বাংলাদেশ- মিয়ানমর সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা কয়েক হাজার রোহিঙ্গা তিন দিন ধরে অবস্থান করছে৷ তাঁরা না পারছেন মিয়ানমারে ফিরতে, না পারছেন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে৷ দু’দিকেই তাঁরা গুলির মুখে৷
বিজ্ঞাপন
রাখাইনের বাতি ঢেকিবানিয়ার আমানুল্লাহ তিন দিন আগে গুলির মুখে পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে এসে সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন৷ তাঁরা বাংলাদেশে আসতে চাইলেও ঢুকতে পারছে না৷ রাখাইনেও ফিরতে পারছেন না৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘রবিবার আমাদের গ্রামসহ আশপাশের গ্রামে সেনাবাহিনী হামলা চালায়৷ অনেকেই আহত হয়েছেন৷ কেউ কেউ মারাও গেছেন৷ আমি আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোনোভাবে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছি৷ আমরা এখন তমব্রু সীমান্ত পার হয়ে নো-ম্যান্স ল্যান্ডে আছি৷ এখানে খাবার নাই, থাকার মতো অবস্থা নাই৷ এখানে প্রায় একহাজারের মতো আছি আমরা৷''
Abdul Aziz - MP3-Stereo
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা এখন মিয়ানমারে ফিরলেও গুলি করে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে৷ আবার গুলির মুখে বাংলাদেশেও ঢুকতে পরছি না৷''
মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী এলকায় পালিয়ে আসা মৌলভী শফিউল্লাহ বলেন, ‘‘আমার গ্রামের বাড়ি ঢেঁকিবনিয়ার ফকিরপাড়ায়৷ গত দুই দিন ধরে সেখানে সেনাবাহিনী বর্বর নির্যাতন চালাচ্ছে৷ বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে তরুণদের আটক করে নিয়ে যাচ্ছে৷''
পালংখালী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোজাফফর আহমদ সংবাদ মাধ্যমকে জানান,‘‘সীমান্তে নাফ নদী সংলগ্ন চিংড়ি ঘের থাকায় সেখানে স্থানীয় লোকজনের যাতায়াত তেমন নেই৷ তবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী প্রায় হাজারখানেক রোহিঙ্গা নদীর পারে অবস্থান করছে৷ ওপারে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ৷ শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের কান্নার আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে৷''
ভুলে যাওয়া শরণার্থীরা: বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে রোহিঙ্গারা
গত অক্টোবরে মিয়ানমারে দমনপীড়ন শুরুর পর ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছেন৷ মুসলিমপ্রধান দেশটিতে বর্তমানে পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করছেন৷ কুতুপালংয়ের মতো জনাকীর্ণ ক্যাম্পগুলোতে তাদের অনেকের বাস৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
মিয়ানমার থেকে পালানো
মিয়ানমারে গত অক্টোবরে নয় পুলিশ হত্যার অভিযোগ ওঠে এক রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে৷ তারপর থেকে সেদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর আবারো দমনপীড়ন শুরু হয়৷ ফলে সত্তর হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে৷ তারা যেসব ক্যাম্পে বসবাস করেন সেগুলোর একটি এই কুতুপালং৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
স্বনির্ভরতা দরকার
কুতুপালং ক্যাম্পের শরণার্থীরা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে নিরাপদ আছে বটে, তবে জীবন সেখানে মোটেই সহজ নয়৷ সেখানে সত্যিকারের কোনো অবকাঠামো নেই, সবই শরণার্থীদের গড়া অস্থায়ী আবাস৷ তারা নিজেদের দেশ ছেড়ে এসেছেন, কেননা, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং অসংখ্য মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ করেছে৷ মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে এই তথ্য৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
শিশুদের খেলা নয়
আশ্রয়শিবিরটির অধিকাংশ এলাকায় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই৷ কয়েক হাজার শরণার্থী শিশুর খেলোধুলারও কোন ব্যবস্থা নেই৷ ক্যাম্পের লেক থেকে মাটি সংগ্রহ করছে এই শিশুটি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
কুঁড়েঘরে বসবাস
কাদা মাটি এবং সহজলভ্য অন্যান্য উপাদান দিয়ে ঘর তৈরি করে বাস করেন শরণার্থীরা, যাতে মাথার উপরে অন্তত ছাদ থাকে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস
সেই ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই সেদেশে রোহিঙ্গারা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷ তাদেরকে নাগরিকত্ব এবং ভোট দেয়ার অধিকার দিচ্ছে না সরকার৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
বাংলাদেশেও বৈষম্যের শিকার?
বাংলাদেশেও বৈষম্যে শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা৷ ক্যাম্পে আর জায়গা নেই- বলে বাংলাদেশে জলপথে আশ্রয় নিতে আসা অসংখ্য রোহিঙ্গাকে তাদের নৌকাসহ ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে সীমান্তরক্ষীরা৷ পাশাপাশি কক্সবাজার ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের একটি দুর্গম দ্বীপে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার৷ স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, দ্বীপটি বর্ষাকালে অধিকাংশ সময় পানির নীচে তলিয়ে যায়৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
নির্জন দ্বীপে সরিয়ে নেয়া
ঠ্যাঙ্গার চর বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মেঘনা নদীর মোহনায় কয়েকবছর আগে জেগে ওঠা এক দ্বীপ৷ শুধুমাত্র নৌকায় করে সেখানে যাওয়া যায় এবং চরটিতে অতীতে একাধিকবার জলদস্যু হানা দিয়েছে৷ এক উন্নয়নকর্মী সম্প্রতি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন যে দ্বীপটিতে কর্মসংস্থানেরও তেমন কোনো সুযোগ নেই৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নেই
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী স্বীকার করেছেন যে, ঠ্যাঙ্গার চরকে বসবাসের উপযোগী করতে আরো অনেক কাজ করতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘দ্বীপটিতে উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করার পর রোহিঙ্গাদের সেখানে সরিয়ে নেয়া হবে৷’’ তবে সরকার অতীতে এরকম প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি৷ কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের তেমন কোন উন্নয়ন সাধন করা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
ইতিহাস থেকে মোছার চেষ্টা
নিরাপদ আবাসভূমি না থাকায় রোহিঙ্গাদে ভবিষ্যত ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে৷ অন্যদিকে, মিয়ানমার তাদের অতীত মুছে ফেলতে কাজ করছে৷ দেশটির সংস্কৃতি এবং ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতিহাস বিষয়ক পাঠ্যবই প্রকাশের পরিকল্পনা করেছে যেখানে রোহিঙ্গাদের কথা একেবারেই উল্লেখ থাকবে না৷ গত ডিসেম্বরে মন্ত্রণালয়টি দাবি করেছে, মিয়ানমারের ইতিহাসে কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে কখনো রোহিঙ্গা নামে আখ্যায়িত করা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
9 ছবি1 | 9
এদিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে জড়ো হচ্ছে শত শত রোহিঙ্গা৷ সীমান্তের জিরো লাইনের ছোট ছোট টিলা ও পাহাড়গুলোতে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে সেখানে বসবাস শুরু করেছে দুই হাজারেও বেশি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ৷ তাঁরা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে৷ অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথেই সীমান্তের সরু খাল, জঙ্গল দিয়ে এবং কাঁটাতারের বেড়া গলিয়ে আসছে আক্রান্ত শত শত রোহিঙ্গা নারী ও শিশু৷
সীমান্ত এলাকা সরেজমিন ঘুরে কক্সবাজারের সাংবাদিক আব্দুল আজিজ ডয়চে ভেলেবে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের ১৮টি পয়েন্টে কমপক্ষে ২০ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন৷ তাঁরা বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করলেও বিজিবি তাঁদের জিরো পয়েন্টে ফেরত পাঠাচ্ছে৷ তাঁরা খোলা আকাশের নীচে না খেয়ে অবস্থান করছেন৷''
সোমবার মিয়ানমারকে সীমান্তে সন্ত্রাসবিরোধী যৌথ অভিযান চালানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ৷ মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত অং মিন্টকে পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ে ডেকে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হয়েছে৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মঞ্জুরুল করিম সরকারের পক্ষ থেকে এই চিঠি দেন৷ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে দুই বার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হলো৷
Amanullah - MP3-Stereo
এই আনুষ্ঠানিক পত্রে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় যৌথ অভিযানের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ৷ এতে দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনী জঙ্গি, আরাকান আর্মি এবং অন্য যে কোনও অরাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে কাজ করবে৷
এদিকে বিজিবি'র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন জানিয়েছেন,‘‘মিয়ানমার সীমান্ত সিল করে দেয়া হয়েছে৷ পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রতি বিজিবি'র সদস্যরা মানবিক আচরণ করছেন৷ মিয়ানমার সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে মোকাবেলা করা হচ্ছে৷''