জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে অবাস্তব বলে যারা উড়িয়ে দেন, তাদের সামনে সাক্ষাৎ প্রমাণের কিন্তু কোনো অভাব নেই৷ গ্রিনল্যান্ডে গবেষকরা বেশ কিছু প্রাণীর জীবনযাত্রা অনুসন্ধান করে এই সর্বনাশা প্রক্রিয়ার অকাট্য প্রমাণ পেয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
ইয়োহানেস লাং আইসল্যান্ডের এক বৃদ্ধের কাছে মাদি শিয়ালের ডাক নকল করতে শিখেছিলেন৷ সেই ডাক শুনলে সুমেরু অঞ্চলের শিয়ালশাবকরা তাদের বাসা থেকে বেরিয়ে আসে, অবশ্যই এখানে তাদের অস্তিত্ব থাকলে৷
বেশ বড় বাসা বলে মনে হচ্ছে৷ আর্কটিক শিয়াল যে এখানে বসবাস করে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ চারিদিকে হাড়গোড় আর পালক ছড়িয়ে রয়েছে৷ একটা বড় শিয়াল ধরতে পারলে তা হবে লটারিতে জ্যাকপট জেতার মতো ঘটনা৷ এখানে যে কিছু শিয়াল রয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ শাবকের কণ্ঠ শোনা গেছে৷ এর অর্থ, তাদের বাবা-মাও রয়েছে৷ মায়ের মতো ডাক শুনে প্রথমে তারা জবাব দিল৷ তারপর সত্যি কয়েকটা শাবক বাসা থেকে বেরিয়ে এলো৷ এবার এক বড় আর্কটিক শিয়াল ধরে তার শরীরে ট্রান্সমিটার বসানো হবে বড় চ্যালেঞ্জ৷
গ্রিনল্যান্ডের পূর্ব উপকূলে মানবহীন ট্রাইল দ্বীপে চলছে এই কর্মকাণ্ড৷ সুমেরু অঞ্চলের সংক্ষিপ্ত গ্রীষ্মে জার্মান ও ফরাসি বিজ্ঞানীরা সেখানকার প্রাণিজগতের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেন৷ প্রথমেই তাঁদের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়৷ তাঁবুর ক্যাম্পের বাইরে বৈদ্যুতিক বেড়া ও আগ্নেয়াস্ত্র প্রস্তুত রাখতে হয়৷ তা না হলেই ক্ষুধার্থ পোলার ভালুক হামলা চালাতে পারে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রে ভাসমান বরফ গলতে থাকায় সেখান থেকে তাদের পাকা জমিতে চলে আসতে হয়৷
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রমাণ দিলো গ্রিনল্যান্ড
05:35
কিন্তু গবেষকদের মূল আগ্রহ ছোট লেমিং-কে ঘিরে৷ প্রায় ৩০ বছর আগে বেনোয়া সিটলার এই গবেষণা প্রকল্প শুরু করেছিলেন৷ তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, বছরে বছরে লেমিং-দের সংখ্যা কমে চলেছে৷ ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেনোয়া সিটলার বলেন, ‘‘সাধারণত বছরে নয় মাস বরফের চাদর সুরক্ষা দিত৷ এখন প্রথম বরফ পড়তে অনেক দেরি হয়৷ বরফ তাড়াতাড়ি গলেও যায়৷ অর্থাৎ বরফের চাদরের নীচে নিরাপদে বংশবৃদ্ধির সময় প্রায় এক মাস কমে গেছে৷ তাই আগের তুলনায় লেমিং-দের অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গেছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই বরফ কমে চলেছে৷''
এর নাটকীয় প্রভাব দেখা যাচ্ছে৷ কারণ গ্রিনল্যান্ডের ইকোলজিতে লেমিং-দের কেন্দ্রীয় ভূমিকা রয়েছে৷ কারণ তারা শিয়াল বা আর্কটিক পেঁচার মূল খাদ্য৷ ফলে লেমিং কমে যাওয়ায় তাদের খাদ্যে টান পড়ছে৷ গবেষকরা তাই প্রতি বছর লেমিং ও তাগের বাসার গণনা করেন৷ বেনোয়া এক শীতকালীন বাসার হদিশ পেয়ে খুশি৷
আগে যেখানে প্রায় ৪,০০০ বাসার সন্ধান পাওয়া যেত, আজ সেখানে ৪০০টি পেলেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়৷ প্রতি গ্রীষ্মে বেনোয়া সিটলার তুন্দ্রার মধ্য দিয়ে প্রায় ১,০০০ কিলোমিটার পাড়ি দেন এবং চারিদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রমাণ সংগ্রহ করেন৷
যেভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের হিসাব রাখছে নাসা
প্রথমে কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের হিসাব রেখেছে নাসা৷ পরে সেটি বন্ধ হয়ে গেলে এখন আকাশ থেকে সেই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে তারা৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
অপারেশন আইসব্রিজ
মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার ক্রিয়োস্ফিয়ার কর্মসূচির অন্তর্গত ‘অপারেশন আইসব্রিজ’-এর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বুঝতে আকাশ থেকে মেরু অঞ্চলের উপর নজর রাখা হচ্ছে৷ ১৯৬৬ সালের লকহিড পি-৩ বিমান থেকে রিমোট সেন্সিংয়ের মাধ্যেমে ঐ অঞ্চলের বরফের পুরুত্ব ও স্থান পরিবর্তনের হিসাব রাখছে নাসা৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
প্রস্তুতি চলছে
অপারেশন আইসব্রিজের মেয়াদ ছয় বছর৷ এর আওতায় মার্চ থেকে মে-তে গ্রিনল্যান্ডে এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বরে অ্যান্টার্কটিকায় আট ঘণ্টা করে কয়েকটি ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে৷ এর মাধ্যমে বরফের পাত ও খণ্ডের ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
বিমানে আছে উচ্চ প্রযুক্তি
উপর থেকে কুয়াশার ভেতর দিয়ে ক্যানাডার এলেসমেয়ার দ্বীপের গ্লেসিয়ার দেখতে পাচ্ছেন৷ অপারেশন আইসব্রিজে তথ্য সংগ্রহের জন্য বিশেষ ‘আইস-পেনিট্রেটিং রাডার’ ব্যবহার করা হচ্ছে৷ বিমান নীচু দিয়ে উড়ে গেলে রাডারটি ভালো কাজ করে৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
প্রভাব এখনই দেখা যাচ্ছে
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখনই দেখতে পাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা৷ উপরের ছবিতেও সেটি বোঝা যাচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
বিকল্প ব্যবস্থা
অপারেশন আইসব্রিজ আসলে নাসার একটি বিকল্প ব্যবস্থা৷ কারণ ২০০৩ সালে একই কাজের জন্য ‘আইসস্যাট’ নামে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ চালু করেছিল তারা৷ কিন্তু ২০০৯ সালে সেটি হঠাৎ করে তথ্য সংগ্রহের কাজ বন্ধ করে দেয়৷ ফলে ‘আইসস্যাট-দুই’ নামে আরেকটি উপগ্রহ তৈরির কাজ শুরু করেছে নাসা, যেটি আগামী বছর চালু হওয়ার কথা৷ ২০০৯ থেকে ২০১৮ – এই নয় বছরের তথ্যও যেন সংগ্রহে থাকে সেজন্য অপারেশন আইসব্রিজ শুরু করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
সীমাবদ্ধতা
আইসস্যাট-এর মাধ্যমে সারা বছর ধরে অনেক বিস্তৃত এলাকার তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল৷ কিন্তু অপারেশন আইসব্রিজের সাহায্যে শুধু মেরু অঞ্চলের তথ্য সংগ্রহ করা যাচ্ছে এবং সেটিও মাত্র কয়েক মাসের জন্য৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
‘আইসস্যাট-দুই’ নিয়ে অনিশ্চয়তা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নাসার আর্থ সায়েন্স প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দেয়ায় আগামী বছর এই কৃত্রিম উপগ্রহের কাজ শুরুর বিষয়টি অনিশ্চয়তায় পড়েছে৷
ছবি: Getty Images/M.Tama
7 ছবি1 | 7
ইয়োহানেস লাং কামানে বারুদ ভরছেন৷ স্কুয়া পাখির দিকে লক্ষ্য করে কামান দাগবেন তিনি৷ শুধু প্রজননের জন্য তারা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে প্রতি বছর এখানে উড়ে আসে৷ একমাত্র বাসার মধ্যে তাদের ধরা যায়৷ তারপর তারা হামলা চালাতে কাছে চলে আসে৷ প্রশ্ন হলো, লেমিং-এর সংখ্যা কমে যাওয়ায় এই পাখিরাই বা কী খায়? সেটা জানতে তাদের শরীরেও ট্রান্সমিটার বসানো হবে৷
এই কামানের জাল পাখিদের ক্ষতি করে না৷ কিন্তু খুব দ্রুত কাজ সারতে হয়৷ পাখিটির মাপ নেওয়া হচ্ছে৷ তার পায়ে এখনো গত বছরের ডেটা লগার লাগানো রয়েছে৷ গবেষকরা সেটি সংগ্রহ করে তাদের রুট সম্পর্কে আরো জানতে চান৷ ইয়োহানেস লাং বলেন, ‘‘এই অংশ অত্যন্ত মূল্যবান, এখানে তথ্য ভরা আছে৷ এক বছর ধরে এটি লাগানো ছিল৷ এই দলের বেশিরভাগ পাখি শীতের সময়ে নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা অথবা ভারত মহাসাগরের মাদাগাস্কার দ্বীপে হাইবারনেট করে৷ লগ দেখে আমরা সেটা জানতে পারি৷ কিছু পাখি আবার ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ, অর্থাৎ দক্ষিণ অ্যামেরিকায় চলে যায়৷ আমরা জানতে চাই, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে? কারণ পাখিরা হাইবারনেশনের জন্য নির্দিষ্ট স্থান বেছে নেয়৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাদের শীতকালীন বাসস্থান ধ্বংস হয়ে গেলে তাদের সমস্যা হবে৷''
পয়ে নতুন ডেটা লগার লাগানোর পর পাখিটি উড়ে যেতে পারে৷ গবেষকরা অনেক কিছুই জানতে পারেননি৷ তবে এটা স্পষ্ট, যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে৷ এমনকি স্যান্ডারলিং-এর মতো ছোট পাখিরাও চাপের মুখে পড়ছে৷ তারা এখানে মাটিতে সবার অলক্ষ্যে বংশবৃদ্ধি করতো৷ কারণ এখন শিয়াল ও সিগাল পাখি লেমিং খেতে না পেয়ে এখন স্যান্ডারলিং শিশু শিকার করছে৷ এ এমনই এক দুষ্টচক্র৷
জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে যা যা করতে পারেন
জলবায়ু পরিবর্তন রোধ, বিশেষ করে বিশ্ব উষ্ণায়নের মাত্রা কমানোর উপায় নিয়ে বছর জুড়েই চলে আলোচনা৷ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের উদ্যোগেরও শেষ নেই৷ ব্যক্তি পর্যায়ের ছোট ছোট কিছু উদ্যোগও কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভালো ফল বয়ে আনতে পারে৷
ছবি: picture alliance/Bildagentur-online
লাইটের বাল্ব বদলে ফেলুন
ঘরে খুব সুন্দর সুন্দর লাইট লাগিয়েছেন? সৌন্দর্য বাড়ানোর পাশাপাশি এসব লাইটের বাল্ব অনেক সময় খরচও বাড়ায়৷ বিদ্যুতের খরচ কমাতে চাইলে শিগগির এলইডি বাল্ব লাগিয়ে নিন৷ অন্য সব বাল্বের চেয়ে এলইডি বাল্ব শতকরা ৯০ ভাগ পর্যন্ত কম বিদ্যুৎ খরচ করে৷
ছবি: DW/Gero Rueter
সব কাপড় রোদে-হাওয়ায় শুকান
কাপড় শুকানোর জন্য ড্রায়ার ব্যবহার করেন? যখনই সম্ভব ধোঁয়া কাপড় ড্রায়ারে না দিয়ে বাইরে টানিয়ে দিন৷ একটু সময় লাগলেও এক সময় কাপড়গুলো ঠিকই শুকিয়ে যাবে৷ বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতি যত কম ব্যবহার করবেন, ততই উপকার৷ জানেন তো, বিশ্বের উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর? ড্রায়ার আপনার কাপড় শুকায় ঠিকই, পাশাপাশি উষ্ণতা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে৷
ছবি: picture-alliance/AP/Hussein Malla
রিসাইক্লিং
বিশ্বকে বাসযোগ্য রাখতে অনেক জিনিসই রিসাইক্লিং, অর্থাৎ পুনর্ব্যবহার করার চল শুরু হয়েছে সারা বিশ্বে৷ তবে রিসাইক্লিংয়ের চর্চা থেকে অনেক মানুষই এখনো দূরে৷ একজন একজন করে শুরু করলেও সংখ্যাটা বাড়বে৷ জলবায়ুর ক্ষতিকর পরিবর্তন রোধের জন্য সেটাও কাম্য৷
ছবি: Fotolia/TrudiDesign
ঠান্ডা পানিতে কাপড় ধোয়া ভালো
আপনি কি গরম পানিতে কাপড় ধুয়ে অভ্যস্ত? তাহলে কিন্তু গ্রিন হা্উ গ্যাস নির্গমন বাড়িয়ে আপনি জলবায়ু পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখছেন৷ ঠান্ডা পানিতে কাপড় ধোয়া মোটেই কঠিন কাজ নয়৷ সহজ এই কাজটি করেও পরিবেশের উপকার করতে পারেন৷
ছবি: Fotolia/Kzenon
হাইব্রিড গাড়ি চালান
গাড়ির ধোঁয়া পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে৷ তাই গাড়ি যদি চালাতেই হয়, তাহলে হাইব্রিড ইলেকট্রিক গাড়ি কিনুন৷ তাতে ক্ষতি কিছুটা কম৷
ছবি: picture-alliance/Photoagency Interpress
গরু, খাশির মাংস কম খান
গরু, খাশি এবং অন্যান্য পশুর মাংস খাওয়া কমিয়ে বা পুরোপুরি বাদ দিয়ে নিরামিষভোজী হলেও পরিবেশের উপকার৷
ছবি: FOX BROADCASTING/The Simpsons
স্বল্প দূরত্বে বিমানযাত্রা কমান
বিমান চলাচলেও পরিবেশের অনেক ক্ষতি৷ ফলে আপনি যদি দেশের ভেতরে এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার সময় অন্তত বিমানে না ওঠেন, তা পরিবেশ রক্ষায় কিছুটা ভূমিকা অবশ্যই রাখবে৷
ছবি: picture-alliance/P. Mayall
গাড়ি ছেড়ে বাইসাইকেল
যে কোনো ধরনের গাড়ি বর্জন করে যদি বাইসাইকেলে যাতায়াত করেন তাতে শরীর এবং পরিবেশ দুয়েরই উপকার৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
বেশি সন্তান নয়
জনসংখ্যা বাড়লে পরিবেশের ওপর চাপও বাড়ে৷ ফলে বেশি সন্তান না নেয়াই ভালো৷