গৃহশ্রমিক নির্যাতনের বিচার হয় না
১০ জুলাই ২০১৮এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে বাংলাদেশে গৃহকর্মী নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিচার পাওয়ার একটি উদাহরণই এখন পর্যন্ত আলোচিত৷ আর তা হলো গৃহকর্মী আদুরি নির্যাতনের বিচার৷
২০১৩ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর ১১ বছরের শিশু গৃহকর্মী আদুরিকে নির্যাতন করে ঢাকার পল্লবীর ডিওএইচএস এলাকার একটি ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়৷ এ ঘটনায় গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান ও তার মা ইসরাত জাহানকে তখন গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ আদালতে অভিযোগ প্রমাণ হলে ঘটনার চার বছর পর গত বছরের ১৮ জুলাই নওরীন জাহানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করেন আদালত৷ নওরীন জাহান এখন কারাগারে দণ্ড ভোগ করছেন৷ বাংলাদেশ ইন্সটিউট অব লেবার স্ট্যাডিজ (বিলস)-এর সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতানউদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার জানা মতে এই একটি ঘটনায়ই এ পর্যন্ত বিচার পাওয়া গেছে৷''
এই ঘটনায় মামলা এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহে পুলিশের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়৷ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তখনকার কমিশনার বেনজীর আহমেদ নিজে উদ্যোগ নিয়ে আদুরির চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন৷ তার পুনর্বাসনেরও উদ্যোগ নেন৷ কিন্তু অন্য নির্যাতেনের ঘটনাগুলো শেষ পর্যন্ত ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ হয় সমঝোতা হয়েছে অথবা মামলা প্রমাণ করা যায়নি৷
২০১৫ সালে ঢাকায় ১১ বছর বয়সি গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তার হ্যাপিকে মারাত্মকভাবে নির্যাতনের অভিযোগে ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন রাজীব ও তার স্ত্রী জেসমিন জাহানকে গ্রেফতার করে পুলিশ৷ কিন্তু পরের বছর ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আদালত মাহফুজা নির্যাতনের মামলায় ক্রিকেটার শাহাদাত ও জেসমিন জাহানকে বেকসুর খালাস দেন৷ এই দম্পতির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে বলে আদালতের পর্যবেক্ষণে জানানো হয়৷
চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে রাজধানীর শ্যামপুরে লাবনী নামের এক গৃহকর্মীর গায়ে গরম ভাতের মাড় ঢেলে নির্যাতন চালানোর অভিযোগে গৃহকর্ত্রী মারিয়া সুলতানাকে গ্রেফতার করে পুলিশ৷ কিন্তু আদালতে দেয়া কদমতলী থানার চার্জশিটে ওই গৃহকর্মী ছাড়া আর কোনো সাক্ষীর নাম নেই বলে জানা গেছে৷
২৭ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহআলী থানা এলাকার প্রিয়াঙ্কা হাউজিংয়ের একটি বাসায় নির্যাতনের শিকার হন গৃহকর্মী বুলি৷ ওই ঘটনায় গৃহকর্তা এ বি এম হাসানুজ্জামান ও গৃহকর্ত্রী রেহেনা আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ পরে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ওই দু'জনকে আসামি করে ২০১৭ সালের ৪ জুলাই আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে শাহআলী থানা পুলিশ৷ কিন্তু পরে আসামিপক্ষ দুই লাখ টাকার বিনিময়ে বাদীপক্ষের সঙ্গে আপোশ করে ফেলে৷ তবে বুলির পরিবারকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা দেওয়া হলেও বাকিটা এখনও দেয়নি আসামিপক্ষ৷
একই মাসে পল্লবী এলাকা থেকে নির্যাতনের শিকার হয়সাবিনা আক্তার নামের ১১ বছর বয়সি এক শিশু গৃহকর্মী৷ মেয়েটিকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়৷ মেয়েটির শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিল৷ তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি)-এ এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা সিএমএইচে ভর্তি করা হয়৷ সাবিনার অভিযোগের ভিত্তিতে এক সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা নিলেও পরে আর এই মামলার তদন্ত এগোয়নি৷ দায়ী কেউ গ্রেপ্তারও হননি৷
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৪৯টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও মাত্র ৬২টি ঘটনায় বিভিন্ন থানায় নির্যাতন ও অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে৷ বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ লেবার স্টাডিজ-এর ২০১৭ সাল পর্যন্ত হিসাবে গত ১০ বছরে ৯৭৫ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷ ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫১, যার মধ্যে ঢাকায় নির্যাতনের শিকার হয় ৩৪ জন৷ বিলস-এর গবেষণায় বলা হয় শতকরা ৫০ ভাগ গৃহপরিচারিকা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার৷ তাদের ৬০ শতাংশই শিশু৷ আর গত ১২ বছরে অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬০০ গৃহকর্মীর৷ বিপুলসংখ্যক গৃহকর্মী আত্মহত্যা করেছেন৷ এই আত্মহত্যার বিষয়টি স্বাভাবিক আত্মহত্যা মনে করার কোনো কারণ নেই৷
ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে এখন ২৫ লাখ গৃহকর্মী বা গৃহশ্রমিক আছেন৷ তাদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু৷ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ-২০১০ অনুযায়ী দেশে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে এমন শিশুর সংখ্যা ১ লাখ ২৫ হাজার, যাদের বয়স ৫ থেকে ১৭ বছর৷ আর এর মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই মেয়েশিশু৷ সৈয়দ সুলতান উদ্দিন জানান,‘‘ আইএলও-র কয়েক বছর আগের জরিপ অনুযায়ী, ঢাকায় গৃহশ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে চার লাখেরও বেশি৷''
বাংলাদেশে বিলস-এর উদ্যোগে বেশ কিছু এনজিও গৃহকর্মী সুরক্ষা আইনের দাবি জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে৷ ২০১৫ সাল গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা করা হলেও আইন হয়নি৷ সরকারের আইনে গৃকর্মীদের নিয়োগ, মজুরি, কর্মঘণ্টা, বয়স, চিকিৎসা, বিশ্রাম, প্রশিক্ষণসহ তাদের নানা অধিকার এবং তাদের দায়িত্বের কথাসহ আরো অনেক কিছু থাকলেও বাস্তবে এগুলো কাজে আসছে না৷ এগুলো আইন করা ছাড়া বাস্তবায়ন সম্ভব নয়৷ বিলস-এর সৈয়দ সুলতান উদ্দিন বলেন, ‘‘সরকারের আইনে অনীহা আছে৷ তারা মনে করে, গৃহশ্রমিকরা ঘরে কাজ করে, ঘরে ঘরে গিয়ে আইনের প্রয়োগ করা সম্ভব নয়৷ এতে নানা জটিলতা সৃষ্টি হবে৷ বাংলাদেশে প্রচলিত পদ্ধতিতে বহুদিন ধরে গৃহশ্রমিকরা কাজ করে আসছেন৷ এটা হঠাৎ করে পরিবর্তন সম্ভব নয়৷''
বাংলাদেশে গৃহশ্রমিকদের কোনো ট্রেড ইউনিয়ন নাই৷ ফলে তারা সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পান না৷ দাবি-দাওয়া আদায়ে তারা আন্দোলন বা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না৷'' সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আরো বলেন, ‘‘আমাদের দাবির মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন অন্যতম৷ তাদের আইনগতভাবে শ্রমিক হিসেবে ঘোষণা করতে হবে৷ তাহলে তারা শ্রম আইনে সব সুবিধা পেত৷''
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে গৃহশ্রমিকরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হন৷ কিন্তু দুই-একটি ছাড়া বিচার পাওয়ার নজীর নেই৷ এর প্রধান কারণ গৃহকর্মীদের আর্থিক দুর্বলতা এবং সমাজে দুর্বল অবস্থান৷ ফলে নির্যাতনের ঘটনাগুলো চাপ দিয়ে অথবা অর্থের বিনময়ে প্রভাবশালীরা সমঝোতা করে ফেলেন৷ আবার সাক্ষীও পাওয়া যায় না৷ বিচার-ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অনেকের পক্ষেই মামলা পরিচালনা সম্ভব হয় না৷ এছাড়া গৃহকর্মীরা প্রভাবশালীদের গ্রামের বাড়ির আশপাশের৷ তাই সামাজিক অবস্থানের কারণেই নির্যাতনের পর তারা সমঝোতায় বাধ্য হন৷''
গৃহকর্মীদের অধিকার আদায় এবং তাদের ট্রেড ইউনিয়নের জন্য ‘গৃহশ্রমিক নেটওয়ার্ক' নামে একটি সংগঠনে সোচ্চার যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে জাতীয় শ্রমিক জোট-এর যুগ্ম সম্পাদক কাজী সিদ্দিকুর রহমান একজন৷ তিনি বলেন, ‘‘গৃহশ্রমিকদের সংগঠিত করা কঠিন৷ তাঁরা বাসায় বাসায় কাজ করেন৷ কেন্দ্রীয়ভাবে তাঁদের কোনো তালিকা বা ঠিবানা নেই৷ ফলে তাঁরা সম্মিলিতভাবে কোনো কিছুর প্রতিবাদ বা দাবি আদায়ে কাজ করতে পারেন না৷''
তিনি বলেন, ‘‘তাঁরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া থেকে ধর্ষণ ও নানা রকম শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন৷ এছাড়া ঠিকমতো মজুরি না দেয়া, অধিক পরিশ্রম করানো তো আছেই৷ আর এইসব নির্যাতনের কোনো প্রতিকারও পান না তাঁরা৷ কখনো কখনো সমঝোতার ভিত্তিতে নামমাত্র ক্ষতিপুরণ পান৷''
ঢাকা শহরে স্বল্প পরিসরে হলেও গৃহকর্মীদের নিয়োগ এবং কাজ দেয়ার জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান আছে৷ তারা কোনো বাসায় গৃহকর্মী দেয়ার আগে তাদের প্রশিক্ষণ, আইন-কানুন সম্পর্কে ধারণা দেয়৷ আর কোনো বাসায় নিয়োগ দেয়ার সময় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়৷ তাতে বেতন, দায়- দায়িত্বসহ আরো কিছু শর্তের উল্লেখ থাকে৷ গৃহশ্রমিক ডটকম নামে এরকম একটি প্রতষ্ঠিানের সাবেক ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যখন গৃহকর্মী নেয়া হয়, তখন নির্যাতনের আশঙ্কা কম থাকে৷ আমরা তেমন অভিযোগ পাই না৷ গৃহকর্মীর ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র বা চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র আমাদের কাছে থাকে, আমরা তার এক কপি থানায় জমা দেই৷ আবার যিনি গৃহকর্মী নেন, তাঁরও ছবিসহ বিস্তারিত পরিচয় আমাদের কাছে থাকে৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন,‘‘সাধারণত কর্মঘণ্টা বেঁধে দেয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো হয়নি৷ তবে কোনো সমস্যা হলে আমরা তা দেখি৷ তিন মাসের মধ্যে কোনো গৃহকর্মী চলে গেলে রিপ্লেসমেন্ট দেয়া হয়৷ তিন মাসের বেশি হলে নয়৷ আর আমরা মাঝখানে থাকায় নির্যাতনের আশঙ্কা কম থাকে৷''
সাধারণত এই প্রক্রিয়ায় গৃহকর্মী নিতে খরচ বেশি পড়ে৷ এজেন্সিকে এককালীন পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়৷ ফলে সাধারণ বাসা-বাড়ির কাজের চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাজে এখানকার গৃহকর্মীর চাহিদা বেশি৷
গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালায় বলা আছে, ‘‘আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে গৃহকর্মীর মজুরি নির্ধারণ হবে৷ পূর্ণকালীন গৃহকর্মীর মজুরি যাতে তাঁর পরিবারসহ সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে জীবন যাপনের উপযোগী হয়, নিয়োগকারীকে তা নিশ্চিত করতে হবে৷ কমপক্ষে ১৪ বছর বয়সের কাউকে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে৷ তবে ১২ বছর বয়সের কাউকে গৃহকর্মী রাখতে হলে তার আইনানুগ অভিভাবকের সঙ্গে তৃতীয় কোনো পক্ষের উপস্থিতিতে নিয়োগকারীকে আলোচনা করতে হবে৷''
যদি ১২ বছরের শিশুকে নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে যে হালকা কাজ করবে বলা আছে, নীতিমালায় বলা আছে৷ নীতিমালায় স্পষ্ট বলা আছে যে কোনো ধরনের নির্যাতনের ঘটনায় বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে বিচার হবে৷
তবে আইন না হওয়ায় এই নীতিমালার বাস্তবায়ন চোখে পড়ে না৷ সৈয়দ সুলতান উদ্দিন বলেন, ‘‘গৃহকর্মী নির্যাতনের প্রতিকারের ব্যাপারে ঢাকা শহরের পুলিশের ভূমিকা প্রাথমিক পর্যায়ে প্রশংসনীয়৷ মামলা দায়ের, আসামি আটকে তৎপর থাকে পুলিশ৷ কিন্তু তদন্ত থেকে পরবর্তী পর্যায়ে আর এগোয় না৷''
এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য লিখুন নীচের ঘরে৷