এমন দৃশ্য কে না দেখেছে? মাঠের উপর চরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য গরু৷ তাদের প্রয়োজন বেড়ে চলেছে৷ বিশেষ করে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশগুলিতে মাংস খাওয়ার প্রবণতা দ্রুত বাড়ছে৷ কিন্তু পরিবেশের জন্য তার পরিণাম ভয়াবহ৷
বিজ্ঞাপন
গোটা বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য গবাদি পশুপালন অনেকটাই দায়ী৷ কিন্তু পশু না মেরেই যদি মাংস তৈরি করা যেত, তাহলে কেমন হতো?
ফ্রাউনহোফার ইন্সটিটিউটের ফ্লোরিয়ান ভিল্ড ঠিক এই অসাধ্য সাধন করার চেষ্টা করছেন৷ সহকর্মীদের নিয়ে তিনি ‘নিরামিষ' মাংসের কাটলেট তৈরির কাজ করছেন৷ প্রথমে ভুট্টা, মটরশুটি বা সয়াবিন পানিতে ঢালেন ফ্লোরিয়ান৷ খাদ্যের প্রোটিন নিয়েই তাঁর আগ্রহ বেশি৷ তিনি বলেন, ‘‘কাজ শুরুর সময় এই হলো মাল-মশলা৷ এরপর এগুলি আরেকটু প্রস্তুত করে, শুকিয়ে নিয়ে মাংসের বিকল্প তৈরির কাজে লাগানো হবে৷''
ফ্লোরিয়ান ভিল্ড এই মিশ্রণ গবেষণাগারের ফিল্টার প্লান্টে আনেন৷ সেখানে এক যন্ত্র দিনে প্রায় ১,০০০ লিটার মিশ্রণ তৈরি করতে পারে৷ সেই মিশ্রণ দিয়ে প্রায় ২০০ কিলোগ্রাম নিরামিষ মাংস তৈরি করা হয়৷ ভিল্ড বলেন, ‘‘এই প্লান্টের মূল অংশ হলো এই ফিল্টার মডিউল৷ ফিল্টারে খুব সূক্ষ্ম ও নির্দিষ্ট মাপের ফুটো রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে শর্করা গলে গেলেও প্রোটিন আটকে যায়৷''
এর পরের ধাপে নিরামিষ এই পাউডারের কনসেন্ট্রেট গবেষণাগারে এক ধরনের হাই টেক প্রেশার কুকারে ভরা হয়৷ যার সঙ্গে আবার ঠাণ্ডা করার যন্ত্রও লাগানো রয়েছে৷
প্রথমে সেই পাউডারে পানি মেশানো হয়৷ একই সঙ্গে প্রবল চাপের মধ্যে প্রায় ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সেটা গরম করা হয়৷ তারপর আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা করা হয়৷ তখন বেশ আঠালো আঁশের মতো পদার্থ সৃষ্টি হয়৷ তখন সেটাকে সত্যি আসল মাংসের মতে দেখতে লাগে৷ খেতে কেমন লাগে? ভিল্ড বলেন, ‘‘এখনই কিন্তু এই মিশ্রণ খাওয়া যেতে পারে৷ যেমন চেয়েছিলাম, মাংসের মতো সেই বিন্যাস এখনো হয়নি৷ অনেকটা ময়দা মাখার মতো লাগছে৷''
জার্মানরা মাংস খেতে বেশি ভালোবাসেন
জার্মানরা প্রায় প্রতিদিনই মাংস খায় যদিও ডাক্তারদের মতে, কেউ দিনে ১০০ গ্রামের বেশি মাংস খেলে তাঁর হৃদরোগের ঝুঁকি এবং পাকস্থলীর ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়৷
ছবি: aquariagirl1970 - Fotolia.com
প্রতিদিন মাংস
জার্মানদের খাবারের তালিকায় প্রায় প্রতিদিনই মাংস থাকা চাই৷ মাংস রান্না বা সেদ্ধ অবস্থায়, এছাড়া সসেজ, সালামি, হ্যাম – কোনো না কোনোভাবে তাঁদের খাবার টেবিলে থাকে মাংস৷ তবে অতিরিক্ত মাংস খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয় এবং এতে নানা সমস্যা দেখা যায়, সে কথা জেনেও তাঁরা মাংস পছন্দ করেন৷
ছবি: picture-alliance/landov
সপ্তাহে ৬০০ গ্রাম মাংস
একজন প্রাপ্তবয়স্ক জার্মান গড়ে দিনে ১৫০ গ্রাম মাংস খান, অর্থাৎ সপ্তাহে যা ১০০০ গ্রামেরও বেশি৷ অথচ ডাক্তাদের মতে, একজন মানুষ সপ্তাহে ৬০০ গ্রাম মাংস খেতে পারেন এবং এর বেশি খাওয়া একেবারেই উচিত নয় যদি সে মাংস ‘রেড মিট’ হয়৷ গরু, ছাগল, শূকর, ভেড়া এবং ঘোড়ার মাংসকে ‘রেডমিট’ বলা হয়৷
ছবি: Fotolia/stockcreations
ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়
ডাক্তারদের মতে, কেউ দিনে ১০০ গ্রামের বেশি ‘রেডমিট’ খেলে তাঁর হৃদরোগের ঝুঁকি এবং পাকস্থলীর ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়৷ সে তুলনায় সাদা মাংস, অর্থাৎ মুরগি বা পাখির মাংস খেলে ঝুঁকি অনেক কম৷
ছবি: picture alliance/dpa
পরিমিত পরিমাণ
মাংসতে রয়েছে প্রোটিন, আয়রন এবং ভিটামিন ‘বি’৷ জার্মানির পট্সডাম রেব্র্যুক-এর খাদ্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড.গিজেলা ওলিয়াস বলেন, রেডমিট হৃদরোগ এবং পাকস্থলীর ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় ঠিকই৷ তবে মাংসের তৈরি সসেজ কিন্তু এই ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় আরো বেশি৷
ছবি: picture alliance/chromorange
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিটকাটার
জার্মান মাংসের দোকানের কর্মীরা প্রায় সকলেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত৷ এখানে যে কোনো জায়গায় কাজ করতে গেলে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ থাকতে হয় – তা সে মাংস কাটার কাজ হোক, অথবা অন্য কোনো কাজ৷
ছবি: DW
গ্রিল মাংস
আগুনে পোড়ানো বা গ্রিল করা রসালো মাংস দেখতে যেমন লোভনীয়, তেমন খেতেও দারুণ মজা৷ তাই গ্রীষ্মকালে জার্মানরা প্রায়ই গ্রিল পার্টির আয়োজন করেন, যেখানে প্রচুর পরিমাণে মাংস খাওয়া হয়৷
ছবি: DW/K.Sacks
আরো গ্রিল
নানাভাবে বিভিন্ন পশুর বিভিন্ন অংশের মাংস গ্রিল করা হয়৷ তবে জার্মানরা বেশিরভাগই গ্রিল করেন শূকরের মাংস৷ এসব লোভনীয় গ্রিল দেখে কারো কি মনে থাকার কথা যে, একজন মানুষের দিনে মাত্র ১০০ গ্রাম মাংস খাওয়া উচিত?
ছবি: DW/K.Sacks
দামে সস্তা
গরু বা খাসির মাংসের তুলনায় শূকরের মাংস দামের দিক দিয়ে অনেক সস্তা৷ আর সেজন্যই হয়ত শূকরের মাংস জার্মানিতে বেশি খাওয়া হয়ে থাকে৷ এবং সেটা হয়ে থাকে নানাভাবেই!
ছবি: picture alliance / Fotoagentur Kunz
পাউরুটির সাথেও মাংস
জার্মানরা সকালের নাস্তা বা রাতে রুটির সাথেও মাংসের সসেজ বা মাংসের স্লাইস খান৷ এছাড়া, বিভিন্ন দোকানে, ক্যাফেতে নানা ধরনের রুটির মধ্যে ‘স্যান্ডউইচ’ আকারে মাংস ভরে খাবারও চল আছে জার্মানিতে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ড্যোনার কাবাব
জার্মানিতে অনেক তুর্কি রেস্তোরাঁ আছে এবং এসব রেস্তোরাঁর বেশিরভাগ খাবারই মাংস দিয়ে তৈরি৷ বিশেষ করে ‘ড্যোনার কাবাব’ তরুণদের কাছে বেশ প্রিয়৷ এটা একরকম পাতলা রুটির মধ্যে সবজি এবং গ্রিল করা মাংস দিয়ে তৈরি করে হয়৷ বলা বাহুল্য, জার্মানিতে ৪০ লাখ মুসলমানের বাস, যাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই এসেছেন তুরস্ক থেকে৷
হালাল মাংস
জার্মানিতে তুর্কি দোকানগুলোতে হালাল মাংসও পাওয়া যায়৷ সেসব দোকানে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মুসলমানসহ জার্মানরাও মাংস কেনেন৷
ছবি: aquariagirl1970 - Fotolia.com
11 ছবি1 | 11
নিরামিষ এই মাংসে প্রোটিন ও আঁশ রয়েছে, তবে ফ্যাট বেশি নেই৷ অনেকটা মুরগির মাংসের মতো৷ চিবানোর সময়ও সেরকমই লাগে৷
ফ্লোরিয়ান জানেন, যারা মাংস খেতে অভ্যস্ত, তাদের মন জয় করতে হলে স্বাদও ভালো হওয়া চাই৷ তাই গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি নানা রকম মসলার সুগন্ধ নিয়েও পরীক্ষা চালাচ্ছেন৷ তাঁরা যদি ভবিষ্যতে যদি সত্যি ভালো মানের বিকল্প মাংস তৈরি করতে পারেন, তাহলে বিপুল সম্ভাবনার দরজা খুলে যাবে৷ তিনি বলেন, ‘‘নিরামিষ এই কাটলেট তৈরির উপকরণ উৎপাদনের জন্য অনেক কম জমি লাগে৷ মাঠ থেকে তুলে আনলেই হলো৷ তাই নিরামিষ কাটলেট তৈরির জন্য যে চাষের জমি চাই, তা থেকে আরও বেশি মানুষের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করা সম্ভব৷''
গোটা বিশ্বে খাদ্য সমস্যা কমানোই ফ্লোরিয়ান ভিল্ড-এর স্বপ্ন৷ সেইসঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদেরও সাশ্রয় হবে৷ কারণ মটরশুটি, ভুট্টা বা সয়াবিনের মাংস তৈরির সময় অনেক কম জ্বালানি, পানি ও জমির প্রয়োজন হয়৷ গবাদি পশুচারণের সময় যা অনেক বেশি লাগে৷