বাবার মৃত্যু খবর পেয়ে শুক্রবার দেশে ফিরে বিমানবন্দরেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সিকদার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রন হক সিকদার৷ এর কয়েক ঘণ্টা পরই তাকে জামিন দিয়েছে আদালত৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের অন্যতম শিল্প গোষ্ঠী সিকদার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার গত বুধবার দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান৷ গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘রন হক সিকদার তার বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে ঢাকা আসার সাথে সাথে বিমানবন্দরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তার বিরুদ্ধে একটিই মামলা আছে; সেই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷’’
রনকে শুক্রবার দুপুরে ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়৷ বিচারক আশেক ইমাম আগামী ১০ মার্চ পর্যন্ত তার জামিন মঞ্জুর করেন৷
এ সময় তাকে রিমান্ডে নেওয়ার কোনো আবেদন পুলিশের পক্ষ থেকে করা হয়নি বলে আদালতের সহকারী পিপি আজাদ রহমান বিডিনিউজকে জানান৷
ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক রন ও তার ভাই দিপু হক সিকদারের বিরুদ্ধে এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া এবং অতিরিক্ত এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে অপহরণ করে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে গত বছর ১৯ মে গুলশান থানায় একটি মামলা হয়৷ গত ২৫ মে সিকদার গ্রুপের মালিকানাধীন একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দুই ভাইয়ের ব্যাংককে পাড়ি জমানোর খবর প্রকাশ হয়৷ সে খবরে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) রন হক সিকদারের একটি গাড়ি জব্দ করে৷
ব্যাংক খাতের নানা কেলেঙ্কারি
রাজনীতি, অর্থ, পেশি শক্তি, অপকৌশল, দুর্নীতি – এ সব নানা কারণে বারবারই বিপদের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত৷ ব্যাংক খাতে নানা সময়ে সংঘটিত কেলেঙ্কারির খবর দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: picture alliance / Klaus Ohlenschläger
রিজার্ভের অর্থ উধাও
২০১৬ সালে ঘটে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা৷ অজ্ঞাতনামা হ্যাকাররা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ নিউ ইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কায় পাচার করে দেয়৷ ফিলিপিন্সে পাচার করা ৮.১ কোটি ডলারের এখনো কোনো সুরাহা হয়নি৷ এ ঘটনার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷
ছবি: Reuters/A. Rahman
জালিয়াতের খপ্পরে এটিএম কার্ড
‘স্কিমিং ডিভাইস’ নামের বিশেষ এক যন্ত্র বসিয়ে গ্রাহকদের কার্ডের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করার নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালে৷ চুরি করে তারা এর সঙ্গে এক জার্মান নাগরিক জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ প্রতারকদের আটক করা হলেও তারা বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ থেকে দুই দিনেই অন্তত ২০ লাখ টাকা তুলে নেয়৷
ছবি: bdnews24.com
হলমার্ক কেলেঙ্কারি
২০১২ সালে এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা ফাঁস হয়৷ সে সময় কেবল সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখা থেকে ২০১০-২০১২ সময়ে মোট তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়৷ এর মধ্যে অখ্যাত হলমার্ক গ্রুপ একাই আত্মসাৎ করে ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা৷ তখন তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়নি৷
ছবি: DW
বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতি
রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া আব্দুল হাই বাচ্চু পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ পাওয়ার পর ব্যাংকটি অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়৷ ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ব্যাংকটিতে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণে বড় ধরনের অনিয়ম পায় বাংলাদেশ ব্যাংক৷ ব্যাংকের টাকা মেরে দিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অনেক ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়৷ এসব ঋণের বেশিরভাগই আর ব্যাংকে ফেরত আসেনি৷
ছবি: bdnews24.com
ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে লুটপাট
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালে ঘটে এই ঘটনা৷ ব্যাংকটির তৎকালীন উদ্যোক্তারা অনিয়মের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন প্রায় ৬০০ কোটি টাকা৷ লুটপাটের কারণে ২০০৬ সালে ব্যাংকটি অতিরুগ্ন হয়ে পড়ে৷ মালিকপক্ষের হাতে থাকা ব্যাংকের ৮৬ শতাংশ শেয়ারও বাজেয়াপ্ত করা হয়৷ তা কিনে নেয় আইসিবি গ্রুপ৷ তারপর ব্যাংকটির নাম পরিবর্তিত হয়ে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক হয়, তবে এখনো পুরো টাকা ফেরত পাননি গ্রাহকেরা৷
ছবি: imago/Milestone Media
ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়ম
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুমোদন দেয়া একটি ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংক৷ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দীকী নাজমুলের মালিকানাধীন বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকের ছয়টি শাখায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম পাওয়া যায়৷ এতে জনগণের সংরক্ষিত আমানত ফেরত দিতে অক্ষম হয়ে পড়ে ব্যাংকটি৷
ছবি: bdnews24.com
লুটপাটের অন্ত নেই
নতুন এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে ৭৪১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম দেখা যায়৷ ২০১০-২০১৫ সালে আইন লঙ্ঘন করে অ্যাননটেক্স নামে একটি গ্রুপকে ৫ হাজার ৪০৪ কোটি টাকার ফান্ডেড, নন-ফান্ডেড ঋণ প্রদান করে জনতা ব্যাংক৷ বিসমিল্লাহ গ্রুপ ২০১১ ও ২০১২ সালে দেশের পাঁচটি ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়৷
ছবি: DW
আরো আছে অনেক
এখানেই শেষ নয়৷ সময়ে সময়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে নানান অভিনব কৌশলে ভূয়া চুক্তিপত্র দেখিয়ে, কিংবা এক কাজে ঋণ নিয়ে অন্য কাজে ব্যবহার করার অসংখ্য নজির আছে দেশে৷ তাই নানা সময়ে বিপাকে পড়েছে ব্যাংক খাত৷ শুধু তাই নয়, শেয়ার বাজারকে নানা সময়ে অতিমূল্যায়িত করে ব্যাংক খাতের ওপর ভয়াবহ চাপ তৈরি করা হয়েছে৷
ছবি: picture alliance / Photoshot
8 ছবি1 | 8
গুলশান থানায় দায়ের করা মামলায় অভিযোগ, রন হক সিকদার গত বছরের ৭ মে ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডিসহ গুলশানে এক্সিম ব্যাংকে গিয়ে তাদের প্রস্তাবিত ঋণের টাকার বিপরীতে ‘কো-লেটারেল' হিসেবে সিকদার গ্রুপের রূপগঞ্জ কাঞ্চন প্রস্তাবিত আদি নওয়াব আসকারী জুট মিলটি পরিদর্শনের জন্য নিয়ে যান এমডি হায়দার আলী ও অতিরিক্ত এমডি ফিরোজকে৷ পরিদর্শনের পরে জায়গাটির বর্তমান বাজার দরের সঙ্গে গ্রাহকের বন্ধকী মূল্যের বিশাল ব্যবধান হওয়ায় এক্সিম ব্যাংকের এমডি ও অতিরিক্ত এমডি দ্বিমত পোষণ করেন৷
এর জের ধরে ‘কৌশলে’ এক্সিম ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পূর্বাচলে নিয়ে ‘হত্যার উদ্দেশে গুলিবর্ষণ’ এবং অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সেখান থেকে বনানী ১১ নম্বরে সিকদার হাউজে নিয়ে ‘হেনস্থা করা হয়’ বলে অভিযোগ করা হয়েছে এজাহারে৷ এজাহারে বলা হয়, জমির দাম কম বলায় রন ও দীপু এক্সিম ব্যাংকের এএমডি ফিরোজকে ‘মারতে উদ্যত হলে’ তিনি মাফ চেয়ে প্রাণে বাঁচেন৷
‘‘রন হক সিকদার ও দিপু সিকদার (এক্সিম ব্যাংকের) এমডিকে প্রজেক্টের সবকিছু নিয়ম অনুযায়ী আছে দাবি করে তাদের সাথে থাকা অস্ত্র তাক করে জোরপূর্বক একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়৷’’ এক্সিম ব্যাংকের এমডি, এএমডি ও দুই চালককে প্রায় ৫ ঘণ্টা অস্ত্রের মুখে জিম্মি রেখে পরে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়৷
ব্যাংক, বীমা, বিদ্যুৎ, ইকনোমিক জোন, অ্যাভিয়েশন, আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মত বিভিন্ন খাতে ছড়িয়ে আছে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের গড়া সিকদার গ্রুপের ব্যবসা৷ রয়েছে বিভিন্ন সহযোগী কোম্পানিও৷