প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাস আবার জিতলেন, না আরেকবার রেহাই পেলেন, তা বলা শক্ত৷ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে ৮৬ বিলিয়ন ইউরো ঋণ সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা এবার শুরু হতে পারবে৷
বিজ্ঞাপন
পাঁচ মাস ধরে গড়িমসি, এগোই-পিছোই ট্যাকটিক্সের পর ১৩ই জুলাই ব্রাসেলসে শেষমেষ যে আপোশটি গৃহীত হয়, তার একটি মূল শর্ত ছিল, উত্তরোত্তর ঋণের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা শুরু হওয়ার আগে গ্রিসকে দেখাতে হবে, সংস্কারের ক্ষেত্রে এথেন্স আন্তরিক: অর্থাৎ গ্রিক সরকার ও সংসদকে একাধিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে নতুন আস্থা সৃষ্টি করতে হবে৷
তার পর পরই সিপ্রাসের পাশাপাশি যিনি সর্বাধিক মিডিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করছিলেন, বামপন্থি সিরিজা দলেরই সেই ফায়ারব্র্যান্ড রাজনীতিক তথা গ্রিক অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারুফাকিসকে বিদায় নিতে হয়৷ কাজেই গত সপ্তাহে তথাকথিত প্রথম সংস্কার প্যাকেজ নিয়ে ভোটে ভারুফাকিসকে সংস্কারবিরোধীদের দলেই দেখা গেছে৷ এবার কিন্তু তিনি সংস্কারের সপক্ষেই ভোট দিয়েছেন৷
শুধু ভারুফাকিস একাই নন, সব আশঙ্কা সত্ত্বেও বুধবার ভোররাতে সিরিজা দলের মোট ৩৬ জন সাংসদ দ্বিতীয় সংস্কার প্যাকেজের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন – এর আগে যে সংখ্যা ছিল ৩৮৷ তবুও, সংসদে সিপ্রাস সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এখন মাত্র পাঁচ আসনের৷ অর্থাৎ সিপ্রাসকে এখনই নতুন নির্বাচনের কথা ভাবতে হচ্ছে না৷ ওদিকে সরকারি মুখপাত্রী ওলগা গেরোভাসিলি মঙ্গলবারেই ঘোষণা করেছিলেন যে, বুধবারের ভোটের পর পরই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইসিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু হবে৷
গ্রিসের প্রতি ইইউ-র ‘ছোট’ দেশগুলোও নারাজ
পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশই আজ ঋণ মকুব করে গ্রিসকে সাহায্য করতে নারাজ৷ ব্যয় সংকোচ ও কড়া সংস্কারের সুফল ভোগ করে এ সব দেশ আজ প্রতিযোগিতার বাজারে নিজেদের সাফল্য অর্জন করেছে৷ গ্রিসও সংস্কার চালাক – এটাই তাদের প্রত্যাশা৷
ছবি: picture alliance/dpa/Y. Behrakis
সাফল্যের গর্বে লিথুয়েনিয়া
লিথুয়েনিয়ার প্রেসিডেন্ট ডালিয়া গ্রিবাউসকাইটে ইউরো এলাকার জরুরি শীর্ষ সম্মেলনে গ্রিক প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাস সম্পর্কে কড়া মন্তব্য করেন৷ তাঁর মতে, গ্রিস শুধু কথার খেলাপ করে চলে৷ আজ কিছু করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরে সেটা আগামীকাল ঠেলে দেয়৷ উল্লেখ্য, প্রায় ২৫ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল লিথুয়েনিয়া৷ কঠিন সংস্কার ও অনেক ত্যাগের পর সে দেশ আজ নিজস্ব সাফল্যে গর্বিত৷
ছবি: DW
ইউরোপের সিলিকন ভ্যালি এস্টোনিয়া
সোভিয়েত আমলের বিশাল আমলাতন্ত্র ঝেড়ে ফেলে এস্টোনিয়া আজ তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চমকপ্রদ সাফল্য দেখাচ্ছে৷ অথচ সরকারের কড়া সংস্কার কর্মসূচি সত্ত্বেও সে দেশের মানুষ চরম আত্মত্যাগ স্বীকার করে আজকের অবস্থায় পৌঁছেছেন৷ সে দেশের প্রেসিডেন্ট টোমাস হেন্ডরিক ইলভেস বলেন, ইউরো এলাকার বাকি ১৮টি দেশে গ্রিসকে বাঁচাতে কর বাড়ানোর প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন করলে মানুষ কী রায় দেবে, একবার ভেবে দেখেছেন?
ছবি: Lingvist
বাণিজ্যে লাটভিয়ার সাফল্য
লিথুয়েনিয়ার মতো লাটভিয়াও অতীতের বোঝা ঝেড়ে ফেলে নিজস্ব কৌশলগত অবস্থানের ফায়দা তুলেছে৷ রাশিয়া ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে দেশটি৷ ২০০৪ সালে লিথুয়েনিয়ায় ইউরো চালু হয়৷ ফলে অঞ্চলের অন্যান্য অনেক দেশের মতো সে দেশের প্রেসিডেন্ট ভাল্ডিস ডমব্রফস্কিস মনে করেন, গ্রিসেও সংস্কার ছাড়া কোনো সমাধানসূত্র সম্ভব নয়৷ এই সত্য মেনে না নিলে ‘গ্রেক্সিট’ অনিবার্য৷
ছবি: Reuters
স্লোভাকিয়ার গাড়ি শিল্প
শুধু সংস্কার ও ব্যয় সংকোচের মাধ্যমে নয় – শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদের মূলধন করে স্লোভাকিয়া গাড়ি নির্মাতাদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে৷ জার্মানির ফলক্সভাগেন বা দক্ষিণ কোরিয়ার কিয়া কোম্পানি সে দেশে উৎপাদন করতে এগিয়ে এসেছে৷ অপেক্ষাকৃত কম মজুরি স্লোভাকিয়ার জন্য বাড়তি সুবিধা বয়ে এনেছে৷ বিদেশি বিনিয়োগ অর্থনৈতিক উন্নতি আরও তরান্বিত করেছে৷
ছবি: DW/E. Schuhmann
সাবেক ইয়ুগোস্লাভিয়ায় দক্ষতার প্রতীক স্লোভেনিয়া
ইয়ুগোস্লাভিয়া ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেছে৷ স্লোভেনিয়া কিন্তু তার অতীতের সুনাম ও সংস্কার কর্মসূচির ভিত্তিতে অতি কম সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউরো এলাকার সদস্য হয়ে উঠতে পেরেছে৷ সংকটের মুখে ব্যাংকিং ব্যবস্থার কড়া সংস্কার করতে পেরেছে দেশটি৷ বেসরকারিকরণের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে৷ ফলে আজ সে দেশের সমৃদ্ধির ভিত্তি বেশ মজবুত৷
ছবি: Reuters
‘আমাদের সমৃদ্ধির অভ্যাস নেই’
পোল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান মারেক বেলকা একবার পূর্ব ইউরোপের মানুষের সহ্যশক্তি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের এখনো সমৃদ্ধির অভ্যাস হয়নি৷’’ তাঁর মতে, এই অঞ্চলের মানুষের অভিজ্ঞতা হলো, সংকট সামনে এলে সংস্কারের মাধ্যমে তা অতিক্রম করা যায়৷ আজকের কষ্ট আগামীকাল সুফল বয়ে আনে৷
ছবি: AP
গ্রিক ট্র্যাজিডি
গ্রিস একেবারেই সংস্কারে নারাজ – এই অভিযোগ পুরোপুরি সত্য নয়৷ আন্তর্জাতিক দাতাদের চাপে সে দেশ এখনো পর্যন্ত যে সংস্কার চালিয়েছে, তার ফলে সাধারণ মানুষেরই বেশি ক্ষতি হয়েছে৷ কিন্তু বিশাল আমলাতন্ত্র, কর আদায়ে গাফিলতি, প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল ব্যয়ের মতো কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রে সদিচ্ছার প্রমাণ দেখা যাচ্ছে না৷ অতীতের ঋণভার ছাড়াও রাষ্ট্রের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বিশাল ফারাক গ্রিসের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করে তুলছে৷
ছবি: Reuters/S. Rapanis
7 ছবি1 | 7
প্রথম সংস্কার ভোটের পরই গ্রিস ইইউ-এর কাছ থেকে সাত বিলিয়ন ইউরোর কিছু বেশি জরুরি অর্থসংস্থান পায় এবং সোমবার ইসিবি ও আইএমএফ-এর বকেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারে৷ এথেন্স সরকার এবার চান, ২০শে আগস্টের মধ্যে চুক্তি, কেননা সেটা হলো ইসিবি-কে তিন বিলিয়ন ইউরোর কিছু বেশি পরিমাণ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার শেষ তারিখ৷
বুধবার রাতে ভোর চারটে অবধি চলা অধিবেশনে গ্রিক সাংসদরা ২৩০ বনাম ৬৩ ভোটে যে সংস্কার কর্মসূচিটি অনুমোদন করেন, তার উপজীব্য ছিল বিচারবিভাগীয় সংস্কার, সরকারি সম্পত্তির নিলেম এবং জাতীয় ব্যাংকগুলির লিকুইডিটি – অর্থাৎ নগদ পরিস্থিতি – জোরদার করার পন্থা৷ মনে রাখতে হবে, গ্রিসের ব্যাংকগুলি তিন সপ্তাহ ধরে বন্ধ থাকার পর গত সোমাবার প্রথমবার খুলেছে৷ এছাড়া কোনো ‘ব্যাংক রান' না হলেও, গ্রাহকরা গত ডিসেম্বর মাস যাবৎ ৪০ বিলিয়ন ইউরো পরিমাণ জামানত তুলে নিয়েছেন৷ কাজেই ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এই বুধবারেই গ্রিক ব্যাংকগুলির নগদ পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য আরো প্রায় এক বিলিয়ন ইউরো দিতে হয় – নয়ত এটিএম থেকে নগদ তোলাই ভার হতো৷
বুধবারের ভোটে সিপ্রাস জিতলেন – অথবা সাময়িকভাবে রেহাই পেলেন৷ কিন্তু ঐ বুধবারেই রাজধানী এথেন্সের কেন্দ্রে যে ন'হাজার বিক্ষোভকারী জমায়েত হয়েছিলেন, তাঁদের কথা ভুললেও চলবে না৷ শুধু অসন্তুষ্ট কমিউনিস্টরাই নন, নিশান হাতে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন পাবলিক সেক্টরের নানা শ্রমিক সংগঠন৷