর ছয় বন্ধুকে ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তাঁদের এক বন্ধুর বাসা থেকে তুলে নেয়া হয়৷ ঐ এলাকা থেকে পরে আরো দু'জনকে তুলে নেয়া হয়৷ সুমনের ছোট বোন সানজিদা ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘তাঁদের র্যাব-১ পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়৷ এরপর আমরা র্যাবসহ পুলিশের নানা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেও আমার ভাইকে ফেরত পাইনি৷ আমাদের কোনো মামলা বা জিডিও থানা গ্রহণ করেনি৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমার ভাই ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন৷ তাঁকে ফেরত পাওয়ার সব পথ বন্ধ হওয়ার পর আমরা হাইকোর্টে রিট করি৷ আমার ভাই এবং আরো ছয় জনের ব্যাপারে তথ্য জানাতে র্যাবকে রুলও দেয় হাইকোর্ট৷ কিন্তু তারপরও গত প্রায় ৫ বছরে কোনো খোঁজ মেলেনি৷''
২০১০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর গুলিস্তান মহানগর নাট্যমঞ্চের পেছন থেকে অপহরণ করা হয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বিএনপি নেতা মনির হোসেনকে৷ তিনি দক্ষিণখান বিএনপির সহ সম্পাদক ছিলেন৷ তাঁর ভাই মো. শহীদুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা প্রথমে পল্টন থানায় জিডি ও পরে মামলা করি৷ পরে আমাদের জানানো হয়, র্যাবের একজন কর্মকতা তাঁর বিষয়ে তদন্ত করছেন৷ কিন্তু ঐ পর্যন্তই৷ গত সাত বছরেও আমরা তাঁকে পাইনি৷ বিয়ের মাত্র ৯ মাসের মাথায় আমরা ভাইকে তুলে নিল৷ তাঁকে গুম অথবা হত্যা করা হয়েছে বলে আমার ধারণা৷''
পরিসংখ্যান
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে চলতি বছরের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে অন্তত ৩১০ জন গুমের শিকার হয়েছেন৷ তাদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৪৪ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, ৪৫ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং ৩৩ জন ফেরত এসেছেন৷ বাকিদের কোনো খোঁজ নেই৷
আসকের ভাষ্য মতে, এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন যে, বিশেষ বাহিনী যেমন র্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেয়া হয়েছে৷ কিন্তু প্রায়শই সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেফতার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে৷
অধিকাংশ ক্ষেত্রে থানা এসব ঘটনায় কোনো অভিযোগ নেয় না, স্বজনরা জিডি করতে গেলেও কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম উল্লেখ করা যায় না বলে জানিয়েছে আসক৷ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বা প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ছাড়া খুব কম ক্ষেত্রেই উদ্ধারের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়৷ আবার অনেক ক্ষেত্রে গুম হওয়ার অনেকদিন পর হঠাৎ করেই তাদের কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় বা ক্রসফায়ারে তাদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়, বলছে মানবাধিকার সংস্থা আসক৷
সংস্থাটি আরো বলছে, সৌভাগ্যবশত কয়েকজনকে ফিরে আসতে দেখলেও কী ঘটেছিলো সে সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ নীরবতা বজায় রেখেছেন৷
আসক বলছে, এখন পর্যন্ত পরিবার দ্বারা উত্থাপিত গুমের অভিযোগসমূহের কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি৷ বিভাগীয় তদন্ত হয়েছে কি না সে সম্পর্কেও কোনো তথ্য নেই৷ উচ্চ আদালতের নির্দেশনা, গণমাধ্যম ও মানবাধিকারকর্মীদের ক্রমাগত দাবির ফলে কেবল আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা নারায়ণগঞ্জে সাতজন গুম ও হত্যার বিচারকাজ চলছে৷
আরেকটি মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার' বলছে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ৪৩৫ জন ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে নিয়ে যাওয়া হয়৷ পরে তাদের মধ্যে ৫৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়৷ ২৪৪ জন ফিরে আসেন৷ বাকিদের এখনো কোনো খবর নেই৷
‘স্বজনরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের শিকার হন'
এসব বিষয়ে আসক-এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যাঁরা ফিরে আসতে পারেন তাঁরা চুপচাপ হয়ে যান৷ তারপরও কয়েকজনের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি৷ তাঁরা তাঁদের অপহরণ, রাখার জায়গা এবং তাঁদের সঙ্গে আচরণের যে বর্ণনা আমাদের দিয়েছে তাতে এটা খুবই স্পষ্ট যে, যাঁরা ধরে নিয়ে যায় তাঁরা প্রশিক্ষিত৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘অপহরণের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ব্যবহার করা হয়৷ আর অপহরণের পর তাঁর পরিবারের সদস্যরা থানা পুলিশের কাছে গেলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের শিকার হন৷ মামলা নেয়া হয়না৷ এমকি নানা অপমানজনক কথাও বলা হয়৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে নূর খান বলেন, ‘‘নিখোঁজ বা অপহরণের পর যাঁদের লাশ পাওয়া যায় তা নিয়ে মামলা বা অনুসন্ধান এগোয়না৷ কাঁরা নিলো, কাঁরা হত্যা করলো তা আর বের হয়না, ধামাচাপা দেয়া হয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘রাষ্ট্র এর দায় এড়াতে পারেনা৷ এইসব ব্যক্তি যাঁরা গুম অপহরণের শিকার হয়েছেন, তাঁদের ফিরিয়ে দেয়া বা অবস্থান জানানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সরকারের দায়িত্ব৷''
এ বিষয়ে আপনার কোনো মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷