কখনো যদি বিশাল আকারের কোনো গ্রহাণু বা ধূমকেতু পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে, কী করবো আমরা? এই আশঙ্কা সামনে রেখে কিভাবে তা এড়ানো যায়, সে গবেষণাই করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
বিজ্ঞাপন
আমরা হয়তো খবর রাখি না, কিন্তু মাঝেমধ্যেই বিশাল আকারের সব পাথরখণ্ড পৃথিবীর গা ঘেঁষে চলে যায়৷ ২০১৮ সালের এপ্রিলে ২০১৮জিইথ্রি নামের ৫০ মিটার ব্যাসের একটি গ্রহাণু বিপজ্জনকভাবে পৃথিবীর কাছে চলে আসে৷ মাত্র ২১ ঘণ্টা আগে জ্যোতির্বিদরা এটির উপস্থিতি টের পান৷
এরও পাঁচ বছর আগে ২০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি উল্কা রাশিয়ার চেলিয়াবিনস্কে আঘাত হানে৷ আকারের তুলনায় বিপর্যয় কম মাত্রারই হয়েছিল৷ কয়েক হাজার বাড়িঘর এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, প্রায় এক হাজার মানুষ আহত হয়েছিলেন৷ তবে ভাগ্যক্রমে এর আঘাতে কেউ প্রাণ হারাননি৷
মহাশূন্য থেকে ‘গোলাবর্ষণ’
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তথাকথিত ‘‘পৃথিবী-সন্নিকটস্থ’’ অ্যাস্টেরয়েড বা গ্রহাণুর খোঁজে সারাক্ষণ মহাশূন্যের দিকে চোখ রাখেন৷ ১২ অক্টোবর, ২০১৭ তারিখে ‘২০১২টিসি৪’ গ্রহাণুটি পৃথিবীর কাছ দিয়ে যায়৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
ব্রহ্মাণ্ডের খোলামকুচি
মহাশূন্যে অসংখ্য গ্রহাণু ঘুরছে৷ তাদের অনেকের ব্যাস বেশ কয়েক কিলোমিটার৷ কিন্তু এই অ্যাস্টেরয়েডগুলির মধ্যে কোনোটির আগামী ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা নেই, বলছেন বিজ্ঞানীরা৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
গ্রহের অণুই বটে
২০১২টিসি৪ নম্বর গ্রহাণুটির ব্যাস ১০ থেকে ২০ মিটার – ২০১৭ সালের ১২ অক্টোবর তারিখে পৃথিবীর ৪৪,০০০ কিলোমিটার দূর দিয়ে যায় এই গ্রহাণু৷ ২০১২ সালে হাওয়াই-এর অবজারভেটরি থেকে ২০১২টিসি৪-এর অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/NASA/JPL-Caltech
কয়েক কিলোমিটার চওড়া
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ায় ‘ফ্লোরেন্স’ গ্রহাণু পৃথিবীর পাশ কাটিয়ে যায় – পাশ মানে ৭০ লাখ কিলোমিটার দূর দিয়ে৷ ১৯৮১ সালে আবিষ্কৃত গ্রহাণুটির ব্যাস ৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার৷ এর নাম রাখা হয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ নার্স ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের নামে৷
অতি কাছ দিয়ে
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ১,৩০,০০০ টন ওজনের গ্রহাণু ‘২০১২ডিএ১৪’ পৃথিবীর মাত্র ২৭,০০০ কিলোমিটার দূর দিয়ে যায় – কিছু কিছু কৃত্রিম উপগ্রহের দূরত্ব যার চেয়ে বেশি!
ছবি: NASA/Science dpa
উল্কারাও কিছু কম যায় না
গ্রহাণুর সঙ্গে উল্কার তফাৎ হল এই যে, কোনো গ্রহাণু বা মহাশূন্যের অন্য কোনো বস্তু পৃথিবীর আবহমণ্ডল ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে এসে পড়লে, তাকে উল্কাপিণ্ড বলা হয়৷ উল্কার আঘাতে স্বভাবতই বিপর্যয় ঘটতে পারে৷
ছবি: cc-by/LarryBloom
সুবিশাল উল্কাপিণ্ড
সাড়ে ছ’কোটি বছর আগে একটি সুবিশাল উল্কাপিণ্ড য়ুকাতান উপদ্বীপে এসে পড়েছিল৷ এই আঘাতের ফলে যে চিকসুলুব গহ্বরটি সৃষ্টি হয়, তার ব্যাস ৩০০ কিলোমিটার৷ এই উল্কাপাতের ফলেই ডাইনোসররা নিশ্চিহ্ন হয়, বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা৷
ছবি: NASA/Don Davis
কালো পাথর
উল্কাপিণ্ড বস্তুত ভূপৃষ্ঠের পাথরগুলির মতোই দেখতে – কিন্তু লাভা পাথরের মতো স্থানে স্থানে মসৃণ, কেননা পৃথিবীর আবহমণ্ডলে প্রবেশ করার সময় প্রচণ্ড ঘর্ষণে উল্কাপিণ্ডটি অংশত গলে যায়৷
ছবি: picture-alliance/ dpa/dpaweb
ধূমকেতু ও উল্কাপাত
ধূমকেতুরা বস্তুত একটি গ্যাসের মেঘ, যার পুচ্ছটি গ্যাস, পাথর ও অসংখ্য ধুলার কণিকা দিয়ে তৈরি৷ ধূমকেতুর ধুলিকণা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করলে সেগুলির তাপমাত্রা দাঁড়ায় ৩,০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপর – যার ফলে কণিকাগুলি আলো ছড়াতে থাকে৷ এর ফলে আমরা উল্কাপাত দেখতে পাই৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উল্কাবৃষ্টি
কোনো ধূমকেতু পৃথিবীর অতি কাছ দিয়ে গেলে অসংখ্য উল্কাপাত ঘটে, যা রাতের আকাশে অসাধারণ দেখতে লাগে, যেমন ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জের উপর এই উল্কাবৃষ্টি৷
ছবি: AP
‘নেয়ার-আর্থ অবজেক্ট’ বা এনইও
পৃথিবীর কাছাকাছি আসতে পারে এমন সব গ্রহাণু, ধূমকেতু ইত্যাদির উপর নজর রাখার জন্য ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ইএসএ ২০১৩ সালে ইটালির ফ্রাস্কাতি অঞ্চলে ‘‘পৃথিবী-সন্নিকটস্থ’’ বস্তুসমূহের সমন্বয় কেন্দ্র খুলেছে৷ টেনেরিফা ইত্যাদি দ্বীপে বসানো টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া তথ্য এখানে সমন্বয় করা হয়ে থাকে৷
ছবি: IQOQI Vienna
10 ছবি1 | 10
মহাকাশ গবেষকরা অবশ্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী বস্তুগুলোর অবস্থান নিশ্চিত করার বিষয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী৷ এই গ্রহাণুগুলো কয়েক কিলোমিটার ব্যাসেরও হতে পারে৷ তবে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে এত বড় কোনো গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত করবে না বলে মোটামুটি নিশ্চয়তা দিচ্ছেন গবেষকরা৷
সবচেয়ে বিপজ্জনক মাঝারি আকার
আকারে কয়েকশ' মিটার ব্যাসের গ্রহাণু বড় আকারের বিপদে ফেলতে পারে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যে৷ এবং উপরে বর্ণনা করা সবশেষ গ্রহাণুটির বিবরণ থেকে বোঝা যায়, এর সবগুলোর অবস্থান ও আবির্ভাব অনেক আগে থেকে শনাক্তও করা যাবে না৷
এ কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স ও ইসরায়েলের তিনশ' জ্যোতির্বিজ্ঞানী, নভোচারী, মহাকাশ প্রকৌশলী ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা সমবেত হয়েছেন ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণে৷
যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে ষষ্ঠ প্ল্যানেটারি ডিফেন্স কনফারেন্সে মূল আলোচনার বিষয় আমাদের এই গ্রহের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা৷ জনস হপকিনস অ্যালায়েড ফিজিক্স ল্যাবরেটরির গবেষকদের সঙ্গে মিলে এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা৷
করণীয় কী?
বিজ্ঞানীরা ৩০০ মিটার আকারের একটি মডেল বানিয়েছেন৷ মডেলটি প্রতি সেকেন্ডে ১৪ কিলোমিটার, অর্থাৎ, ঘণ্টায় প্রায় ৫০ হাজার কিলোমিটার গতিতে ৫৭ মিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে ছুটে আসছে৷ পৃথিবীতে এর আঘাত হানার আশঙ্কা কেবল এক শতাংশ৷
এর প্রভাব এড়ানোর একটি কৌশল হলো, আগে থেকে সম্ভাব্য আঘাতস্থল চিহ্নিত করে সেখান থেকে সবাইকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলা৷
এছাড়া, অনেক বিজ্ঞানীই কিভাবে ধেয়ে আসা গ্রহাণুর গতিপথ পৃথিবীর দিক থেকে অন্যদিকে পরিবর্তন করা যায়, হবে সে আলোচনাও৷ পৃথিবীর দিকে না এলেও কাছেই অবস্থান করছে, এমন একটি ১৫০-মিটার ব্যাসের গ্রহাণুর সঙ্গে সংঘাত ঘটিয়ে সেটির গতিপথ পালটানো যায় কিনা, ২০২২ সালে তা যাচাই করেও দেখবেন বিজ্ঞানীরা৷
গ্রহাণুর বুকে মহাকাশযান
গ্রহ-নক্ষত্রের রহস্য উন্মোচনে মানুষ যথেষ্ট উদ্যোগ দেখিয়ে চলেছে৷ কিন্তু গ্রহাণু? কিছুদিন আগেই একটি গ্রহাণু আচমকা পৃথিবীর বিপজ্জনক রকম কাছে এসে পড়েছিল৷ নাসা এবার ‘বেনু’ নামের এক গ্রহাণুতে যান পাঠালো৷
ছবি: picture alliance/ZUMA Press/C. Meaney
যাত্রার সূচনা
২০১৬ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর ভোরে যাত্রা শুরু করলো ‘অসিরিস-রেক্স’ নামের যান৷ সেটিকে মহাকাশে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নিয়েছে ‘অ্যাটলাস-ভি’ রকেট৷ প্রায় সাত বছরের এই অভিযানে ‘বেনু’ গ্রহাণু থেকে মূল্যবান নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার কথা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/J. Raoux
‘বেনু’ কেন?
প্রায় ৫ লক্ষ গ্রহাণুর মধ্যে ‘বেনু’-কেই গন্তব্য হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে, কারণ তার কক্ষপথ পৃথিবীর খুব কাছে৷ তাছাড়া আয়তনের দিক থেকেও আদর্শ৷ নাসার তথ্যভাণ্ডারে অন্যতম প্রাচীন গ্রহাণু এটি৷
ছবি: picture alliance/ZUMA Press/C. Meaney
লাভ-লোকসানের হিসেব
প্রায় ৮০ কোটি ডলারের এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য প্রায় ৪৫,০০০ কোটি বছর আগের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা৷ সেখান থেকে ধুলাবালি, ধাতু ও মাটির নমুনা সংগ্রহ করে ২০২৩ সালে ‘অসিরিস-রেক্স’ আবার ঘরে ফিরে আসলে বিজ্ঞানীরা মূল্যবান জ্ঞান অর্জনের আশা করছেন৷
ছবি: Reuters/M. Brown
ছোট হলেও শক্তিশালী
‘অসিরিস-রেক্স’-এর আকার একটি এসইউভি গাড়ির মতো হলেও অত্যন্ত উন্নত যন্ত্রপাতি ভরা রয়েছে৷ নানা রকমের ক্যামেরা, লেজার, স্পেকট্রোমিটার এই প্রথম কোনো গ্রহাণুর মধ্যে ধাতুর বিন্যাস পরীক্ষা করবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NASA/D.Gerondidakis
গ্রহাণুতে অনেক কাজ
২০১৮ সালের আগস্ট মাসে ‘অসিরিস-রেক্স’-এর ‘বেনু’ গ্রহাণু পৌঁছানোর কথা৷ সেখানে প্রায় দু-বছর ধরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত থাকবে যানটি৷ তারপর ২০২০ সালের জুলাই মাসে নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু হবে৷ তবে সরাসরি গ্রহাণুর ‘মাটি’ ছোঁবে না এই যান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NASA/Goddard
মূল্যবান নমুনা
গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকে অ্যাপোলো অভিযানের পর এত পরিমাণ মহাজাগতিক নমুনা পৃথিবীতে আনা হয়নি৷ নাসা আশা করছে, ‘অসিরিস-রেক্স’ এই কাজে অত্যন্ত সফল হবে৷ ‘ট্যাগস্যাম’ নামের এক যন্ত্র ভাসমান যান থেকে হাত বাড়িয়ে সেই কাজ করবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পৃথিবীর জন্য বিপদ
এই অভিযানের আরেকটি উদ্দেশ্য ‘ইয়ারকভস্কি এফেক্ট’ সম্পর্কে আরও জ্ঞান অর্জন করা৷ সূর্যের আলো গ্রহাণুদের কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত করার ফলে তারা বিপথগামী হয়ে পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটাতে পারে৷ এমন ঝুঁকির আগাম পূর্বাভাষ দিতে চান বিজ্ঞানীরা৷ এই অভিযান সম্পর্কে আরও জানতে উপরে ডানদিকে ক্লিক করুন৷
ছবি: picture-alliance/AP
7 ছবি1 | 7
বাড়ছে সচেতনতা
যেসব গ্রহাণুর কক্ষপথ পৃথিবী থেকে ৫০ মিলিয়ন কিলোমিটারের মধ্যে, সেগুলোকে পৃথিবীর ‘কাছের' গ্রহাণু বলে ধরে নেয়া হয়৷ এই তালিকায় ২০ হাজারেরও বেশি এমন গ্রহাণু আছে, প্রতি বছর নতুন করে যোগ হচ্ছে আরো ৭০০টি করে গ্রহাণু৷
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি এসা'র ডেটলেফ কোশনি বলছেন, ‘‘চেলিয়াবিনস্কের ঘটনার পর মানুষ এ বিষয়ে অনেক সচেতন হয়েছে, ফলে রাজনৈতিক নেতাদের ওপরও চাপ তৈরি হয়েছে৷''
নাসার কর্মকর্তা জিম ব্রিডেনস্টাইন এএফপিকে বলেছেন, ‘‘আমাদের মানুষকে আগে বোঝাতে হবে, এটা হলিউড না, এটা সত্যিকারের ঘটনা৷''
বিজ্ঞানীরা বলছেন, অন্য সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও মূল সমস্যা হয়, যখন সূর্যের কাছ ঘেঁষে কোনো গ্রহাণু পৃথিবীর দিকে ছুটে আসতে থাকে৷ আলোর কারণে পৃথিবীর টেলিস্কোপ থেকে এরা প্রায় অদৃশ্য থাকে৷ সাধারণ টেলিস্কোপ তো নয়ই, কেবল আরিজোনা, হাওয়াই, চিলি, স্পেন ও সিসিলিতে বসানো বিশেষ টেলিস্কোপ দিয়ে হয়ত এদের দেখা যেতে পারে৷
এই সমস্যা এড়াতে বিজ্ঞানীরা এখন মহাকাশে টেলিস্কোপ বসানোর কথা ভাবছেন৷ এটি বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে এমন গ্রহাণু খুঁজে বের করতে সহায়তা করবে৷ এমনকি চাঁদের দূরতম প্রান্তে এই টেলিস্কোপ স্থাপন করা যায় কিনা, তা-ও ভাবছেন তাঁরা৷ সেখানে চাঁদের পৃষ্ঠের আড়ালে সূর্যের আলো ও পৃথিবীর প্রতিফলন এড়িয়ে মহাকাশের আরো গভীরের খোঁজ মিলবে বলে আশা তাঁদের৷