1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গৃহহীনদের ঘর নিয়েও ওদের ‘বাণিজ্য’

সমীর কুমার দে
২৭ জানুয়ারি ২০২১

সারাদেশে এ পর্যন্ত ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে বিনামূল্যে জমিসহ সেমিপাকা ঘর দিয়েছে সরকার৷ এই ঘরের জন্যও কারো কারো টাকা দিতে হয়েছে৷ তদন্তেও উঠে এসেছে অভিযোগের সত্যতা৷

ছবি: bdnews24.com

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা মৌলভিবাজারে রাস্তার পাশে জরাজীর্ণ ঝুপড়ি ঘরে বাস করেন জাহেদা বেগম৷ তার ঝুপড়ি ঘরের পাশেই তৈরি হয়েছে ৫০টি সেমিপাকা ঘর৷ এর একটিতে ওঠার কথা ছিল জাহেদার৷ কিন্তু ১০ হাজার টাকা দিতে না পারায় ঘরের বরাদ্দ পাননি তিনি৷

কে টাকা চেয়েছিল? জাহেদা বলেন, ‘‘জাহাঙ্গীর আলম নামে এক ব্যক্তি ঘর বরাদ্দের জন্য ১০ হাজার টাকা দাবি করেছিল৷ কিন্তু টাকা দিতে না পারায় ঘর পাইনি৷ তাছাড়া মালামাল বহন খরচের টাকাও দিতে পারিনি৷ বিনা টাকার ঘর, টাকা দিয়ে কেন নিতে হবে? শুনেছি, যারা টাকা দিয়েছে তারাই ঘর পেয়েছে৷’’

কে এই জাহাঙ্গীর? কেনই বা তিনি গৃহহীনদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন? অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির হ্নীলা মৌলভীবাজারের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি তিনি৷ শুধু জাহেদা বেগম নয়, আরো অনেকের কাছ থেকেই টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে৷ তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠার পর টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন৷ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে তিন সদস্যের এই কমিটি ইতিমধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমাও দিয়েছে৷ সেখানে ৯ জনের কাছ থেকে ১ লাখ ৩৩ হাজার টাকা নেওয়ার প্রমান পেয়েছেন কমিটির সদস্যরা৷ কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে সোমবার টেকনাফ থানায় জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে৷ মামলার বাদী টেকনাফ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সিফাত বিন রহমান৷

সিফাত বিন রহমান বলেন, ‘‘জাহাঙ্গীর আলমকে ঘর নির্মাণে তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়নি৷ সে সেখানকার ‘মাঝি'র দায়িত্বে আছে, ফলে তাকে দেখাশোনা করতে বলা হয়েছে৷ কিন্তু কোনো উপকারভোগীর কাছ থেকে ঘর এবং মালামাল বহনের জন্যও কোনো টাকা নেওয়ার নির্দেশনা ছিল না৷ সে রকম কোন নিয়মও নেই৷ তারপরও যখন আমরা অভিযোগ পেয়েছি, তদন্ত করে মামলা করেছি৷ যে কোনো সময় সে গ্রেফতার হবে৷’’ জাহেদা বেগমের ঘর না পাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘যে মিটিংয়ে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ওই মিটিংয়ে জাহেদা বা তার স্বামী ইউনুছ উদ্দিন ছিলেন না৷ ফলে প্রথম দফায় তাকে রাখা যায়নি৷ কিন্তু দ্বিতীয় দফায় যাদের ঘর দেওয়া হবে তার মধ্যে জাহেদা আছেন৷ সে কাজও শুরু হয়েছে৷’’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম মঙ্গলবার বলেন, ‘‘আমি কারো কাছ থেকে টাকা নেইনি৷ শুধু মালামাল বহনের জন্য কিছু টাকা নিয়েছি৷ কারণ, যেখানে এই ঘরগুলো বানানো হয়েছে, সেখানে মালামাল নেওয়া কঠিন৷ তদন্ত বা মামলার বিষয়ে আমাকে কেউ কিছু বলেনি, আমি এসব বিষয়ে কিছু জানি না৷’’

‘যে অভিযোগটি জমা হয়েছে সেটি ভুয়া’

This browser does not support the audio element.

‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, গৃহহীন থাকবে না একটিও পরিবার’- এই স্লোগান বাস্তবায়নে গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপহার হিসেবে প্রথম পর্যায়ে সারাদেশে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারের হাতে জমিসহ ঘরের দলিল তুলে দেন৷

শুধু টেকনাফ নয়, দেশের বেশ কয়েক জায়গায় ঘর দেওয়ার নামে স্থানীয় কিছু প্রভাশালীর বানিজ্যের অভিযোগ উঠেছে৷ ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডেও একই অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে৷ এই ইউনিয়নের সাতগাছিয়া গ্রামের ১৯ জনের কাছ থেকে ১৩ হাজার করে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে৷ এই ১৩ জনের কেউই ঘর পাননি৷ তারা লিখিতভাবে ওয়ার্ড সদস্য রাশেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন৷ অভিযোগে তারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর দেওয়ার জন্য রাশেদুল ইসলাম তাদের কাছ থেকে ১৩ হাজার টাকা করে নেন। কিন্তু টাকা দেওয়ার পরও তারা ঘর পাননি৷

সাতগাছিয়া গ্রামের রাশিদা বেগম বলেন, বাবাকে নিয়ে ঝুপড়ি ঘরে থাকেন তিনি৷ যে ঘরে থাকেন, সেখানে বাস করা যায় না৷ বর্ষার সময় পানি আর শীতে বাতাসের কষ্ট৷ ঘর পাওয়ার আশায় ধার করে ইউপি সদস্যদের কাছে ১৩ হাজার টাকা দিয়েছেন৷ এক বছর পার হলেও ঘর পাননি৷ টাকাও  ফেরত পাচ্ছেন না৷

কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন খান বলেন, ‘‘আমার কাছেও কয়েকজন বলেছেন, রাশেদুল মেম্বার নাকি টাকা নিয়েছেন৷ এখন ইউএনও বিষয়টি দেখছেন৷ তিনিই এর সমাধান করবেন৷’’

জানতে চাইলে কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুবর্ণা রানী সাহা বলেন, ‘‘উপজেলা মৎস কর্মকর্তাকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে কমিটি রিপোর্ট জমা দেবে৷’’

টাকা নেওয়ার অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন রাশেদুল ইসলাম৷ তিনি বলেন, ‘‘২৪ বছর বয়সে আমি মেম্বার নির্বাচিত হয়েছি৷ এখন আমার বয়স ৩০ বছরেরও কম৷ কয়েকদিন পর আমার নির্বাচন৷ এবার যাতে আমি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারি সে কারণে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ৪ জন প্রার্থী এই অভিযোগগুলো বানিয়েছেন৷ কেউ আমার বিরুদ্ধে প্রমান দিতে পারবে না৷ যদি প্রমানিত হয়, আমি টাকা নিয়েছি, তাহলে যে শাস্তি দেওয়া হবে সেটা আমি মাথা পেতে নেবো৷ আমার ধারণা, যে অভিযোগটি জমা হয়েছে সেটি ভুয়া৷’’

একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে বগুড়ার শেরপুরেও৷ সেখানে ১৬৩টি ভূমিহীন পরিবারকে দুই শতাংশ খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়ে একটি সেমি পাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে৷ প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা৷ শেরপুরের কুসুম্বী ইউনিয়নের বাগড়া কলোনী গ্রামের বাছিরন বেগম স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে দেয়া বক্তব্য, ‘‘ঘরের কাজ ভালো করার জন্য পাঁচ বস্তা সিমেন্ট দিয়েছি৷ তাছাড়া ঢালাইয়ের কাজে রডসহ প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ দিতে হয়েছে৷’’ তার পুত্রবধূ লাইজু খাতুনও দাবি করেন, ‘‘এসব না দিলে কাজ ভালো হতো না৷’’ একই গ্রামের সেকেন্দার আলীর স্ত্রী রুবিয়া খাতুন অভিযোগ করেন, ‘‘আমিও কাজ ভালো করার জন্য দুই বস্তা সিমেন্ট দিয়েছি৷ কিন্তু ঘরের কাজ ভালো হয়নি৷’’

‘টাকা নেওয়ার নির্দেশনা ছিল না’

This browser does not support the audio element.

তাদের কাছ থেকে কে নিয়েছে সিমেন্ট বালু বা টাকা? সে বিষয়ে তারা সুনির্দিষ্ট করে কারো নাম বলতে পারেননি৷ তবে যারা ঘর নির্মানের কাজ করেছেন, তারাই নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন অভিযোগকারীরা৷

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিয়াকত আলী শেখ বলেন, ‘‘এমন অভিযোগ আমিও শুনেছি৷ এরপর আমি নিজে ঘটনাস্থলে গিয়েছি৷ কিন্তু আমার কাছে তারা এসব বিষয় পুরোপুরি অস্বীকার করেছে৷ এখন তারা যদি অভিযোগ না করে, তাহলে আমি কিভাবে বিষয়টির অনুসন্ধান করবো? এখনো যদি কেউ আমার কাছে অভিযোগ করে তাহলে আমি অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবো৷ কারণ, এটা প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প৷ সরকারিভাবে সব টাকা দেওয়া হয়েছে৷ কেউ সিমেন্ট বালু নিতে পারেন না৷’’

প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেতেও কেন টাকা দিতে হওয়ার বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘ভূমিহীনদের প্রধানমন্ত্রী জমিসহ যে ঘর উপহার দিয়েছেন সেটা অত্যন্ত ভালো একটি কাজ৷ এখন এই ভালো কাজটি নিয়ে কারা বাণিজ্য করেছে অবশ্যই তাদের খুঁজে বের করতে হবে৷ এদের যদি শাস্তি দেওয়া না যায়, তাহলে এরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে। এরা যত শক্তিশালী বা ক্ষমতাধরই হোক না কেন প্রধানমন্ত্রীর উপহার নিয়ে বাণিজ্য করে পার পেতে পারে না৷ অবশ্যই এদের শাস্তি হতে হবে৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ