নিজস্ব সংগঠন গড়লেন পশ্চিমবঙ্গের গৃহপরিচারিকারা, পেলেন শ্রম দপ্তরের স্বীকৃতি৷ কিন্তু কর্মী সংগঠন হিসেবে এই ‘শিরোপা' কি তাদের আদৌ সাহায্য করবে? প্রশ্ন উঠছে৷
বিজ্ঞাপন
প্রতিদিন রাতভোরে ট্রেনে চড়ে ওঁরা এসে পৌঁছান কলকাতা শহরে৷ প্রধানত দক্ষিণ ২৪ পরগণার বাসিন্দা সবাই৷ ক্যানিং, গোসাবা, নামখানা, লক্ষ্মীকান্তপুর৷ট্রেন খালি হতে থাকে গড়িয়ায়, যাদবপুরে, ঢাকুরিয়ায়, বালিগঞ্জ আর শিয়ালদা স্টেশনে৷ সুসংহত এক সেনাবাহিনীর মতো ওঁরা ছড়িয়ে যান বিভিন্ন পাড়ায়, চলে যান বহুতল আবাসনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটের নির্দিষ্ট ঠিকানায়, যা ওঁদের কর্মক্ষেত্র৷ শহুরে বাবুরা শিয়ালদা দক্ষিণ শাখার ওই ভোরের লোকাল ট্রেনকে ব্যাঙ্গ করে বলেন, ‘ঝি স্পেশাল'৷ কিন্তু ওই বাবুরাও বিলক্ষণ জানেন, একদিন ওই ঝি স্পেশাল না এলে, বা দেরিতে পৌঁছলে, বহু অফিসে কামাইয়ের হিড়িক পড়বে৷ যেহেতু ওই পরিচারিকাদের ভরসাতেই সংসার, বাবা-মা, ছোট ছেলে-মেয়েদের রেখে এই শহরের বহু কর্মরতা গৃহবধূ নিজেদের চাকরি সামাল দেন৷
‘আইন অনুযায়ী একটি জায়গাতেই দৈনিক সাড়ে আট ঘণ্টার হিসেবে কাজ করতে হবে’
অথচএই পরিচারিকারা এখনও বিরাট এক দল অসংগঠিত কর্মী হয়েই রয়ে গেছিলেন৷অসংগঠিত এবং অদক্ষ, যেহেতু রান্নাবান্না, ঝাড়ামোছা, ইত্যাদি ঘরের কাজে দক্ষতা মাপার কোনও একক কোনওদিন ছিল না এবং এখনও নেই৷ যদিও গত এক দশকে একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে৷ বিভিন্ন এজেন্সি বা আয়া সেন্টারের মাধ্যমে এই পরিচারিকাদের কাজে নিয়োগ করছেন অনেকেই৷ ফলে ওদের একটা নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক বেঁধে দেওয়া গেছে এবং সেটাও সময় ধরে, হিসেব কষে৷ এ ধরনের পরিকাঠামো সবসময়ই তার আওতার বাইরের অসংগঠিত ক্ষেত্রে একটা প্রভাব ফেলে৷ পরিচারিকাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ অন্তত ন্যুনতম মজুরি ঠিক করার ক্ষেত্রে এজেন্সির বেঁধে দেওয়া রেট একটা নির্ণায়ক বিষয় হয়েছে৷ সোজা কথায়, মজুরি বেড়েছে পরিচারিকাদের৷
কিন্তু এতদিন গৃহপরিচারিকাদের নিজস্ব কোনো সংগঠন ছিল না, যা তাঁদের শ্রমশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারে৷ ফলে যখন-তখন চাকরি থেকে বরখাস্ত করা থেকে শারীরিক নিগ্রহ, এমনকি যৌন হেনস্থার অভিযোগও শোনা গেছে বিভিন্ন সময়ে৷ অবশেষে সেই অভাবও পূরণ হলো৷ চার বছর আগে তৈরি হওয়া ‘পশ্চিমবঙ্গ গৃহ পরিচারিকা সমিতি' সম্প্রতি রাজ্য শ্রম দপ্তরের স্বীকৃতি পেলো ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে৷ সারা ভারতে এটিই পরিচারিকাদের প্রথম স্বীকৃত কর্মী সংগঠন৷ স্বাভাবিকভাবেই খুশিতে উদ্বেল সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত পরিচারিকারা, যাঁরা মনে করছেন, এতদিনে নিজেদের দাবিদাওয়া জোর গলায় জানানোর একটা আইনসঙ্গত মঞ্চ তাঁরা পেলেন৷
নিজেদের অধিকার সম্পর্কে শ্রমজীবী মানুষদের কথা
বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে খেটে খাওয়া মানুষরা পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রম অধিকার থেকে৷ কয়েকটি ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকারসচেতনতা এবং এ প্রসঙ্গে তাঁদের মতামত জেনে নিন এই ছবিঘরে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
ঝর্ণা আক্তার, পোশাক শ্রমিক
শ্রম অধিকার বলতে আমার কাজের ন্যায্য পারিশ্রমিক পাওয়াকে বুঝি, কিন্তু সেটা আমি পাই না৷ মাসে বেতন পাই ছয় হাজার টাকা, ওভার টাইম নিয়ে সেটা নয় হাজার টাকার মতো হয়৷ এই টাকা দিয়ে বহু কষ্টে খেয়ে-পড়ে বেঁচে আছি৷ অনেক সময় বেতন বকেয়া রেখেই চাকরি থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মুকুলি বেগম, গৃহকর্মী
শ্রম অধিকার কী জিনিস তা বুঝি না৷ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে যাই৷ সপ্তাহে কোনো ছুটির দিন নেই৷ ছোটখাট অসুখ-বিসুখ হলেও কাজে যেতে হয়৷ এর বাইরে পদে পদে খারাপ ব্যবহার পেতে হয় বাড়ির মালিকের কাছ থেকে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মোহাম্মদ রিপন, নির্মাণ শ্রমিক
শ্রম অধিকার বুঝি না৷ দিন শেষে পারিশ্রমিক পেলেই খুশি৷ সপ্তাহে সাতদিনই কাজ করি৷ কাজ করলে টাকা পাই, না করলে পাই না৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মোহাম্মদ নূরুদ্দিন, দিনমজুর
শ্রম অধিকার বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই৷ সারাদিন খেটে ৩০০-৪০০ টাকা পাই৷ এ টাকা একটু বাড়লে ভালো৷ এই বাজারে এই টাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
রাশেদ, বাস চালক
শ্রম অধিকার নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই৷ দিনে ১৬ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাই৷ মালিকের টার্গেট পূরণ হওয়ার পর যা পাই, সেটা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
জসিম উদ্দীন, বাসের হেলপার
শ্রম অধিকার হলো কাজের সঠিক পারিশ্রমিক পাওয়া৷ সেটা আমি পাই না৷ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটানা কাজ করি৷ সপ্তাহে একদিনও ছুটি পাই না৷ বাড়ি গেলে কাজ ছেড়ে যেতে হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
আসাদুল, রিকশা-ভ্যান চালক
শ্রম অধিকার কী বুঝি না৷ কাজ করলে টাকা পাই, না করলে পাই না৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মোহাম্মদ রাজু, অটো রিকশা চালক
শ্রম অধিকার হলো আমার কাজের ন্যায্য পারিশ্রমিক পাওয়া৷ আমি সেটা পাই না৷ গাড়ির মালিকের জমা, পুলিশের অযথা হয়রানি, পথে পথে যাত্রীদের দুর্ব্যবহার – এ সব নিয়েই দিন চলে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
সোহেল হাওলাদার, রিকশা চালক
আমাদের আবার অধিকার কী? মানুষ আমাদের মানুষই মনে করে না৷ সবাই ভাড়া কম দিতে চায়৷ অনেক যাত্রীই খারাপ ব্যবহার করে, অনেকে গায়ে হাত তোলে৷ কিন্তু আমাদের কথা বলার কোনো জায়গা নেই৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বাবলু মিয়া, রং মিস্ত্রী
শ্রম অধিকার কী জিনিস বুঝি না৷ কাজ শেষে টাকা পেলেই খুশি৷ সেটা পাইও৷ তবে অনেক ঝুঁকি নিয়ে বড় বড় বিল্ডিংয়ে কাজ করি৷ কোনো রকম দুর্ঘটনা হলে কোথাও থেকে কোনো সাহায্য পাই না৷ কাজ না থাকলে না খেয়ে থাকতে হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
10 ছবি1 | 10
কিন্তু এই ট্রেড ইউনিয়নেরস্বীকৃতি কি গৃহ পরিচারিকাদের সব সমস্যার সমাধান খুঁজে দেবে? তেমনটা মনে করছেন না প্রবীণ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচিত তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়৷ বহু বছর ধরে রাজ্যের একাধিক ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত শোভনদেব ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন, এর যেমন ভালো দিক আছে, তেমন খারাপ দিকও আছে৷ এই গৃহ পরিচারিকারা অনেকেই এতদিন একাধিক জায়গায় কাজ করে বেশ ভালো রোজগার করেছেন৷ যে যত খাটতে পেরেছেন, তাঁর রোজগার তত বেশি হয়েছে৷ এবং এই রোজগারের অঙ্কটা অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য রাজ্য সরকারের বেঁধে দেওয়া ন্যুনতম মজুরির থেকে অনেকটাই বেশি৷ তাঁদের হয়ত প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, বা চিকিৎসার জন্য ইএসআই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল না, যেটা এই ট্রেড ইউনিয়ন স্বীকৃতির পর তাঁরা দাবি করতে পারবেন৷ কিন্তু অন্যদিকে, একাধিক বাড়িতে কাজ করা তাঁদের বন্ধ করতে হবে৷ আইন অনুযায়ী একটি জায়গাতেই দৈনিক সাড়ে আট ঘণ্টার হিসেবে কাজ করতে হবে এবং একমাত্র তখনই শ্রম আইন মোতাবেক তাঁরা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী হবেন৷ কিন্তু সেটা ওই অতিরিক্ত উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিনিময়ে৷
অভিজ্ঞ ট্রেড ইউনিয়ন নেতার বক্তব্যেই স্পষ্ট হলো, এই আইনি জটিলতা অনেকটাই কম করে দেবে শ্রমিক সংগঠনের স্বীকৃতি পাওয়ার প্রাথমিক উচ্ছ্বাস৷ গৃহ পরিচারিকাদের সামনের রাস্তাটা এখনও অনেক লম্বা৷ এখনও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে তাঁদের৷
কেমন আছে অন্য দেশের গৃহকর্মীরা?
বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের অবস্থা কখনই ভালো ছিল না, এখনও নেই৷ তাঁদের রক্ষায় নেই কোনো আইন৷ কিন্তু বিশ্বের আর অন্যান্য দেশে তাঁদের কী অবস্থা? সেই তথ্যই থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/empics/L. Hurley
পাঁচ কোটি ৩০ লক্ষ
২০১৩ সালে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, আইএলও-র এক প্রতিবেদন বলছে, সারা বিশ্বে গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ৫৩ মিলিয়ন৷ এর মধ্যে ৮৩ শতাংশই নারী৷ তবে প্রকৃত সংখ্যাটি যে আরও কয়েক মিলিয়ন বেশি হতে পারে, সে কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷ এদিকে ১৫ বছরের কমবয়সি শিশু গৃহকর্মীদের সংখ্যা আইএলও-র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি – ২০০৮ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৭৪ লক্ষ৷
ছবি: AP
আইনের বাইরে
আইএলও-র প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের গৃহকর্মীদের প্রায় ৩০ শতাংশই শ্রম আইনের সুবিধাবঞ্চিত৷
ছবি: DW
সাপ্তাহিক ছুটি
বিশ্বের প্রায় অর্ধেক (৪৫ শতাংশ) গৃহকর্মী সাপ্তাহিক ছুটি পান না৷ তাছাড়া তাঁদের এমন কোনো বার্ষিক ছুটি নেই, যার জন্য তাঁদের অর্থ প্রাপ্য (পেইড লিভ)৷
ছবি: DW/M. Krishnan
প্রসূতি সুরক্ষা
প্রতি তিনজনের একজন গৃহকর্মী এই সুবিধা পায় না বলে জানিয়েছে আইএলও৷
ছবি: Sam Panthaky/AFP/Getty Images
বছরে ৮ বিলিয়ন ডলার!
গৃহকর্মী মানেই যেন কম টাকা দিয়ে বেশি ঘণ্টা কাজ করানো৷ এভাবে গৃহকর্মীদের প্রতারিত করে তাঁদের নিয়োগদাতারা অবৈধভাবে বছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে বলে জানিয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স ফেডারেশন’৷
ছবি: imago/imagebroker
‘কাফালা’ যেন দাসপ্রথার অন্য রূপ
গাল্ফ দেশগুলোতে এই ব্যবস্থা থাকার কারণে গরিব দেশ থেকে সেখানে যাওয়া গৃহকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হলেও তাঁদের নিয়োগদাতাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারে না৷ কারণ কাফালা ব্যবস্থার কারণে নির্যাতিতরা চাইলেও নিয়োগদাতার ছাড়পত্র ছাড়া দেশ ত্যাগ করতে পারেন না৷ ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন’ এই অবস্থাকে দাসত্বের সঙ্গে তুলনা করেছে৷ আইএলও-র হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ২১ লক্ষ৷
ছবি: AP
হংকংয়ে গৃহকর্মীদের অবস্থা
তিন হাজার গৃহকর্মীর উপর চালানো এক জরিপে উত্তরদাতাদের প্রায় ৫৮ শতাংশ বলেছে, তাঁদের মৌখিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে৷ ১৮ শতাংশ তাঁদের উপর শারীরিক নির্যাতনের কথা বলেছে৷ আর যৌন হয়রানির কথা জানিয়েছে ৬ শতাংশ৷
ছবি: Miguel Candela/TRANSTERRA
বাড়ি তো নয়, যেন কারাগার!
উন্নত দেশ অস্ট্রেলিয়াতেও ভালো নেই গৃহকর্মীরা৷ ২০১৪ সালের এক প্রতিবেদনে সেখানে গৃহকর্মীদের সর্বোচ্চ ১৬ ঘণ্টা কাজ করানো, বেতন না দেয়া ও শারীরিক নির্যাতনের কথা বলা হয়েছে৷ প্রতিবেদনে অস্ট্রেলিয়ার ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়িগুলোকে ‘কারাগার’-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে৷
ছবি: Fotolia/apops
একা বাড়ির বাইরে নয়
না, ছোট্ট শিশুদের কথা বলা হচ্ছে না৷ ইংল্যান্ডের মতো দেশে প্রায় ৬০ শতাংশ গৃহকর্মীদের একা বাড়ির বাইরে যেতে দেয়া হয় না বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা ‘কালায়ন’৷