দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত বিস্তৃত নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস পাইপ লাইন নিয়ে অ্যামেরিকা ও জার্মানির মধ্যে বিতর্ক ছিল। বুধবার তার অবসান হলো।
বিজ্ঞাপন
বিতর্ক ছিল। সমালোচনা ছিল। রাজনীতিও ছিল। শেষপর্যন্ত তার অবসান হলো। নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপলাইন নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছালো জার্মানি ও অ্যামেরিকা। মনে করা হচ্ছে, জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সাম্প্রতিকতম মার্কিন সফরের পরেই বরফ গললো।
তবে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য জার্মানি এবং অ্যামেরিকা দুই দেশই নিজেদের অবস্থান থেকে সরেছে। ইউক্রেনের সুরক্ষার কথাও মাথায় রাখা হয়েছে। পাশাপাশি এই পাইপলাইন যাতে ভূরাজনীতিতে রাশিয়াকে কোনো বিশেষ সুবিধা দিতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখা হবে বলে স্থির হয়েছে।
কী আছে চুক্তিতে
বুধবার দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তি সই হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপ লাইন তৈরিতে আর কোনো বাধা থাকবে না। কিন্তু জার্মানিকে খেয়াল রাখতে হবে, রাশিয়া যেন এই পাইপ লাইনকে ক্ষমতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার না করে। পাইপ লাইনটি যাবে ইউক্রেনের উপর দিয়ে। দেখতে হবে, ইউক্রেন যেন ট্রানসিট ফি থেকে বঞ্চিত না হয়। গ্যাস এবং প্রাকৃতিক সম্পদের দিক দিয়ে রাশিয়া অত্যন্ত সমৃদ্ধ। অন্যদিকে ইউরোপ এ বিষয়ে খানিকটা রাশিয়ার মুখাপেক্ষি। রাশিয়া যাতে সেই বিষয়টিকে রাজনৈতিক সুযোগ হিসেবে না দেখে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। রাশিয়া যেন ইউক্রেনের উপর আর কোনো আগ্রাসন না চালায়। যদি এই ঘটনাগুলি ঘটে, তাহলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে কড়া পদক্ষেপ নেবে জার্মানি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির ব্যবস্থা করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির বিষয়ে উৎসাহী করবে।
ম্যার্কেল ও মার্কিন প্রেসিডেন্টদের রসায়ন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির বিশেষ সম্পর্কের ভিত্তি যথেষ্ট মজবুত হলেও শীর্ষ নেতাদের সম্পর্কের রসায়নের উপর তার বিবর্তন অনেকটাই নির্ভর করে৷ আঙ্গেলা ম্যার্কেল তাঁর ক্ষমতাকালে চারজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের দেখা পেলেন৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
প্রথম সাক্ষাৎ
২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে আঙ্গেলা ম্যার্কেল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন৷ সে সময়ে জার্মান চ্যান্সেলর ছিলেন গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার৷
ছবি: AP
চ্যান্সেলর ও প্রেসিডেন্ট
২০০৮ সালের জুন মাসে বার্লিনের কাছে মেসেব্যার্গ-এ জার্মান সরকারের অতিথি নিবাসে মিলিত হয়েছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ৷ বুশ দুই দিনের সফরে জার্মানি এসেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/G. Bergmann
পারিবারিক পরিবেশে বুশ-ম্যার্কেল
২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় জর্জ ডাব্লিউ বুশ ম্যার্কেলকে নিজের খামারবাড়িতে স্বাগত জানান৷ স্ত্রী লরা ও ম্যার্কেলের স্বামী ড. ইওয়াখিম সাউয়ারকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়েছিলেন বুশ৷
ছবি: AP
উষ্ণতার বহিঃপ্রকাশ
২০০৮ সালেই রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে জি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে জর্জ ডাব্লিউ বুশ আচমকা ম্যার্কেল-এর কাঁধ মালিশ করে বসেন৷ তাঁর এই স্বতঃস্ফূর্ত উষ্ণতার প্রকাশে ম্যার্কেল অবশ্য কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন৷
নতুন সম্পর্ক
২০০৯ সালে জার্মানির বাডেন বাডেন শহরে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা৷ ম্যার্কেল তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
ম্যার্কেল-ওবামা রসায়ন
একই বছর ওয়াশিংটন সফরে জান ম্যার্কেল৷ ধীরে ধীরে ওবামা ও ম্যার্কেলের ব্যক্তিগত উষ্ণতা গড়ে উঠতে শুরু করে৷
ছবি: AP
বিশেষ সম্মান
২০১১ সালে ওয়াশিংটন সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘মেডেল অফ ফ্রিডম’ হাতে পান আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ কিন্তু তার ঠিক পরে এনএসএ কেলেঙ্কারির ফলে ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে ম্যার্কেলের সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়ে পড়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নতুন পরিস্থিতি
২০১৫ সালে বাভেরিয়ার মনোরম পরিবেশে জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন ওবামা৷ ততদিনে ভ্লাদিমির পুটিনের সঙ্গে বেড়ে চলা সংঘাতের কারণে রাশিয়া একঘরে হয়ে পড়েছে৷
ছবি: Reuters/M. Kappeler
আবেগঘন বিদায়
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কার্যকালের শেষ পর্যায়ে বার্লিন সফরে আসেন বারাক ওবামা৷ পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে তিনি ম্যার্কেলের নাম উল্লেখ করেন৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
নতুন চ্যালেঞ্জ
২০১৭ সালটি অ্যামেরিকা ও জার্মানি – দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ জানুয়ারি মাসে ওয়াশিংটনে ক্ষমতায় এলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ ম্যার্কেলও আবার ক্ষমতায় এলেন।
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Kappeler/R. Sachs
বিরোধ
২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ট্রাম্পের আমলে অ্যামেরিকা ও জার্মানির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। ন্যাটো নিয়ে ট্রাম্প ও ম্যার্কেলের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। ট্রাম্পের অ্যামেরিকা ফার্স্ট নীতিও ম্যার্কেল মানতে পারেননি। জার্মানি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করেছেন ট্রাম্প। ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Vucci
বাইডেনের আমলে
২০২১ সালে জি৭ বৈঠকের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে ম্যার্কেলের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে। এবার ম্যার্কেল অ্যামেরিকা গেছেন। চ্যান্সেলার হিসাবে তার সম্ভবত এটাই শেষ সফর। বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকে করবেন তিনি। সেখানে কি সম্পর্কের বরফ গলবে?
ছবি: Adam Schultz/White House/Planet Pix/Zuma/picture alliance
12 ছবি1 | 12
প্রতিটি প্রস্তাবই জার্মানি মেনে নিয়েছে। তারপরেই চুক্তি সই হয়েছে। অ্যামেরিকাকেও পিছু হঠতে হয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এই পাইপ লাইনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। জো বাইডেনও এই পাইপ লাইন কখনো সমর্থন করেননি। অ্যামেরিকা বরাবরই বলেছে, এই পাইপ লাইন ভূরাজনীতিতে রাশিয়াকে অনেকটা অ্যাডভান্টেজ দেবে। যা তারা কোনো ভাবেই হতে দিতে চায় না। অ্যামেরিকায় গিয়ে এ বিষয়ে বাইডেনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন ম্যার্কেল। শেষপর্যন্ত বাইডেন সমঝোতায় আসতে রাজি হন। জার্মান রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, সেপ্টেম্বরে ক্ষমতা ছাড়ার আগে আঙ্গেলা ম্যার্কেলের অন্যতম বড় সাফল্য এই চুক্তি।
ইউক্রেন নীতি
চুক্তিতে ইউক্রেন নিয়ে স্পষ্ট নীতি নির্ধারণ করেছে দুই দেশ। জার্মানি এবং অ্যামেরিকা যৌথ ভাবে ইউক্রেনে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। ইউক্রেনে গ্রিন এনার্জি তৈরির জন্য এই অর্থ ব্যয় হবে। ইউক্রেনকে প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য শুধুমাত্র রাশিয়ার মুখাপেক্ষি যাতে না হতে হয়, তার জন্য এই ব্যবস্থা করা হবে বলে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার আলোচনার ব্যবস্থা করবে জার্মানি। যাতে পাইপ লাইন ইউক্রেনের উপর দিয়ে যাওয়া বাবদ ট্রানসিট অর্থ পায় দেশটি।
ম্যার্কেল-পুটিন কথা
বুধবার চুক্তি সই হওয়ার পরেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনকে ফোন করেন ম্যার্কেল। চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে দুইপক্ষের। কীভাবে দ্রুত পাইপ লাইনের কাজ শেষ করা যায়, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের।