কয়েক বছর আগে পর্যন্তও ইউরোপে গ্রীষ্মকাল বেশ মনোরম ছিল৷ কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে প্রতি বছর উত্তাপ বেড়ে চলেছে৷ সেই অবস্থা সহনীয় করে তুলতে বিজ্ঞানীরা নানা পথ বাতলে দিচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
ডিয়র্ক ফুংক শহরাঞ্চলের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ৷ উত্তাপ কমাতে কার্যকর উপায়ের সন্ধান করছেন তিনি৷ বার্লিন শহরের প্রায় এক নিখুঁত মডেল তাঁকে সেই কাজে সাহায্য করতে পারে৷ শহর হিসেবে বার্লিনও ‘আর্বান হিটিং'-এর সমস্যায় জর্জরিত৷ থার্মাল ইমেজে শহরের বসতি এলাকাগুলি রান্নার চুলার মতো দেখায়৷ ফলে আশেপাশের এলাকার সঙ্গে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পার্থক্য চোখে পড়ে৷
গবেষকেরা এক ক্ষুদ্র সংস্করণে এই সমস্যা থেকে নিষ্কৃতির পথ দেখাচ্ছেন৷ হাজার ওয়াটের একটি বাতি তাতে সূর্যের ভূমিকা পালন করছে৷ মডেলে বসতি এলাকার জায়গায় বরফের এক চাঙড় দেখিয়ে দিচ্ছে, উত্তাপ কীভাবে প্রবেশ করে৷ পরীক্ষামূলক ভবনটি প্রচলিত উপকরণ দিয়েই তৈরি৷ ডিয়র্ক ফুংক বলেন, ‘‘ইটের তৈরি বাড়ির উপর রোদ পড়লে কী ঘটে, কীভাবে তা গরম হয়ে যায়, আমরা তা দেখতে চাই৷ ইটের বদলে অন্য উপকরণ ব্যবহার করলে, বাইরের অংশ ইনসুলেট করলে অথবা সামনে বড় গাছ লাগালে কী হয়, সেটাও জানতে চাই৷’’
জলবায়ু পরিবর্তন: পালটে যাচ্ছে নদীও
কেবল খাবার পানি নয়, অন্য নানা কাজেই নদীর ওপর নির্ভর করতে হয় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে৷ কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ এই জল সরবরাহ প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দিচ্ছে৷
ছবি: AFP/Rammb/Noaa/Nesdis
পানির অপর নাম...
বিশ্বের মোট জলের বেশিরভাগই রয়েছে সমুদ্রে৷ মোট জলের কেবল ১০০ ভাগের এক ভাগ নদী দিয়ে বয়ে যায়৷ কিন্তু এই নদীগুলো ছাড়া ভূপৃষ্ঠে মিষ্টি পানি অন্যসব উৎস, যেমন হ্রদ ও জলাভূমি শুকিয়ে যাবে৷ এরই মধ্যে এমন আলামত দেখা যেতে শুরু করেছে৷ কেবল মানবজাতি নয়, প্রাণিজগত ও উদ্ভিদজগতেও পড়ছে এর প্রভাব৷
ছবি: picture-alliance/APA/B. Gindl
দশকের পর দশক
ওপরে আফ্রিকার শাড হ্রদের ১৯৬৩, ১৯৭৩, ১৯৮৭ এবং ১৯৯৭ সালের ছবি দেখানো হয়েছে৷ দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৬০ বছরে হ্রদটির আকার ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার থেকে কমে দুই হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও নীচে নেমে এসেছে৷ দীর্ঘদিন ধরে এর জন্য বাঁধ ও সেচব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়েছে৷ কিন্তু গবেষকরা জানতে পেরেছেন, এই অঞ্চলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নদী কোমাদুগুর জলও ধীরে ধীরে তাপমাত্রার ওঠানামার কারণে কমে এসেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NASA
জীববৈচিত্র্য এবং খাদ্য সংকট
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষ কিভাবে বাধ্য হচ্ছে খাদ্য ও জলের নতুন উৎস খুঁজে নিতে, শাড হ্রদ তার অন্যতম উদাহরণ৷ কৃষক এবং পশু খামারের মালিকেরা জলের জন্য ধীরে ধীরে উর্বর জমির সন্ধানে যাচ্ছেন৷ কিন্তু উর্বর জমি কমে যাওয়ায় অঞ্চলটিতে জমি নিয়ে উত্তেজনাও দেখা দিয়েছে৷ অন্য বিভিন্ন মহাদেশেও অত্যধিক গরমে নদীর জল শুকিয়ে যাওয়া এবং মাছ মরে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP Photo/R. F. Bukaty
ইউরোপেও তাপদাহ
২০১৮ সালের গ্রীষ্মে তাপদাহ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, খরস্রোতা রাইন নদীর জল শুকিয়ে খালের আকার ধারণ করে৷ তাপমাত্রা একসময় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসও ছাড়িয়ে যায়৷ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ মালামাল পরিবহনে রাইন নদীর ওপর নির্ভর করে৷ কিন্তু এক পর্যায়ে প্রশস্ত এ নদী এতটাই অগভীর হয়ে পড়ে যে, কেবল একটি লেন চলাচলের জন্য চালু রাখা সম্ভব হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gambarini
গলে যাচ্ছে হিমবাহ
পানীয় জলের নির্ভরযোগ্য উৎসগুলোও হুমকির মুখে৷ বিভিন্ন পর্বতমালায় জমে থাকা হিমবাহকে জলের আধার মনে করা হয়৷ শীতকালে প্রচুর জল বরফ আকারে জমিয়ে রাখে হিমবাহগুলো৷ গ্রীষ্মকালে সে বরফ গলেই বিভিন্ন নদীতে জল যায়৷ হিমবাহগুলো অন্তত ২০০ কোটি মানুষের জল সরবরাহ করে৷ কিন্তু এরই মধ্যে বিভিন্ন হিমবাহে বরফ কমতে শুরু করেছে৷ বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এ শতাব্দীর শেষের দিকে হিমালয়ের তিন ভাগের এক ভাগ বরফ একেবারে গলে যাবে৷
ছবি: DW/Catherine Davison
হিমালয় ও দক্ষিণ এশিয়া
সিন্ধু অববাহিকার কৃষকেরা বিভিন্ন শস্য চাষের জন্য হিমালয়ের বরফ গলা পানির ওপর নির্ভর করেন৷ পুরো অঞ্চলটি সুপেয় জল ছাড়াও সেচ, মাছ ও পরিবহনের জন্য অনেকাংশেই নির্ভর করে সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ওপর৷ এই তিন অববাহিকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্তত ১৩ কোটি কৃষক ও ৯০ কোটি বাসিন্দার জলের জোগান দেয়৷
ছবি: Imago/Aurora
দাবানল
ছবিতে দেখানো অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের মতো সম্প্রতি অনেক ভয়াবহ দাবানল দেখেছে বিশ্ব৷ জলবায়ু পরিবর্তনের আরেক দিক এটি৷ দাবানল নদীও ক্ষতি করছে৷ অস্ট্রেলিয়ার দাবানলে গাছ পুড়ে ছাই পড়ছে মারে-ডার্লিং অববাহিকার নদীতে৷ এর ফলে নদীর জল দূষিত হচ্ছে৷ এতে কেবল নদীর জলের ওপর নির্ভরশীল ২৬ লাখ মানুষ নয়, অনেক প্রজাতির প্রাণীও পড়েছে হুমকির মুখে৷
ছবি: Reuters/Maxar Technologies
শ্যাওলা এবং ডেড জোন
কেবল দাবানলের ছাইই যে নদীর ক্ষতি করে, এমনও না৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অতিবৃষ্টির ফলে নানা কারখানার বর্জ্য আরো দ্রুত নদী হয়ে সাগরে গিয়ে পড়ছে৷ এর ফলে নিউ ইয়র্ক উপকূলের মতো বিশাল এলাকা জুড়ে শ্যাওলা জন্মে সেখানকার জীববৈচিত্র্যে প্রভাব ফেলছে৷ কোনো কোনো স্থানে অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ডেড জোনের সৃষ্টি হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/NASA
বৃষ্টি বেশি মানেই সুখবর নয়
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া মিসিসিপি নদীতে নাইট্রোজেন দূষণ একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে৷ অতিবৃষ্টির ফলে আরো বেশি বর্জ্য ও নাইট্রোজেন জমা হচ্ছে নদীর জলে৷ একই সঙ্গে বন্যা ও সংখ্যায় ক্রমশ বাড়তে থাকা হারিকেনও ফেলছে প্রভাব৷
ছবি: AFP/Rammb/Noaa/Nesdis
9 ছবি1 | 9
টাইম ল্যাপ্স ছবির মাধ্যমে এমন ভবনের বাসিন্দাদের অবস্থা দেখানো হচ্ছে৷ বাড়িটি গরম হতে মাত্র আধ ঘণ্টা সময় লাগে৷ এত কম সময়ের মধ্যে তাপমাত্রার এমন পরিবর্তন ঘটে৷ ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি গরমে মানুষ কষ্ট পায়৷
এ ক্ষেত্রে তথাকথিত ‘অ্যালবেডো' মাত্রারও একটা ভূমিকা রয়েছে৷ নির্মাণের উপাদানের রং অনুযায়ী সূর্যের রশ্মির প্রতিফলনের তারতম্য দেখা যায়৷ কালো স্লেটের ক্ষেত্রে ‘অ্যালবেডো' মাত্রা যেমন শূন্য দশমিক এক শতাংশ৷ অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে মাত্র ১০ শতাংশ রশ্মির প্রতিফলন ঘটে৷ ছাদের উপর লাল টালির মাত্রা শূন্য দশমিক এক থেকে শূন্য দশমিক তিন পাঁচ শতাংশ৷ সাদা রংয়ের দেওয়ালের ‘অ্যালবেডো' মাত্রা শূন্য দশমিক পাঁচ থেকে শূন্য দশমিক নয়ের মতো৷ বাড়ির বাইরের অংশ বা ছাদের ‘অ্যালবেডো' মাত্রার উপর শহরের কোনো ভবনের উত্তাপ নির্ভর করে৷
সহজ পদক্ষেপের মাধ্যমে সেই অবস্থার উন্নতির চেষ্টা চলছে৷ প্রথমে বাইরে থার্মাল ইনসুলেশন প্যানেল বসানো হলো৷ ডিয়র্ক ফুংক বলেন, ‘‘আমরা এবার ভবনের উপর এই পদক্ষেপের প্রভাব পরীক্ষা করতে চাই৷ কারণ ইনসুলেশনের ফলে উত্তাপ শুধু ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না, বরং সেই উত্তাপ আদৌ ঘরে প্রবেশ করতেই দেওয়া হয় না৷’’
সেইসঙ্গে উজ্জ্বল রং লাগানো হয়েছে৷ ফলে সূর্ষের আলোর প্রতিফলন ঘটিয়ে উত্তাপও দূরে রাখা হচ্ছে৷ ছাদের উপর সবুজ বাগান এবং ভবনের বাইরের অংশে ইনসুলেশন ও উজ্জ্বল রংয়ের ব্যবস্থার পর হাজার ওয়াট সূর্যের আলো আরও আধ ঘণ্টা চালু রাখা হলো৷ সেইসঙ্গে কয়েকটি বড় গাছের ছায়ারও ব্যবস্থা করা হলো৷ হাতেনাতে তার ফল পাওয়া গেল৷ ঘরের মধ্যে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস মনোরম তাপমাত্রা কার না ভালো লাগে? ফলে দেখা যাচ্ছে যে শহরে উত্তাপের সমস্যা কমাতে রংও কিছুটা সাহায্য করতে পারে৷