ঘরবন্দি জীবন, বিপর্যস্ত শিশুরা
৯ মে ২০২১এমন অন্তত ১০ জন অভিভাবক ও তরুণের সঙ্গে কথা হয়েছে ডয়চে ভেলের৷ বেশিরভাগই বলেছেন, পড়ার বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই চলে৷ লেখাপড়ায় মনোযোগ নেই আগের মতো৷ পুরো সময় কাটছে টিভি দেখে আর স্মার্ট ডিভাইসে৷ দিন-রাতের রুটিন বদলে গেছে৷ অনেকের আচরণে এসেছে পরিবর্তন৷ এমন পরিস্থিতিতে সন্তানকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকেরা৷
শুধু স্কুল-কলেজ নয়, বন্ধ বিনোদন কেন্দ্রগুলোও৷ ফলে ঘরের বাইরে শিশুদের বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই৷ গত ডিসেম্বর কয়েকদিনের জন্য বিনোদন কেন্দ্রগুলো খুললেও ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি করোনা সংক্রমন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ রাজধানীতে শিশুদের সবচেয়ে বড় বিনোদনকেন্দ্র আগারগাঁওয়ে বিমান বাহিনীর জাদুঘর৷ গত এক বছরে ১৫ দিনের মতো সেটি খোলা ছিল৷ সেসময় উপচেপড়া ভীড় হয়েছে সেখানে৷ একই অবস্থা ছিল শিশু পার্ক, শিশু মেলা, চিড়িয়াখানাতেও৷ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি লকডাউন কার্যকর হওয়ার পর সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে৷
বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম৷ থাকেন মোহাম্মদপুরে৷ তার স্ত্রী ফাহমিদা ইসলাম একটি স্কুলের শিক্ষক৷ ফাহমিদা তার সন্তান ঢাকা কলেজে পড়ে৷ বন্ধের সময়টাতে সে বাসাতেই আছে৷ ‘‘যেহেতু কলেজের বই পড়ার অগ্রহ কম, তাই আমার বাসার লাইব্রেরিতে থাকা বই থেকে একটা করে গল্পের বই ওকে দিই৷ ওর সঙ্গে চুক্তি হয়েছে প্রতিটি বই পড়া শেষ হলে ২০০ টাকা দেব৷ আবার কোন বই রিভিশন দিলে পাবে ১০০ টাকা৷ এভাবে ও ৫ হাজার টাকা আয় করেছে৷ এর মধ্যে ৩ হাজার টাকা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনে দিয়েছে৷ এছাড়া আমরা রাতে একসঙ্গে বসে সিনেমা দেখি৷ আসলে আমি ওকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করি৷ তারপরও দিনের অনেকটা সময় মোবাইলফোনে কাটায়৷’’
বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা রুবিনা আক্তারও বলছিলেন, তার মেয়ের রুটিন বদলে গেছে৷ ‘‘রাতে না ঘুমানোর কারণে ওর চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে৷ সারাদিন ল্যাপটপ আর মোবাইল ফোনেই কাটছে তার দিন৷ এর ফলে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে৷ মেয়ে তো বলছে, আমরা এখন জেলে বাস করছি৷ এর মধ্যেই চলছে হচ্ছে, কি আর করা৷’’
এই অবস্থা চলতে থাকলে শিক্ষার্থীদের সামনের দিনগুলো কেমন হতে পারে? জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘প্রত্যেকটি মানুষের শরীরে যেমন পুষ্টি দরকার, তেমনি মস্তিষ্কেরও পুষ্টি দরকার হয়৷ মস্তিষ্কের পুষ্টি হলো ভালো চিন্তা৷ সারা দিন ফেসবুক-ইউটিউবে থাকলে মস্তিষ্কের সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যায়৷ চিন্তায় পরিবর্তন আসে৷ ভালো চিন্তা বাদ দিয়ে খারাপ চিন্তাগুলো মস্তিষ্কে ভর করে৷ আচরণ পালটে যায়, মানুষের সঙ্গে ব্যবহারও খারাপ হতে থাকে৷ ফলে এখনই শিক্ষক ও অভিভাবকদের বিশেষ নজর দিতে হবে তরুণ শিক্ষার্থীদের দিকে৷’’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘক্ষণ ইলেক্ট্রোনিক ডিভাইস ব্যবহার করলে নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দেয়৷ বিশেষ করে শিশুদের ওপর এর প্রভাব অত্যন্ত বেশি৷ শিশুরা মোবাইল হ্যান্ডসেট অনেকক্ষণ ব্যবহার করলে তাদের স্মৃতি ও দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়৷ শরীরে টিউমার হতে পারে৷ রেডিয়েশনের প্রভাবে একটা শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়ে থাকে৷
জাতীয় নাক কান ও গলা ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. মাহবুব আলম বলেছেন, ‘‘দীর্ঘক্ষণ হেডফোন দিয়ে কথা বললে কানে নানা ধরনের সমস্যা হয়৷ তাই দীর্ঘসময় হেডফোন ব্যবহার না করাই উচিত৷ একটানা না শুনে বিরতি দিয়ে দিয়ে শুনতে হবে৷ দীর্ঘসময় মোবাইলের ছোট্ট পর্দায় তাকিয়ে থাকলে চোখেরও সমস্যা হয়৷ অবশ্যই এ ক্ষতিগুলো খুব সহজে বোঝা যায় না, লম্বা সময় পর ধীরে ধীরে বোঝা যায়৷ বিশেষ করে শিশুদের স্মার্ট ডিভাইস দেওয়ার সময় অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে৷ পাশাপাশি বড়রাও মোবাইল ব্যবহারের সময় শিশুদের দূরে রাখতে হবে৷ কারণ মোবাইলের রেডিয়েশনটা শিশুদের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর৷’’
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিউটের অধ্যাপক ডা. এনাম আবেদিন বলেন, ‘‘করোনার কারণে এখন তো অভিভাবকরা শিশুদের নিয়ে খুব একটা বের হচ্ছেন না৷ খুব দরকার না হলে হাসপাতালে আসেন না৷ ফলে চোখের যে ক্ষতিগুলো সেটা এখন আমরা ওভাবে বুঝতে পারছি না৷ এটা তো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা, আরো বছরখানে গেলে শিশুদের যখন চোখে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেবে তখন আমরা বুঝতে পারব করোনাকালীন সময়ে মোবাইল-ল্যাপটপের সামনে দীর্ঘক্ষন বসে থেকে বাচ্চাদের কি পরিমান ক্ষতি হয়েছে৷’’
তবে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শফি আহমেদ মনে করেন শারীরিক ক্ষতির চেয়েও শিশুদের মানসিক ক্ষতিটা বেশি হচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘এই এক বছরে শিশুদের মারাত্মক কিছু ক্ষতি হয়েছে৷ এর মধ্যে মানসিক ক্ষতিটা অনেক বেশি৷ পাশাপাশি অনেক শিশু মোটা হয়ে যাচ্ছে৷ শিশুদের সঙ্গে দূর্ব্যহারও বেড়েছে৷ তবে এসব নিয়ে এখনো বাংলাদেশে কোন গবেষণা হয়নি৷’’
এইসব বিষয়ে অভিভাবকদের সতর্ক থাকার কথা বলছেন বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেনও৷ তিনি বলেন, ‘‘এখনকার তরুণরা বেশ সেনসেটিভ৷ তাদের খুব একটা বিরক্ত না করাই ভালো৷ আবার তাদের লেখাপড়ার মধ্যেও রাখতে হবে৷ টিভি দেখা বা ঘরের মধ্যে অন্য ধরনের খেলাধুলার (লুডু, দাবা, ক্যারাম) ব্যবস্থা করতে হবে৷ বাবা-মা সন্তান মিলে খেলতে হবে৷ এখন আপনি যদি নিজেই সারা দিন মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকেন, তাহলে তো আপনার সন্তানও তাই করবে! সন্তানকে সময় দেওয়ার এটা কিন্তু একটা ভালো সুযোগ৷ পাশাপাশি যে ধর্মের মানুষ আপনি, সেখানে সন্তানকে নিয়ে ধর্ম পালন করতে পারেন৷ মোট কথা স্কুল বন্ধ থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে উঠাসহ তাদের একটা রুটিনের মধ্যে নিয়ে আনতে হবে৷’’
২০২০ সালের মার্চে করোনা মহামারী শুরুর পর ইউনিসেফ শিশুদের নিয়ে একটা গবেষণা প্রকাশ করে৷ সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১৮৮টি দেশে লকডাউন বা অন্যান্য কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের কারণে ১০৬ কোটির বেশি শিশু ও তরুণরা শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে৷ বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীদের তিনজনে একজন অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৪৬ কোটি শিশু এখন আর অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না৷ করোনার কারণে শিশু অপুষ্টির হারও বাড়ছে৷ পাশাপাশি এই মহামারিতে শিশুদের উপর নির্যাতন সহিংসতায় দুর্ব্যবহার ও বেড়েছে৷