গ্রামীণ ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন করে সংসদে বিল পাস হওয়ার পর চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা এবং শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷ এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের ধ্বংস এখন অবধারিত হলো৷
বিজ্ঞাপন
এদিকে, ব্যাংকের পরিচালকদের একজন তাহসিনা খাতুন ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ব্যাংকটি বাঁচাতে তাঁরা যা যা করার তাই করবেন৷ প্রয়োজনে সর্বাত্মক আন্দোলনে যাবেন৷
মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে গ্রামীণ ব্যাংক বিল-২০১৩ পাস হওয়ায় এখন গ্রামীণ ব্যাংক তাদের আর্থিক হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংককে দিতে বাধ্য৷ এর ফলে ব্যাংকটি কার্যত বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল৷ আর ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সরকার মনোনীত পরিচালক থাকবেন তিনজন৷ পরিচালক নির্বাচনের কর্তৃত্ব থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে৷
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বুধবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘এই বিল পাসের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের ধ্বংস এখন অবধারিত হলো''৷ তিনি ১৯৮৩ সালের গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ বাদ দিয়ে নতুন এই আইন পাসের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, এর ফলে সরকার এখন গ্রামীণ ব্যাংককে একশভাগ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবে৷ তিনি বলেন গ্রামীণ ব্যাংক সৃষ্টি করা হয়েছিল গরিব নারীদের মালিকানায় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে৷ এই ব্যাংকে সরকারের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ ছিল না৷ নতুন আইনের মাধ্যমে ব্যাংকের মৌলিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনা হয়েছে৷
মুহাম্মদ ইউনূসের আরেকটি অর্জন
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা কংগ্রেশনাল স্বর্ণপদক গ্রহণ করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷ বুধবার ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল ভবনের রোটান্ডায় ইউনূসের হাতে এই সম্মাননা তুলে দেন জন বোয়েনার৷
ছবি: Getty Images
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঝুড়িতে আরেকটি সম্মাননা যোগ হলো৷ বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা কংগ্রেশনাল স্বর্ণপদক গ্রহণ করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা৷ তবে নিজের দেশে বর্তমানে বেশ চাপের মধ্যে আছেন শান্তিতে নোবেল জয়ী অধ্যাপক ইউনূস৷
ছবি: Getty Images
সম্মাননা গ্রহণ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের উভয় কক্ষের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল ভবনের রোটান্ডায় অধ্যাপক ইউনূসের হাতে সম্মাননা তুলে দেন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার জন বোয়েনার৷ এসময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট নেতা ন্যান্সি পেলোসি (বামে)৷
ছবি: Getty Images
বাংলাদেশের মানুষকে উৎসর্গ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা কংগ্রেশনাল গ্রহণ করার পর ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘‘সকলে আমার কাজে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন বলেই ক্ষুদ্রঋণের ধারণাটি আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত৷ আমি এ সম্মান বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্যে উৎসর্গ করলাম৷’’
ছবি: Getty Images
‘প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক’
এর আগে ২০০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি মর্যাদাশীল সম্মাননা অর্জন করেন ইউনূস৷ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক’ পান ড. ইউনূস৷ সাধারণত মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত পছন্দ অনুযায়ী এই সম্মাননা দেওয়া হয়৷
ছবি: AP
অন্য উচ্চতায় ইউনূস
বলাইবাহুল্য, ইউনূস হচ্ছেন প্রথম এবং একমাত্র বাংলাদেশি, যিনি নোবেল পুরস্কার জয়ের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি মর্যাদাশীল সম্মাননা অর্জন করেছেন৷ গোটা বিশ্বে মাত্র সাতজন জীবদ্দশায় এই তিনটি সম্মাননা পেয়েছেন৷ এরা হচ্ছেন নরম্যান বারলগ, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, নেলসন ম্যান্ডেলা, এলি উইসেল, অং সান সু চি, মাদার টেরেসা এবং সর্বশেষ মুহাম্মদ ইউনূস৷
ছবি: AP
গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা
গরিব মানুষ বিশেষ করে নারীদের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার জন্য ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন মুহাম্মদ ইউনূস৷ আধুনিক ক্ষুদ্রঋণের জনক বলা হয় তাঁকে৷ গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্ষুদ্রঋণকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন তিনি৷ ক্ষুদ্রঋণের এই ধারণা অধ্যাপক ইউনূসকে গোটা বিশ্বেই সম্মানজনক পরিচিতি এনে দিয়েছে৷
ছবি: AP
শান্তিতে নোবেল জয়
২০০৬ সালের যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয় করেন অধ্যাপক ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক৷ সেবছরের ডিসেম্বরে নরওয়ের রাজধানী অসলো’র টাউন হলে এই সম্মাননা গ্রহণ করেন অধ্যাপক ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধি তসলিমা বেগম৷
ছবি: AP
রাজনীতির ইচ্ছা এবং বিড়ম্বনা
শান্তিতে নোবেল জয়ের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবেশের ঘোষণা দেন অধ্যাপক ইউনূস৷ তবে এই সিদ্ধান্ত থেকে দ্রুতই সরে আসেন তিনি৷ কিন্তু অনেকেই মনে করেন, রাজনীতিতে নামার এই বাসনার কারণে পরবর্তীতে অনেক রাজনীতিবিদের চক্ষুঃশূল হন তিনি৷
ছবি: AP
গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ‘বিদায়’
শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূস সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ বেশ খানিকটা চাপের মধ্যে রয়েছেন৷ বয়সসীমা অতিক্রান্ত হওয়ার কারণ দেখিয়ে ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইউনূসকে অব্যাহতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক৷ এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়েছেন ইউনূস৷ এখন (১৮.০৪.১৩) পর্যন্ত ব্যাংকটিতে নতুন কোন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ সম্ভব হয়নি৷
ছবি: dapd
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ?
যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কখনো অধ্যাপক ইউনূসকে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে স্বীকার করেননি৷ তবে একথা বহুদিন ধরে চালু যে, অধ্যাপক ইউনূসের উপর কোন কারণে নাখোশ শেখ হাসিনা৷ যেকারণে চলতি সরকারের মেয়াদে নিজ দেশ বিভিন্ন ইস্যুতে চাপে আছেন মুহাম্মদ ইউনূস৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
ড. ইউনূস তাঁর বিবৃতিতে আরো বলেন, ‘‘আমি দুঃখিত যে কিছু অপরিণামদর্শী মানুষের বিবেচনাহীনতার কারণে জাতির একটি পরম গৌরবের প্রতিষ্ঠানকে এই মর্মান্তিক পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়ার ঘটনাটি জাতিকে প্রত্যক্ষ করতে হলো''৷ তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের এই মৌলিক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ব্যাংকটিকে রক্ষার আবেদন জানান৷
এদিকে ব্যাংকের পরিচালক তাহসিনা খাতুন ডয়চে ভেলেকে জানান নতুন বিল পাসের পর তাঁরা ৯ পরিচালক বৈঠক করেছেন৷ বৃহস্পতিবার ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীরা সংবাদ সম্মেলন করে নতুন আইনটির ব্যাপারে তাঁদের অবস্থান ব্যাখ্যা করবেন৷ তাঁরা মনে করেন এই আইন কার্যকর হলে ব্যাংকটি সরকারের হাতে চলে যাবে৷ সদস্যদের হাতে থাকবে না৷ তাহসিনা খাতুন বলেন প্রায় ১ কোটি গ্রাহকের এই ব্যাংক তাঁরা কোনোভাবেই সরকারকে দখল করতে দেবেন না৷ তাই গরিব মানুষের এই ব্যাংক রক্ষায় তাদের যা করার তাই করবেন৷ প্রয়োজনে তারা কঠোর আন্দোলনে যাবেন৷ তিনি আশা করেন গ্রামীণ ব্যাংক রক্ষার আন্দোলনে তারা শুধু দেশের নয়, সারা বিশ্বের মানুষকে পাশে পাবেন৷
উল্লেখ্য ১৯৮৩ সালে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের যাত্রা শুরু৷ ২০০৬ সালে মুহাম্মদ ইউনূস এবং ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পায়৷ ২০১১ সালের মার্চে সরকার ড. ইউনূসকে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়৷ তারপর থেকে এই ব্যাংক নিয়ে চলছে নানা টানাপোড়েন৷