কিছু কল্পবিজ্ঞান চলচ্চিত্রে পৃথিবীর উপর কোনো মহাজাগতিক বস্তুর আঘাতের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে৷ কিন্তু কোনো বিপজ্জনক গ্রহাণু প্রতিরোধ করতে মানুষ কতটা প্রস্তুত? ইউরোপ ও অ্যামেরিকার বিজ্ঞানীরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করছেন৷
বিজ্ঞাপন
পৃথিবীর জন্য হুমকি
মহাকাশের গভীর থেকে গোলার মতো ছুটে আসে পাথর বা ধাতুর তৈরি গ্রহাণু৷ সেগুলির মধ্যে কয়েকটির গতিপথ এমন, যে তা পৃথিবীর জীবজগতের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে৷ প্রায় ১০ কিলোমিটার ব্যাসের এমনই একটি গ্রহাণু বহুকাল আগে আমাদের গ্রহে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিল৷ সেটির আঘাতে ডাইনোসার প্রজাতি লুপ্ত হয়ে যায়৷
আমরা কি এমন আঘাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে পারি? অ্যালেন হ্যারিস ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘নিওশিল্ড' নামের প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন৷ এই মুহূর্তে এমন ‘গ্লোবাল কিলার'-এর হুমকি না থাকলেও তাঁর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী প্রতিরক্ষার কৌশল সৃষ্টির কাজে ব্যস্ত৷
বিপদের সূত্র
এখনো পর্যন্ত প্রায় ১২,০০০ মহাজাগতিক বস্তু চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে, যেগুলি খাতায়-কলমে পৃথিবীর জন্য বিপদ বয়ে আনতে পারে৷ জরুরি অবস্থা দেখা দিলে বিজ্ঞানীরা সংঘাত এড়াতে গ্রহাণুর গতিপথ পরিবর্তন করতে চান৷ কয়েক টন ওজনের মহাকাশযান সেই কঠিন কাজ করতে পারবে, এমনটাই তাঁদের লক্ষ্য৷ এমন যানের ভর তুলনামূলকভাবে সামান্য হলেও সেটি গ্রহাণুর সঙ্গে অভিকর্ষের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে৷ ফলে গ্রহাণুর গতিপথ কিছুটা হলেও বদলে যেতে পারে৷ জার্মান এয়ারোস্পেস সেন্টারের অ্যালেন হ্যারিস বলেন, ‘‘এটি অত্যন্ত নিখুঁত এক পদ্ধতি৷ গ্রহাণুর সঠিক অবস্থান জানা থাকে৷ কিন্তু গ্রহাণু ও মহাকাশযানের মধ্যে অভিকর্ষের টান খুব দুর্বল হওয়ায় সেটির গতিপথের সামান্য বিচ্যুতি সম্ভব৷ ফলে গতিপথে বড় পরিবর্তনের জন্য অনেক সময়ের প্রয়োজন৷ হয়ত ১০ থেকে ২০ বছর৷''
কিন্তু হাতে এত সময় না থাকলে দ্বিতীয় পরিকল্পনা প্রয়োগ করতে হবে৷ মারণাত্মক মহাকাশযানের সাহায্যে গ্রহাণুর উপর আঘাত হানতে হবে৷
চতুর, ক্ষুধার্ত আর ভয়ানক কৃষ্ণগহ্বরের কথা
প্রথমবারের মতো কৃষ্ণগহ্বরের ছবি প্রকাশ করলো বিজ্ঞানীরা৷ এর মধ্য দিয়ে এ মহাবিশ্ব সম্পর্কিত প্রচলিত অনেক ধারণাই স্পষ্ট হবে বলে আশা করছেন তাঁরা৷
১০০ বছর আগে জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনষ্টাইন কৃষ্ণগহ্বরের চতুরতা আর রহস্যের কথা বলেছিলেন৷ শত বছরের গবেষণায় তারই প্রমাণ হলো৷ এই মহাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কৃষ্ণগহ্বর অত্যন্ত চতুর, কেননা ক্ষণে ক্ষণে রূপ পালটায় তারা৷ কৃষ্ণগহ্বের অসীম শক্তির কাছে হার মানে সব কিছুই, এমনকি আলোও৷ আর যে কারণে, কৃষ্ণগহ্বরের আবস্থান আন্দাজ করতে পারলেও, এর ছবি তোলা সম্ভব হচ্ছিল না জ্যোতির্বিদদের পক্ষে৷
ছবি: Reuters/NASA
তাহলে উপায়?
প্রায় শত বছর চেষ্টার পরে একটি উপায় খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷ আর তা হচ্ছে, কৃষ্ণগহ্বরের উপরে নয়, টেলিস্কোপ ফেলতে হবে গহ্বরের চারপাশের ছায়ার উপর৷ আর সেটিই করেছেন তাঁরা৷ আটটি শক্তিশালী রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করে কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশের ছায়ার ইমেজ ধারণ করেন তাঁরা৷ আর তখনই ধরা পড়ে উজ্জ্বল এ ছায়ার মাঝখানে কালো বৃত্তটি৷ তবে বৃত্ত নয়, এটিই হলো অন্ধকার, অসীম আর শক্তিধর কৃষ্ণগহ্বর৷
ছবি: picture-alliance/Heritage-Images
কোথায় এটি?
যে কৃষ্ণগহ্বরটির ছবি বিজ্ঞানীরা তুলতে পেরেছেন সেটি হলো সুপারম্যাসিভ কৃষ্ণগহ্বর৷ এক রকম অগণিত দূরত্বেই কৃষ্ণগহ্বরটির অবস্থান৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবী থেকে ক্ষুধার্ত এ গহ্বরটি ৫৩ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে এম৮৭ নামে এক ছায়াপথে৷ আর এক আলোকবর্ষ সমান ৯.৫ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার৷ সে হিসেবে, পৃথিবী থেকে সুপারম্যাসিভ এ কৃষ্ণগহ্বরটির দূরত্ব মাপা আমাদের অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়৷
কৃষ্ণগহ্বরের রয়েছে ধারণার অতীত মধ্যাকর্ষণ শক্তি৷ যে কারণে, যে কোন জিনিস এমনকি আমাদের প্রিয় পৃথিবীর মতো কয়েক শত বা হাজার গ্রহকে সে দুমড়ে মুচড়ে গিলে ফেলতে পারে৷ তবে ধারণাতীত এ রহস্যের উন্মোচন করা গেলে বর্তমানে প্রচলিত মহাবিশ্ব সম্পর্কিত সকল ধারণাই পালটে ফেলতে হবে বলে জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিন্স৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Nasa Esa Jpl Caltech
কত খরচ হলো?
আন্তর্জাতিক ইভেন্ট হরিজন টেলিস্কোপ প্রকল্পের আওতায় কৃষ্ণগহ্বরকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে ২০১২ সাল থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন বিজ্ঞানীরা৷ আর এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫০ থেকে ৬০ মিলিয়ন ডলার৷
ছবি: ska.ac.za
5 ছবি1 | 5
পরীক্ষামূলক মহড়া
২০২০ সালে এক পরীক্ষামূলক মহড়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে৷ সে বছর ইউরোপীয় ও মার্কিন মহাকাশ সংস্থা ‘ডিডিমস' ও ‘ডিডিমুন' নামের যমজ দুই গ্রহাণুর উপর হামলা চালাতে চলেছে৷ সেই অভিযানের আওতায় একটি মহাকাশযান গোটা প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবে এবং গ্রহাণুর নমুনা সংগ্রহ করবে৷ ৩৩০ কিলোগ্রাম ওজনের দ্বিতীয় একটি যান ‘ডিডিমুন' গ্রহাণুর উপর হামলা চালাবে৷ এ যেন মহাশূন্যে বিলিয়ার্ড খেলা! এর ফলে দুই গ্রহাণুর গতিপথে কতটা পরিবর্তন ঘটবে?
মহাকাশের মতো এ ক্ষেত্রেও সেকেন্ডে প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার গতিতে আঘাত হানা হচ্ছে৷ বিস্ফোরিত পাথরের ধাক্কায় মারাত্মক সেই পালটা আঘাতের মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে উঠছে৷ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী ফ্রাংক শেফার বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে স্যাটেলাইটের আঘাতে স্পষ্টভাবে মোমেন্টাম ট্রান্সফার দেখা যাচ্ছে৷ অন্যদিকে গ্রহাণুর নিজস্ব উপাদানের কারণে বাড়তি মোমেন্টাম ট্রান্সফার ঘটছে৷ বিস্ফোরণের ফলে টুকরোগুলি আঘাতকারীর দিকে ধেয়ে যাচ্ছে৷ এটা অনেকটা জেট ইঞ্জিনের মতো পেছনে ভর বার করে সামনে গতি বাড়ানোর মতো দৃষ্টান্ত৷''
তবে এই প্রক্রিয়ায় শুধু অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের শক্ত বস্তুকে কক্ষচ্যুত করা সম্ভব৷ কিন্তু কোনো গ্রহাণুর মধ্যে অসংখ্য ছিদ্র থাকলে বা সেটির আকার বিশাল বড় হলে আঘাতের ইমপ্যাক্ট বা প্রভাব দুর্বল হয়ে যাবে৷ গতিপথ পরিবর্তনের জন্য সবসময়ে হাতে বেশি সময় থাকবে না৷ জার্মান এয়ারোস্পেস সেন্টারের অ্যালেন হ্যারিস মনে করেন, ‘‘পৃথিবীর দিকে কোনো বড় আকারের মহাজাগতিক বস্তু এগিয়ে এলে এবং খুব দেরিতে তা টের পেলে আমাদের সর্বশেষ হাতিয়ার সম্বল করতে হবে৷ অর্থাৎ পারমাণবিক বোমা প্রয়োগ করতে হবে৷ তবে ভাগ্য খুব খারাপ হলে ‘শটগান এফেক্ট' দেখা যেতে পারে৷ তখন বিস্ফোরণের ফলে গ্রহাণুটি ভেঙে চৌচির হবে এবং তার অসংখ্য টুকরো পৃথিবীর দিকে ধেয়ে যাবে৷ তার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে৷''
অতএব কোনো ‘গ্লোবাল কিলার' গ্রহাণু ‘নিওশিল্ড' প্রকল্পের গবেষকদের চোখ এড়িয়ে যাবে না, আমরা শুধু এটুকুই আশা করতে পারি৷
গেয়র্গ বাইনলিশ/এসবি
মহাকাশে নারী
মহাকাশে নারীদের পাড়ি জমানোর ঘটনা এখন মোটেও অবাক করা কিছু নয়৷ তবে যোগ্যতা সত্ত্বেও নাসার অভিযানে যোগ দিতে মার্কিন নারীদের কিছুটা বেগ পেতে হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/Itar-Tass/S. Baranov
প্রথম নারী
রাশিয়ার দক্ষ প্যারাসুটবিদ ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা প্রথম নারী, যিনি মহাকাশে পাড়ি জমান৷ দিনটি ছিল ১৯৬৩ সালের ১৬ জুন৷ মহাকাশযান ‘ভোস্তক-৬’ এ চেপে তিনি ৪৮ বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেন৷ এরপর আবার কোনো নারী পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশে যেতে সময় লেগেছিল ২০ বছর৷ স্ভেতলানা সাভিৎস্কায়াও রুশ নাগরিক৷ ১৯৮২ সালে সোয়ুজ টি-৭ অভিযানে যান তিনি৷
ছবি: picture-alliance/Itar-Tass/S. Baranov
মহাকাশে যাওয়ার অনুমতি দিল না নাসা
১৯৭৮ সালে নাসা শ্যানন লুসিড, মার্গারেট সেডন, ক্যাথরিন সুলিভান, জুডিথ রেসনিক, আনা ফিশার এবং সালি রাইডকে তাদের প্রথম নারী মহাকাশ অভিযাত্রী হিসেবে নির্বাচন করে৷ ১৯৬০ এর দশকের শুরুতে বেশ কয়েকজন অভিযাত্রী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পাস করেন৷ কিন্তু সামরিক বিমান চালনা পরীক্ষা সম্পন্ন না করায় তাঁদেরকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি৷ অবশ্য ঐ পরীক্ষায় অংশ নেয়ারই সুযোগ ছিলনা নারীদের৷
ছবি: picture-alliance/Cover Images/NASA
প্রথম মার্কিন নারী
১৯৮৩ সালে প্রথম মার্কিন নারী হিসেবে মহাকাশে পাড়ি জমান সালি রাইড৷ তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩২ বছর৷ চ্যালেঞ্জার মিশনে তিনিই প্রথমবারের মতো যান্ত্রিক হাত ব্যবহার করে মহাকাশে স্যাটেলাইট স্থাপন ও নিয়ন্ত্রণ করেন৷ পরের বছর আবারও তিনি এই মিশনে যান৷ ১৯৮৭ সালে নাসা ত্যাগ করেন৷ বাকি জীবন মেয়েদের গণিত, বিজ্ঞান, প্রকৌশন বিদ্যা শেখানোর জন্য ব্যয় করেন৷ ক্যানসারে আক্রান্ত জয়ে এই অভিযাত্রী ২০১২ সালে মারা যান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NASA
ডাক্তার থেকে মহাকাশ অভিযাত্রী
ছবিটির কেন্দ্রে যে নারীকে দেখা যাচ্ছে তাঁর নাম চিয়াকি মু্কাই৷ পেশায় ডাক্তার হলেও তিনিই জাপানের প্রথম নারী অভিযাত্রী৷ মহাকাশের মাইক্রোগ্র্যাভিটি পরিবেশে শরীরের পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা চালান তিনি৷ এজন্য ১৯৯৪ আর ১৯৯৮ সালে দুইটি অভিযানে অংশ নেন, যা জাপানিদের জন্যেও প্রথম৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/B. Zawrzel
ভারতের প্রথম নারী
কল্পনা চাওলা৷ প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারী, যিনি মহাকাশে পাড়ি জমানোর সুযোগ পান৷ তাঁর প্রথম অভিযানটি ছিল ১৯৯৭ সালে৷ সূর্যের ভূ-পৃষ্ঠ নিয়ে গবেষণার জন্য একটি স্যাটেলাইট স্থাপনে এটি পরিচালিত হয়েছিল৷ ২০০৩ সালে কলম্বিয়া মহাকাশ অভিযাত্রায় অংশ নেন কল্পনা৷ যেটি পৃথিবীতে ফিরে আসার পথে বিধ্বস্ত হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NASA
মহাকাশে ইরানের নারী
৩২ বছর বয়সেই তিনি শিল্পপতি হিসেবে অনেক টাকার মালিক বনে যান৷ কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেননি৷ ২০০৬ সালে আনুশেহ আনসারি প্রথম ইরানি বংশোদ্ভূত নারী হিসেবে মহাকাশে যান৷ শুধু তাই নয়, তিনিই প্রথম নারী যিনি ব্যক্তি উদ্যোগে মহাকাশ ভ্রমণ করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/Everett Collection
মহাকাশে ৬৬৬ দিন
মহাকাশে পাড়ি জমানোর অনেক রেকর্ডই মার্কিন জৈব-রসায়নবিদ পেগি হুইটসনের দখলে৷ ২০০২ সাল থেকে শুরু করে সব মিলিয়ে ৬৬৬ দিন তিনি পৃথিবীর বাইরে কাটিয়েছেন, যা কোনো নারীর জন্য সর্বোচ্চ৷ ২০০৭ সালে প্রথম নারী কমান্ডার হিসেবে মিশনের দায়িত্ব পান তিনি৷ ২০১৭ সালে একটি অভিযাত্রা থেকে ২৮৯ দিন পর তিনি ফিরে আসেন ভূপৃষ্ঠে৷ ৫৭ বছয় বয়সি হুইটসনের জন্য সেটি ছিল সবচেয়ে বেশি বয়সি নারী হিসেবে মহাকাশ যাত্রা৷