বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় নীতিমালা অনুমোদন করলেও, তাঁদের বেতন কঠামো নিয়ে তাতে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি৷ অথচ গৃহকমীদের সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের বেতন কাঠামো নির্ধারণের ব্যাপারেও দাবি জানিয়ে আসছিল৷
বিজ্ঞাপন
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম গৃহকর্মীদের বিষয়ে সুরক্ষা নীতিমালা তৈরি করল৷ গত ২২শে ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে পাশ হওয়া এই নীতিমালা অনুযায়ী, বাংলাদেশের গৃহকর্মীরা সবেতন ১৬ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন৷ কোনো গৃহকর্মী যৌন হয়রানি ও নির্যাতন, শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করলে সরকারকে সেই মামলা পরিচালনার খরচ দিতে হবে৷ এছাড়া গৃহকর্মীদের সহায়তার জন্য ‘হেল্পলাইন' চালু করবে সরকার৷
বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের দুর্দশার কথা
পশ্চিমা বিশ্ব যখন ঘরের কাজে রোবট ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে, বাংলাদেশে তখনও ঘরের কাজ করছেন গৃহকর্মীরা৷ মাসে তাঁদের গড় বেতন ৫১০ টাকা, কাজ করতে হয় কমপক্ষে দশ ঘণ্টা৷ আর ঘুমাতে হয় রান্না ঘরের মেঝেতে৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/Godong
মাসিক বেতন ৫১০ টাকা
পশ্চিমা বিশ্ব এখন ঘরের কাজে রোবট ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে৷ এই নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা৷ তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন৷ সেদেশে ঘরের কাজের জন্য অধিকাংশ বাড়িতে রয়েছেন গৃহকর্মী৷ যাঁদের মাসিক গড় বেতন ৫১০ টাকা৷ আর দিনে কাজ করতে হয় কমপক্ষে দশ ঘণ্টা৷
ছবি: imago/Michael Westermann
৮৩ শতাংশ নারী
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন বা আইটিইউসি ২০১২ সালে বাংলাদেশের গৃহকর্মীদের নিয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করেছে৷ এতে দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র ঢাকা এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে গৃহকর্মীর সংখ্যা বিশ লাখের মতো৷ এঁদের মধ্যে ৮৩ শতাংশ নারী, যাঁদের অনেকে বয়সে শিশু কিংবা তরুণী৷
ছবি: imago/imagebroker
মেঝেতে ঘুমানো
আইটিইউসি-র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গৃহকর্মীদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ রাতে রান্নাঘরে ঘুমান৷ এছাড়া বসার এবং শোয়ার ঘরের মেঝেতে ঘুমান গড়ে ২০ শতাংশ করে গৃহকর্মী৷ কারো কারো আবার ঘুমাতে হয় স্টোর রুমে৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
অন্যায়, নির্যাতন
অধিকাংশ গৃহকর্মী বা কাজের মেয়ে পড়ালেখার সুযোগ পান না৷ বিনোদনেরও অভাব রয়েছে৷ কমপক্ষে ৫৩ শতাংশ গৃহকর্মীর সঙ্গে বাজে ভাষায় কথা বলা হয়৷ কাজ হারানোর আতঙ্কও কাজ করে তাঁদের মধ্যে৷ যৌন নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীর সংখ্যা ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Fotolia/Miriam Dörr
প্রাণহানি
২০০১ থেকে ২০১০ সাল সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে কমপক্ষে ৩৯৮ গৃহকর্মী প্রাণ হারিয়েছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ লেবার স্টাডিজ বা বিলস৷ এছাড়া নির্যাতনে আহত গৃহকর্মীর সংখ্যা ২৯৯৷ আইটিইউসি-র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বাংলাদেশ বিষয়ক বিভিন্ন তথ্যের উৎস বিলস এবং ‘গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক’৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Fotolia/GrafiStart
জনসচেতনতা সৃষ্টি
গৃহকর্মীদের অধিকারের বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে বিভিন্ন উদ্যোগও রয়েছে বাংলাদেশে৷ ‘গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক’ এক্ষেত্রে সক্রিয়৷ এই নেটওয়ার্ক ১৪ বছরের কম বয়সিদের গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে৷
ছবি: imago/epd
ঘরে আটকে রাখা নয়
বাংলাদেশের বিভাগীয় শহরগুলো অনেক সময় গৃহকর্মীদের ঘরের মধ্যে রেখে বাইরে থেকে বাড়িতে তালা দিয়ে রাখা হয়৷ ‘গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক’ এই কাজের তীব্র বিরোধীতা করেছে৷ গৃহকর্মীদের সুরক্ষা নীতির আওতায় এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে নেটওয়ার্কটি৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: TAUSEEF MUSTAFA/AFP/Getty Images
শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি
গৃহকর্মী বা গৃহশ্রমিকদের ‘শ্রমিক হিসেবে’ স্বীকৃতি ও শ্রম আইনে তাঁদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করারও দাবি জানিয়েছে ‘গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক’৷ ‘বাংলাদেশ লেবার অ্যাক্ট-২০০৬’-এ গৃহকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/Godong
8 ছবি1 | 8
শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক ২২শে ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকের সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘এই নীতিমালার আলোকে পরে আইন করা হবে৷'' তিনি জানান, ‘‘নীতিমালাটি বাস্তবায়নে শ্রমমন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি তদারকি সেল থাকবে৷ কোনো গৃহকর্মী বঞ্চনা বা নির্যাতনের শিকার হলে মনিটরিং সেল, মানবাধিকার ও শ্রমিক সংগঠনের কাছে টেলিফোনে, মৌখিক বা লিখিতভাবে অভিযোগ করতে পারবেন৷''
নীতিমালার প্রধান বিষয়গুলো হলো – ১. গৃহকর্মীর সুরক্ষা, ২.সবেতন ১৬ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি, ৩. চাকরি ছাড়লে বা বিদায় করলে এক মাসের আগাম নোটিশ, ৪.গৃহকর্মী নিয়োগ দেয়ার পর তাঁর ছবিসহ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করা, ৪. সরকার হেল্পলাইন করবে, মামলার খরচ দেবে, ৫. শ্রমমন্ত্রণালয়ের তদারকি সেল থাকবে, ৬. গৃহকর্মীর ন্যূনতম বয়স ১৪, অভিভাবকের অনুমতি মিললে তা ১২ বছর, ৭. গৃহকর্মী ও গৃহকর্তার শাস্তি প্রচলিত আইনে হবে৷
তবে এই নীতিমালায় গৃহকর্মীদের বেতন বা মজুরির ব্যাপারে কোনো স্কেল বা টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি৷ শুধু বলা হয়েছে, ‘‘পূর্ণকালীন গৃহকর্মীর মজুরি যাতে তাঁর পরিবারসহ সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের উপযোগী হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে৷ আর গৃহকর্মীর ভরণপোষণ, পোশাক-পরিচ্ছদ দেওয়া হলে তা মজুরির অতিরিক্ত বলে গণ্য হবে৷''
কাজী সিদ্দিকুর রহমান
নীতিমালা নিয়ে ‘বাংলাদেশ ডোমেস্টিক ওয়ার্কার নেটওয়ার্ক'-এর প্রধান কাজী সিদ্দিকুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকার যে নীতিমালা অনুমোদন করেছে, তাকে আমরা অভিনন্দন জানাই৷ তবে এর মধ্যে অনেক ফাঁক আছে৷ আমাদেরও দাবি ছিল বেতনের বিষয়টি নির্ধারণ করে দেয়া, কিন্তু তা হয়নি৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমরা বরাবরই গৃহকর্মীদের শ্রম আইনের অধীনে আনার দাবি করে আসছি৷ সেটা করা হলে গৃহকর্মীরা শ্রম আইনের সুবিধা পেতেন৷ তাও করা হয়নি৷ ফলে গৃহকর্মীদের বেতনের বিষয়টি মালিকের মর্জির ওপরই রয়ে গেল৷''
সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘‘আমরা নীতিমালাটি পর্যবেক্ষণ করে দেখব৷ এরপর পরবর্তী কর্মসূচী গ্রহণ করব৷''
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ১০ লাখ গৃহকর্মী আছে বলে ধারণা করা হয়৷
আচ্ছা বন্ধুরা, গৃহকর্মীদের যারা নির্যাতন করে, তাদের কী শাস্তি হওয়া উচিত? জানান নীচের ঘরে৷
কেমন আছে অন্য দেশের গৃহকর্মীরা?
বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের অবস্থা কখনই ভালো ছিল না, এখনও নেই৷ তাঁদের রক্ষায় নেই কোনো আইন৷ কিন্তু বিশ্বের আর অন্যান্য দেশে তাঁদের কী অবস্থা? সেই তথ্যই থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/empics/L. Hurley
পাঁচ কোটি ৩০ লক্ষ
২০১৩ সালে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, আইএলও-র এক প্রতিবেদন বলছে, সারা বিশ্বে গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ৫৩ মিলিয়ন৷ এর মধ্যে ৮৩ শতাংশই নারী৷ তবে প্রকৃত সংখ্যাটি যে আরও কয়েক মিলিয়ন বেশি হতে পারে, সে কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷ এদিকে ১৫ বছরের কমবয়সি শিশু গৃহকর্মীদের সংখ্যা আইএলও-র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি – ২০০৮ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৭৪ লক্ষ৷
ছবি: AP
আইনের বাইরে
আইএলও-র প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের গৃহকর্মীদের প্রায় ৩০ শতাংশই শ্রম আইনের সুবিধাবঞ্চিত৷
ছবি: DW
সাপ্তাহিক ছুটি
বিশ্বের প্রায় অর্ধেক (৪৫ শতাংশ) গৃহকর্মী সাপ্তাহিক ছুটি পান না৷ তাছাড়া তাঁদের এমন কোনো বার্ষিক ছুটি নেই, যার জন্য তাঁদের অর্থ প্রাপ্য (পেইড লিভ)৷
ছবি: DW/M. Krishnan
প্রসূতি সুরক্ষা
প্রতি তিনজনের একজন গৃহকর্মী এই সুবিধা পায় না বলে জানিয়েছে আইএলও৷
ছবি: Sam Panthaky/AFP/Getty Images
বছরে ৮ বিলিয়ন ডলার!
গৃহকর্মী মানেই যেন কম টাকা দিয়ে বেশি ঘণ্টা কাজ করানো৷ এভাবে গৃহকর্মীদের প্রতারিত করে তাঁদের নিয়োগদাতারা অবৈধভাবে বছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে বলে জানিয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স ফেডারেশন’৷
ছবি: imago/imagebroker
‘কাফালা’ যেন দাসপ্রথার অন্য রূপ
গাল্ফ দেশগুলোতে এই ব্যবস্থা থাকার কারণে গরিব দেশ থেকে সেখানে যাওয়া গৃহকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হলেও তাঁদের নিয়োগদাতাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারে না৷ কারণ কাফালা ব্যবস্থার কারণে নির্যাতিতরা চাইলেও নিয়োগদাতার ছাড়পত্র ছাড়া দেশ ত্যাগ করতে পারেন না৷ ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন’ এই অবস্থাকে দাসত্বের সঙ্গে তুলনা করেছে৷ আইএলও-র হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ২১ লক্ষ৷
ছবি: AP
হংকংয়ে গৃহকর্মীদের অবস্থা
তিন হাজার গৃহকর্মীর উপর চালানো এক জরিপে উত্তরদাতাদের প্রায় ৫৮ শতাংশ বলেছে, তাঁদের মৌখিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে৷ ১৮ শতাংশ তাঁদের উপর শারীরিক নির্যাতনের কথা বলেছে৷ আর যৌন হয়রানির কথা জানিয়েছে ৬ শতাংশ৷
ছবি: Miguel Candela/TRANSTERRA
বাড়ি তো নয়, যেন কারাগার!
উন্নত দেশ অস্ট্রেলিয়াতেও ভালো নেই গৃহকর্মীরা৷ ২০১৪ সালের এক প্রতিবেদনে সেখানে গৃহকর্মীদের সর্বোচ্চ ১৬ ঘণ্টা কাজ করানো, বেতন না দেয়া ও শারীরিক নির্যাতনের কথা বলা হয়েছে৷ প্রতিবেদনে অস্ট্রেলিয়ার ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়িগুলোকে ‘কারাগার’-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে৷
ছবি: Fotolia/apops
একা বাড়ির বাইরে নয়
না, ছোট্ট শিশুদের কথা বলা হচ্ছে না৷ ইংল্যান্ডের মতো দেশে প্রায় ৬০ শতাংশ গৃহকর্মীদের একা বাড়ির বাইরে যেতে দেয়া হয় না বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা ‘কালায়ন’৷