গৃহকর্মে বিদেশি গৃহকর্মী
২৯ ডিসেম্বর ২০১৩দক্ষিণ অ্যামেরিকার রোসি টোরেস ১০ বছর ধরে বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই জার্মানিতে বসবাস করছেন৷ তাই তিনি তাঁর নিজের আসল নাম ও দেশের নাম গোপন রেখেছেন৷ পেশায় তিনি একজন টপোগ্রাফার৷ অর্থাৎ প্রকৃতিবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন৷ স্বদেশে অনেকদিন বেকার ছিলেন৷ কিন্তু ছেলের পড়াশোনা, বৃদ্ধ মা-বাবার ডায়াবেটিস ও হার্টের অসুখের চিকিৎসার জন্য টাকার প্রয়োজন৷ তাই বেশ কিছু গৃহস্থালীতে ধোয়ামোছার কাজ করেন তিনি৷ এই অর্থের সিংহভাগই পরিবারকে পাঠিয়ে দেন৷
অনেক শিক্ষিত মানুষ গৃহকর্মী
রোসির মত আরো অনেক শিক্ষিত মানুষ জার্মানির বিভিন্ন গৃহস্থালীতে কাজকর্ম করেন৷ জাপানি সমাজবিজ্ঞানী কিয়োকো শিনোজাকি আন্তর্জাতিক ‘কর্ম অভিবাসী' নিয়ে বখুম ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করছেন৷ ‘‘এইসব মানুষ তাঁদের আসল পেশায় কাজ করতে চান৷ কিন্তু স্বদেশে চাকরি পাওয়া কঠিন এবং ওপরে ওঠার সুযোগও কম৷ অথবা যে বেতন পান তা দিয়ে সংসার চালানোও কঠিন৷''
তাই তাঁরা স্বদেশে শিক্ষক বা ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ না করে জার্মানিতে মানুষের বাড়িতে কাজ করেন৷ জার্মানিতে জীবনযাত্রার মান উঁচু বলে তাঁরা অতি সাদামাটাভাবে বসবাস করেন৷ আয়ের অধিকাংশই পরিবারকে পাঠিয়ে দেন৷
অনেকে সন্তানসন্ততি রেখে বিদেশে কাজ করতে আসেন৷ পরবর্তী প্রজন্ম ভালভাবে কাটাতে পারবে এটাই তাঁদের আশা৷ স্বদেশে আত্মীয়স্বজন বা আরো দরিদ্র দেশ থেকে আসা গৃহকর্মী তাঁদের বাচ্চাদের দেখাশোনা করেন৷ এইভাবে একটা চক্র গড়ে ওঠে৷ যেমন, পোল্যান্ড থেকে আসা কেউ যখন জার্মানিতে বৃদ্ধদের সেবা শুশ্রূষা করেন, তখন স্বদেশে তাঁর নিজের বাচ্চাদের দেখাশোনা করেন ইউক্রেনের কোনো মেয়ে৷
ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ
মোবাইল টেলিফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আজকাল একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগটা অক্ষুন্ন রাখা যায়, বলেন শিনোজাকি৷
ছেলেমেয়েরা দূর থেকেও মার সান্নিধ্য চায়, চায় উপদেশ৷ অনেকে ছেলেমেয়েদের স্কাইপের মাধ্যমে লেখাপড়ায় বা হোমটাস্কে সাহায্য করেন৷
রোসি টোরিসও ১০ বছর ধরে তাঁর ছেলের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই স্কাইপের মাধ্যমে কথাবার্তা বলছেন৷ জার্মানিতে থাকার বৈধ কাগজপত্র না থাকায় আশেপাশের শহরে যেতেও শঙ্কাবোধ করেন তিনি৷ দেশে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না৷ তবে শিগগিরই এই অবস্থার পরিবর্তন হবে৷ কম্পিউটারের পর্দা ছেড়ে সরাসরি দেখা হবে ছেলের সঙ্গে৷
‘‘সে ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে গ্রাজুয়েশন শেষ করলো৷ জার্মানিতে এসে মাস্টার্স করার ইচ্ছা তার৷ তারপর ভাল একটি চাকরি খুঁজবে৷ আমরা মা ও ছেলে কয়েক বছর এখানে কাজ করে দেশে ফিরে যাব,'' উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন রোসি৷
পারিবারিক কাঠামো ভেঙে পড়ে
বাবা-মা বিদেশে গৃহকর্মী হিসাবে কাজ করার ফলে স্বদেশে ছেলেমেয়েদের ভাল স্কুল কলেজে পড়ার সুযোগ হয়৷ তবে এমন দৃষ্টান্তও আছে যে মার অনুপস্থিতিতে পারিবারিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে৷
শুধু উত্তর গোলার্ধের ধনী দেশগুলিই যে এই ধরনের অভিবাসী-কর্মীদের আকৃষ্ট করে তাই নয়, দক্ষিণের দেশগুলির পরস্পরের মধ্যেও এই রকম অভিবাসন ঘটে থাকে৷ যেমন হংকং-এর অধিকাংশ গৃহকর্মী ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন্স থেকে আসা৷ এদের অনেকেরই সামাজিক বিমা নেই৷ ৪০ শতাংশের বেতন দেশের ন্যূনতম বেতনের চেয়ে কম৷
স্বদেশে এই অভিবাসী কর্মীদের সম্মানের চোখে দেখা হয়৷ কারণ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে তাঁরা একটা বড় ভূমিকা রাখেন৷ ফিলিপাইন ১৯৭০ সাল থেকে বিদেশে কর্মী পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে৷ এইসব অভিবাসীদের ‘জাতীয় বীর' হিসাবে দেখা হয়৷ এমনকি তারা দেশে ফিরে এলে বিশেষ অভ্যর্থনাও দেওয়া হয়৷
বৈধ কাগজপত্র ছাড়া অধিকার পাওয়া কঠিন
কিন্তু যেসব দেশে তারা কাজ করেন, সেখানে তাদের সামান্যই অধিকার রয়েছে৷ সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা একটি নীতিমালার উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে গৃহকর্মীরাও তাদের কাজের জন্য যথাযথ বেতন, ছুটি ও স্বাস্থ্যবিমার অধিকার আদায় করতে পারেন৷ শ্রমিক ইউনিয়ন ও নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তারা আরো সংঘবদ্ধ হতে পারেন৷
তবে যারা বৈধ কাগজপত্র নিয়ে গৃহস্থালীতে কাজকর্ম করেন, তারাই শুধু এব্যাপারে লাভবান হতে পারেন৷ কিন্তু বৈধ কাগজপত্র ছাড়া গৃহকর্মীদের অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না অদূর ভবিষ্যতে৷ দেশ ছাড়তে হবে এই ভয়ে কোনো দপ্তরে যেতে চান না তাঁরা৷