ইউরো এলাকার শীর্ষ সম্মেলনে গ্রিসের জন্য নতুন সহায়তার সিদ্ধান্তের পর আলেক্সিস সিপ্রাসকে এবার কাজ করে দেখাতে হবে৷ এবার সংস্কারের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার পালা৷ স্পিরোস মস্কোভু মনে করেন, সেটা মোটেই সহজ হবে না৷
বিজ্ঞাপন
সংকটে জর্জরিত গ্রিসের মানুষকে আত্মসম্মান ও গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জনমোহিনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বামপন্থি পপুলিস্ট নেতা আলেক্সিস সিপ্রাস৷ এভাবে তিনি জানুয়ারির শেষে আয়োজিত আগাম নির্বাচনে নিজের ক্ষমতা নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন৷ তারপর চটজলদি গণভোটের আয়োজন করে বিপুল সমর্থন পেয়ে তিনি আন্তর্জাতিক দাতাদের ‘ইমপ্রেস' করতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু তাতে কোনো ফল হলো না৷ শেষে গ্রিসের বিরুদ্ধে প্রায় সবাই যেভাবে একজোট হয়ে পড়লো যে, আলেক্সিস সিপ্রাস-এর স্বপ্ন এক জাতীয় বিপর্যয়ে পরিণত হলো৷ গ্রিস সংক্রান্ত ইউরোজোনের সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলন নাটকীয় মাত্রা অর্জন করেছিলো৷ দীর্ঘ ১৭ ঘণ্টার এই সম্মেলনে সিপ্রাস শেষরক্ষার জন্য অনেকটা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন৷ গ্রিস ইউরো এলাকায় টিকে গেলো বটে, কিন্তু কড়া শর্তের বেড়াজাল সে দেশকে ঘিরে রইলো৷
দেশ শাসন করা অত সহজ নয়
গত সোমবার থেকে গ্রিক প্রধানমন্ত্রী সেই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, যার জন্য রাজনীতিকদের আদৌ নির্বাচিত করা হয় – অর্থাৎ দেশ শাসন করার জন্য৷ দেশে ব্যাংকগুলি বন্ধ রয়েছে – এই অবস্থায় শুধু মানুষের সম্মান নিয়ে বুলি আওড়ানো আর যথেষ্ট নয়৷ বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে শুধু বিদেশকে গালি দিলেও চলে না৷
এখন দেখা যাচ্ছে, দেশ চালানো মোটেই সহজ কাজ নয়৷ সিপ্রাস-এর মন্ত্রিসভার কমপক্ষে দু'জন সদস্য ইইউ-সহযোগীদের সঙ্গে বোঝাপড়ার চরম বিরোধী৷ সিরিসা পার্টির প্রায় ৪০ জন সংসদ সদস্য বুধবার চুক্তির বিরুদ্ধে ভোট দেবেন বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন৷ চরম দক্ষিণপন্থি জোটসঙ্গি দলের নেতা ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী কামেনস অবশ্য সংসদে সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছেন৷ তবে ভবিষ্যতে সংস্কারের অন্য কোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে পারেন বলে হুমকিও দিয়ে রেখেছেন তিনি৷
গ্রিসের প্রতি ইইউ-র ‘ছোট’ দেশগুলোও নারাজ
পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশই আজ ঋণ মকুব করে গ্রিসকে সাহায্য করতে নারাজ৷ ব্যয় সংকোচ ও কড়া সংস্কারের সুফল ভোগ করে এ সব দেশ আজ প্রতিযোগিতার বাজারে নিজেদের সাফল্য অর্জন করেছে৷ গ্রিসও সংস্কার চালাক – এটাই তাদের প্রত্যাশা৷
ছবি: picture alliance/dpa/Y. Behrakis
সাফল্যের গর্বে লিথুয়েনিয়া
লিথুয়েনিয়ার প্রেসিডেন্ট ডালিয়া গ্রিবাউসকাইটে ইউরো এলাকার জরুরি শীর্ষ সম্মেলনে গ্রিক প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাস সম্পর্কে কড়া মন্তব্য করেন৷ তাঁর মতে, গ্রিস শুধু কথার খেলাপ করে চলে৷ আজ কিছু করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরে সেটা আগামীকাল ঠেলে দেয়৷ উল্লেখ্য, প্রায় ২৫ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল লিথুয়েনিয়া৷ কঠিন সংস্কার ও অনেক ত্যাগের পর সে দেশ আজ নিজস্ব সাফল্যে গর্বিত৷
ছবি: DW
ইউরোপের সিলিকন ভ্যালি এস্টোনিয়া
সোভিয়েত আমলের বিশাল আমলাতন্ত্র ঝেড়ে ফেলে এস্টোনিয়া আজ তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চমকপ্রদ সাফল্য দেখাচ্ছে৷ অথচ সরকারের কড়া সংস্কার কর্মসূচি সত্ত্বেও সে দেশের মানুষ চরম আত্মত্যাগ স্বীকার করে আজকের অবস্থায় পৌঁছেছেন৷ সে দেশের প্রেসিডেন্ট টোমাস হেন্ডরিক ইলভেস বলেন, ইউরো এলাকার বাকি ১৮টি দেশে গ্রিসকে বাঁচাতে কর বাড়ানোর প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন করলে মানুষ কী রায় দেবে, একবার ভেবে দেখেছেন?
ছবি: Lingvist
বাণিজ্যে লাটভিয়ার সাফল্য
লিথুয়েনিয়ার মতো লাটভিয়াও অতীতের বোঝা ঝেড়ে ফেলে নিজস্ব কৌশলগত অবস্থানের ফায়দা তুলেছে৷ রাশিয়া ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে দেশটি৷ ২০০৪ সালে লিথুয়েনিয়ায় ইউরো চালু হয়৷ ফলে অঞ্চলের অন্যান্য অনেক দেশের মতো সে দেশের প্রেসিডেন্ট ভাল্ডিস ডমব্রফস্কিস মনে করেন, গ্রিসেও সংস্কার ছাড়া কোনো সমাধানসূত্র সম্ভব নয়৷ এই সত্য মেনে না নিলে ‘গ্রেক্সিট’ অনিবার্য৷
ছবি: Reuters
স্লোভাকিয়ার গাড়ি শিল্প
শুধু সংস্কার ও ব্যয় সংকোচের মাধ্যমে নয় – শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদের মূলধন করে স্লোভাকিয়া গাড়ি নির্মাতাদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে৷ জার্মানির ফলক্সভাগেন বা দক্ষিণ কোরিয়ার কিয়া কোম্পানি সে দেশে উৎপাদন করতে এগিয়ে এসেছে৷ অপেক্ষাকৃত কম মজুরি স্লোভাকিয়ার জন্য বাড়তি সুবিধা বয়ে এনেছে৷ বিদেশি বিনিয়োগ অর্থনৈতিক উন্নতি আরও তরান্বিত করেছে৷
ছবি: DW/E. Schuhmann
সাবেক ইয়ুগোস্লাভিয়ায় দক্ষতার প্রতীক স্লোভেনিয়া
ইয়ুগোস্লাভিয়া ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেছে৷ স্লোভেনিয়া কিন্তু তার অতীতের সুনাম ও সংস্কার কর্মসূচির ভিত্তিতে অতি কম সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউরো এলাকার সদস্য হয়ে উঠতে পেরেছে৷ সংকটের মুখে ব্যাংকিং ব্যবস্থার কড়া সংস্কার করতে পেরেছে দেশটি৷ বেসরকারিকরণের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে৷ ফলে আজ সে দেশের সমৃদ্ধির ভিত্তি বেশ মজবুত৷
ছবি: Reuters
‘আমাদের সমৃদ্ধির অভ্যাস নেই’
পোল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান মারেক বেলকা একবার পূর্ব ইউরোপের মানুষের সহ্যশক্তি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের এখনো সমৃদ্ধির অভ্যাস হয়নি৷’’ তাঁর মতে, এই অঞ্চলের মানুষের অভিজ্ঞতা হলো, সংকট সামনে এলে সংস্কারের মাধ্যমে তা অতিক্রম করা যায়৷ আজকের কষ্ট আগামীকাল সুফল বয়ে আনে৷
ছবি: AP
গ্রিক ট্র্যাজিডি
গ্রিস একেবারেই সংস্কারে নারাজ – এই অভিযোগ পুরোপুরি সত্য নয়৷ আন্তর্জাতিক দাতাদের চাপে সে দেশ এখনো পর্যন্ত যে সংস্কার চালিয়েছে, তার ফলে সাধারণ মানুষেরই বেশি ক্ষতি হয়েছে৷ কিন্তু বিশাল আমলাতন্ত্র, কর আদায়ে গাফিলতি, প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল ব্যয়ের মতো কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রে সদিচ্ছার প্রমাণ দেখা যাচ্ছে না৷ অতীতের ঋণভার ছাড়াও রাষ্ট্রের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বিশাল ফারাক গ্রিসের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করে তুলছে৷
ছবি: Reuters/S. Rapanis
7 ছবি1 | 7
গ্রিসের কাছে অস্তিত্বের প্রশ্ন
কমপক্ষে গত সপ্তাহান্তেই সিপ্রাস পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, এটা ধরে নেওয়া যায়৷ গ্রিসের অবক্ষয় রুখতে তিনি নিজস্ব শিবিরে বিদ্রোহ দমিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন৷ ব়্যাডিকাল মন্ত্রীদের বিদায় করতে হবে৷ অর্থাৎ তাঁকে মন্ত্রিসভা আরও ছোট করে সাজাতে হবে৷
তবে গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী যেটা সম্ভবত এখনো বুঝতে পারছেন না, সেটা হলো সংস্কারের পদক্ষেপগুলি অনুমোদিত হলে কিছুই হবে না৷ সেগুলির বাস্তবায়ন করার সময়েই তাঁর আসল কাজ শুরু হবে৷ তখন তাঁর পার্টি বাস্তববাদী ও আদর্শবাদী শিবিরে ভাগ হয়ে গেলে তাঁর কোনো লাভ হবে না৷ সামাজিক ভাতার অভাব মেটাতে রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা, একদিকে ধনীদের শয়তান হিসেবে তুলে ধরা ও একই সঙ্গে তাদের আড়াল করা এবং বিশাল অকেজো আমলাতন্ত্রকে উজ্জ্বল ঐতিহ্য হিসেবে গণ্য করা – সিরিসা দলের এমন পশ্চাদবর্তী রাজনৈতিক আদর্শেরও কোনো মূল্য থাকবে না৷ ইউরো এলাকার সদস্য হিসেবে আধুনিক ও প্রতিযোগিতার বাজারে দক্ষ এক গ্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে এমন ভাবাদর্শের কোনো সম্পর্ক নেই৷ মোটকথা বুধবার সংসদে ভোটাভুটির পরেও দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না৷ নতুন সূচনার জন্য এটা একেবারেই সুখবর নয়৷