জাতিসংঘের জলবায়ু সংক্রান্ত শীর্ষ সম্মেলনে গ্রেটা টুনব্যার্গের ভাষণ আলোড়ন তুলেছে৷ ৭৭টি দেশ স্পষ্ট লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে৷ জার্মান চ্যান্সেলর ম্যার্কেল তাঁর ভাষণে জার্মানির পদক্ষেপ তুলে ধরেন৷
ছবি: Reuters/C. Allegri
বিজ্ঞাপন
জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব নিয়ে প্রায় সবার মনে সংশয় কেটে গেলেও সরকারি পর্যায়ে তার মোকাবিলা করার যথেষ্ট উদ্যোগ এখনো দেখা যাচ্ছে না৷ চুক্তি, ঘোষণাপত্র, সদিচ্ছার মতো আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই গোটা প্রক্রিয়া থমকে রয়েছে৷ অনেক রাজনৈতিক নেতা অর্থনৈতিক স্বার্থের দোহাই দিয়েও পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব কমিয়ে দেখাচ্ছেন৷ ঠিক এই মনোভাবের বিরুদ্ধেই আবার গর্জে উঠলেন সুইডেনের কিশোরী গ্রেটা টুনব্যার্গ৷ মোট ১৫ জন তরুণ জলবায়ু অ্যাকটিভিস্ট তাঁদের বক্তব্য রাখেন৷
সোমবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের জলবায়ু সংক্রান্ত শীর্ষ সম্মেলনে আবেগভরা ভাষণ দেন টুনব্যার্গ৷ বিশ্বনেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘‘আমরাবিশাল মাত্রায় বিলুপ্তির পথে চলতে শুরু করেছি৷ আর আপনারা শুধু টাকাপয়সা আর অনন্তকাল ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির রূপকথার কাহিনি শুনিয়ে চলেছেন৷ কী সাহস আপনাদের!'' রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতার অভিযোগ করে গ্রেটা আরও বলেন, ‘‘আমাদের কাছে আপনারা ব্যর্থ হচ্ছেন৷ কিন্তু তরুণ প্রজন্ম আপনাদের বিশ্বাসঘাতকতা বুঝতে পারছে৷''
উপস্থিত রাজনৈতিক ও শিল্পজগতের নেতারা গ্রেটা টুনব্যার্গের আবেগময় ভাষণ শুনে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেবেন কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়৷ বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রক্রিয়ায় মানুষের ভূমিকা মানতে অস্বীকার করে চলেছেন, তার ফলে প্যারিস চুক্তি রূপায়নের উদ্যোগ ধাক্কা খাচ্ছে৷ সোমবার ট্রাম্প কোনো ঘোষণা ছাড়াই ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে সঙ্গে নিয়ে কিছু সময়ের জন্য সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন৷ তিনি জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষণের অংশবিশেষ শোনেন৷ জলবায়ু সম্মেলন সম্পর্কে আগ্রহ দেখিয়ে ট্রাম্প বলেন, তিনি পরিষ্কার বাতাস ও পরিষ্কার পানিতে বিশ্বাস করেন৷
জার্মান চ্যান্সেলর ম্যার্কেল তাঁর ভাষণে বলেন, মানুষের কারণেই যে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক সমাজকে গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানী ও তরুণতরুণীদের বার্তা শোনা উচিত৷ তিনি এ প্রসঙ্গে জার্মান সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলি তুলে ধরেন৷ এর আওতায় ২০২৮ সালের মধ্যে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে৷ জার্মানি এছাড়া ‘সবুজ জলবায়ু তহবিল'-এ ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার চাঁদা দেবে বলে জানিয়েছে৷ অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব মোকাবিলা করতে সাহায্য করতে এই তহবিল সৃষ্টি করা হয়েছে৷
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস সম্মেলনের ফলাফল সম্পর্কে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন৷ তিনি আগেই বিশ্বনেতাদের উদ্দেশ্যে ‘সুন্দর ভাষণের বদলে স্পষ্ট পদক্ষেপ' ঘোষণার আহ্বান করেছিলেন৷ গুতেরেস বলেন, শিল্পোন্নত বিশ্বের কয়েকটি দেশ সহ মোট ৭৭টি দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন সম্পূর্ণ বন্ধ করতে স্পষ্ট উদ্যোগের অঙ্গীকার করেছে৷
গ্রেটা টুনব্যার্গ: ইকোলজির জাস্টিন বিবার?
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সোচ্চার সুইডেনের ১৬ বছর বয়সি শিক্ষার্থী গ্রেটা টুনব্যার্গ৷ সম্প্রতি তাঁর কারণে সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল৷
ছবি: Getty Images/S. Silbiger
একাকিনী
২০১৮ সালের আগস্টে সুইডেনের গণমাধ্যম আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিল৷ সেই সময় প্রথমে তিন সপ্তাহ এবং পরে প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার স্কুলে না গিয়ে সংসদের সামনে একাই বিক্ষোভ শুরু করেছিল গ্রেটা টুনব্যার্গ৷ তখন সে নবম শ্রেণিতে পড়তো৷
ছবি: picture-alliance/DPR/H. Franzen
সম্ভাব্য নোবেলজয়ী
বিক্ষোভ শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই বিশ্বে আলোচিত হয়ে ওঠে গ্রেটা৷ জাতিসংঘের উদ্যোগে গতবছর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনে সে জাতিসংঘের মহাসচিবসহ কয়েকজন বিশ্বনেতার সঙ্গে কথা বলে৷ এছাড়া গত জুলাইতে ফ্রান্সের সংসদে এবং সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দুটি হাউস কমিটির শুনানিতে অংশ নেয়৷ বারাক ওবামার সঙ্গেও দেখা করেছে সে৷ অনেকেই তাকে সম্ভাব্য নোবেলজয়ী হিসেবে দেখছেন৷ এ বছরের ‘বিকল্প নোবেল’ পুরস্কারও পেয়েছে সে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/The Obama Foundation
যেভাবে শুরু
আট কি নয় বছর বয়সে শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রথম জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে পারে গ্রেটা টুনব্যার্গ৷ তখন থেকে সে দুধ ও মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয়৷ এমনকি ‘একেবারে প্রয়োজন’ না হলে নতুন কিছু কেনেনা৷ ছবিতে গ্রেটাকে গতবছরের জলবায়ু সম্মেলনে দেখা যাচ্ছে৷ সুইডিশ সংসদের সামনে এভাবেই বসে থাকতো সে৷
ছবি: Luise Osborne/DW
পরিবারে শুরু
গ্রেটার কারণে তার মা, বাবা ও ছোট বোন জীবনযাপনে পরিবর্তন এনেছেন৷ যেমন গ্রেটার মা অপেরা গায়িকা হওয়ায় একসময় সারা পৃথিবীতে কনসার্ট করতেন৷ কিন্তু বিমানযাত্রায় অনেক বেশি কার্বন নির্গত হওয়ায় এখন শুধু নরডিক দেশগুলোতে কনসার্টে যান তিনি৷ ছবিতে অভিনেতা বাবার সঙ্গে গ্রেটাকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/K. Betancur
পালতোলা নৌকায় আটলান্টিক পাড়ি
মা যেমন বিমানযাত্রা কমিয়ে দিয়েছেন গ্রেটাও সেই পথ বেছে নিয়েছে৷ সম্প্রতি পালতোলা নৌকায় করে সে নিউইয়র্ক গিয়েছে৷ সোলার প্যানেল ও আন্ডারওয়াটার টারবাইন দিয়ে সেই নৌকার ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি চলেছে৷ মোনাকোর রাজকন্যার ছেলে পিয়্যা কাসিরাগি ও নৌকায় করে বিশ্ব ঘোরা জার্মানির বরিস হেয়ারমান টুনব্যার্গের নৌকাটি চালিয়েছেন৷ নৌকায় টুনব্যার্গের সঙ্গে তার বাবাও ছিলেন৷ সময় লেগেছে দুই সপ্তাহ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/C. Ruttle
‘বিজ্ঞানীদের কথা শুনুন’
গ্রেটা সম্প্রতি মার্কিন সাংসদদের বিজ্ঞানীদের কথা শোনার আহ্বান জানিয়েছে৷ হাউস কমিটির এক শুনানিতে সে বলেছে, ‘‘আমি চাই না, আপনারা আমার কথা শুনুন৷ আমি চাই, আপনারা বিজ্ঞানীদের কথা শুনুন৷ আমি চাই, এরপর আপনারা বিজ্ঞানের পেছনে একত্র হোন... এবং তারপর আমি চাই, আপনারা উদ্যোগ নিন৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/N. Kamm
শুধু প্রশংসা নয়, আছে সমালোচনাও
গ্রেটার কার্যক্রমে অনুপ্রাণিত হয়ে সারা বিশ্বের স্কুল শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে নেমেছে৷ সম্প্রতি গ্রেটার কাজকে স্বীকৃতি দিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও৷ তবে তার সমালোচকও আছে৷ গত জুলাই মাসে ফ্রান্সের সংসদে (ছবি) বক্তব্য দিয়েছিল গ্রেটা৷ ডানপন্থি সাংসদরা সেই সময় সংসদে উপস্থিত থাকেননি৷ তারা গ্রেটাকে ‘ইকোলজির জাস্টিন বিবার’ বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন৷
ছবি: Reuters/P. Wojazer
দুর্বলতাকে শক্তিতে রূপান্তর
১২ বছর বয়সে গ্রেটার অ্যাসপার্গার্স সিন্ড্রোম (এক ধরনের লঘু অটিজম) আছে বলে জানা যায়৷ তবে এই অবস্থাকে নিজের শক্তি হিসেবে দেখে গ্রেটা৷ একসময় সে বলেছিল, ‘‘আমার মস্তিষ্ক একটু অন্যভাবে কাজ করে৷ তাই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আমি বিশ্ব দেখি৷ আর আমি সব খোলাখুলি বলি৷ একটা বিষয় যেমন, আমি সেভাবেই বলি৷ যখন আমি কিছু করার সিদ্ধান্ত নেই, তখন মনে কোনো সন্দেহ না নিয়েই আমি তা করি৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Zinken
স্কুল থেকে ছুটি
গত জুন মাসে প্রায় সব বিষয়ে ‘এ’ গ্রেড নিয়ে নবম শ্রেণি পাস করেছে গ্রেটা৷ এরপর অ্যাক্টিভিজম চালিয়ে যেতে স্কুল থেকে এক বছরের ছুটি নিয়েছে সে৷