এ বছর ঈদ বাড়িতে বসেই কাটানোর নির্দেশ দিলেন দিল্লির জামে মসজিদের শাহী ইমাম। তাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন ভারতের ইসলামিক স্কলাররা।
বিজ্ঞাপন
করোনার কারণে তৃতীয় পর্যায়ের লকডাউন চলছে ভারতে। প্রধানমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন, বহু ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হলেও চতুর্থ পর্যায়ের লকডাউনও হবে। সে ক্ষেত্রে মে মাসের শেষ পর্যন্ত লকডাউন চলার সম্ভাবনা। তার মধ্যেই ঈদ। কী ভাবে হবে ঈদের উদযাপন? এ বিষয়ে ডয়চে ভেলেকে নিজের মতামত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন দিল্লির জামে মসজিদের শাহী ইমাম আহমেদ বুখারি।
শুক্রবার বুখারি সাহেব ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''আপনাদের মাধ্যমে সকলকে বলছি, এ বছর ঈদের উদযাপন বাড়িতে বসে করুন। বাইরে বেরোবেন না। লকডাউন চলছে। তা ভাঙবেন না। এমনকী, আত্মীয় বন্ধুদের মুবারক জানান টেলিফোনে।'' বুখারি সাহেবের বক্তব্য, এমন সংকট বিশ্ব কখনও দেখেনি। এই প্রথম জুম্মার নামাজে মসজিদে জমায়েত হচ্ছে না। সকলে বাড়িতে থাকছেন। জুম্মার নামাজে যদি সকলে বাড়িতে থাকতে পারেন, তা হলে ঈদের নামাজেও বাড়িতে থাকা সম্ভব। সকলে নিজের নিজের মতো করে প্রার্থনা করুন। বুখারি সাহেব জানিয়েছেন, করোনার সঙ্গে সরকার লড়ছে। বিভিন্ন স্তরের মানুষ সহযোগিতা করছেন। জামে মসজিদ কর্তৃপক্ষও মানুষকে সচেতন করছেন। এবং সে কারণেই তাঁর আবেদন, এ বারের ঈদে সকলে যেন বাড়িতেই থাকেন।
জামে মসজিদের অন্দরে
দিল্লির জামে মসজিদ ভারতের তো বটেই, পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত ধর্মস্থান। দেশ বিদেশের মানুষ দেখতে আসেন শাহজাহানের তৈরি এই বিশাল স্থাপত্য।
ছবি: DW/Prashanth Vishwanathan
গোড়ার কথা
১৬৫০ থেকে ১৬৫৬ সালের মধ্যে মোগল সম্রাট শাহজাহান তৈরি করেছিলেন এই বিশাল মসজিদ। খরচ হয়েছিল ১০ লক্ষ টাকা। মসজিদের উদ্বোধন করতে উজবেকিস্তান থেকে এসেছিলেন ইমাম সৈয়দ আব্দুল গফুর শাহ বুখারি।
ছবি: DW/Syamantak Ghosh
লাল পাথরের মসজিদ
লাল বেলে পাথর আর সাদা মার্বেল দিয়ে তৈরি হয়েছে এই মসজিদ। পরবর্তীকালে এই পাথরেই লাল কেল্লা তৈরি করেছিলেন শাহজাহান। মসজিদটির তিনটি প্রকাণ্ড দরজা আছে। উত্তর, দক্ষিণ এবং পূর্ব দিকে। আর রয়েছে দু'টি বিশাল মিনার।
ছবি: DW/Syamantak Ghosh
নামাজ পড়ার চাতাল
মসজিদের সামনের প্রকাণ্ড চাতালে এক সঙ্গে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। মসজিদের উপরে রয়েছে তিনটি প্রকাণ্ড ডোম। ভারতের যে কোনও জামে মসজিদে একই রকমের ডোম দেখতে পাওয়া যায়।
ছবি: DW/Syamantak Ghosh
মসজিদ-ই-জাহান-নুমা
শাহজাহান এই মসজিদের নাম রেখেছিলেন মসজিদ-ই-জাহান-নুমা। অর্থাৎ, সারা পৃথিবীর প্রতিফলন রয়েছে যে মসজিদে। তাঁর ইচ্ছে ছিল, এই মসজিদই হবে পৃথিবীর ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের সব চেয়ে বড় মিলনস্থল।
ছবি: DW/Syamantak Ghosh
উল্টো দিকেই লাল কেল্লা
শাহজাহান পুরনো দিল্লির নাম দিয়েছিলেন শাহজাহানাবাদ। যার এক প্রান্তে লালকেল্লা। অন্য প্রান্তে জামে মসজিদ। এখনও আকাশ পরিষ্কার থাকলে জামে মসজিদের মিনার থেকে লালা কেল্লার মূল ফটক দেখতে পাওয়া যায়।
ছবি: DW/Syamantak Ghosh
ব্রিটিশ আক্রমণ
ব্রিটিশরা দিল্লি দখলের পরে কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল জামে মসজিদ। সেখানে রাখা হয়েছিল সৈন্যদের। এক সময় ব্রিটিশরা মসজিদ ভাঙার কথাও ভেবেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি।
আজানের সুর কানে আসতেই মসজিদের সামনের চাতালে ভিড় জমতে শুরু করল। একে একে সকলে এসে অজু করে নিলেন। একটু পরেই শুরু হবে নামাজ।
ছবি: DW/Syamantak Ghosh
সব চেয়ে বড় নামাজ
শুধু দিল্লি নয়, জামা মসজিদে ভারতের সব চেয়ে বড় নামাজ হয়। বিশ্বাসীদের কাছে জামা মসজিদে নামাজ পড়া এক অন্যরকম অনুভূতি।
ছবি: DW/Syamantak Ghosh
নামাজ পড়েন মেয়েরাও
অনেকেই বলেন, মেয়েদের নামাজের সময় মসজিদে থাকতে দেওয়া হয় না। ভুল তথ্য। মসিজদ চত্বরে মেয়েরাও এ ভাবেই প্রার্থনা করেন।
ছবি: DW/Syamantak Ghosh
সেলফি টাইম
জামে মসজিদ কেবলই এক ধর্মীয় স্থান নয়। অনেকেই এখানে আসেন বিশাল স্থাপত্যের শিল্পকর্ম কর্ম দেখতে। মসজিদকে সাক্ষী রেখে তুলে নেন সেলফি।
ছবি: DW/Syamantak Ghosh
গল্পের আসর
মসজিদের চাতাল ঘিরে রয়েছে বসার জায়গা। দিনভর সেখানে পিকনিকও চলতে থাকে। খাওয়াদাওয়া, গান বাজনা সবই হয়।
ছবি: DW/Syamantak Ghosh
মিনার থেকে শহর
জামে মসজিদের সুউচ্চ মিনারে ওঠার টিকিট পাওয়া যায়। সেখান থেকেই দেখতে পাওয়া যায় পুরনো দিল্লির ল্যান্ডস্কেপ। এটাই হল শাহজাহানের শাহজাহানাবাদ।
ছবি: DW/Syamantak Ghosh
মিনা বাজার
মসজিদের সামনে বাজার৷ লালকেল্লার অন্দরের মিনা বাজারের নামে এই বাজারের নামও মিনা বাজার। হরেক পসরা নিয়ে ব্যবসায়ীরা বসেন সেখানে। তবে কিনতে হলে দরাদরি করতে হবে গুছিয়ে।
ছবি: DW/Syamantak Ghosh
খেজুরের স্বর্গ
মসজিদের সামনে এ ভাবেই বিক্রি হয় দেশ বিদেশের খেজুর। এমনই অসংখ্য দোকান আছে মসজিদ চত্বরের ঠিক বাইরে।
ছবি: DW/Syamantak Ghosh
আন্দোলনের সিঁড়ি
শুধু ধর্মীয় স্থান নয়, জামে মসজিদ এখন দিল্লির আন্দোলনের অন্যতম জায়গাও। প্রতিদিন এ ভাবেই মানুষ সিএএ, এনআরসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে আসছেন এখানে। বসে পড়ছেন মসজিদের সিঁড়িতে।
ছবি: Reuters/A. Fadnavis
16 ছবি1 | 16
এমন ঈদ কখনও দেখেননি কেউ। ঈদের দিন সকলে বাইরে যাবেন না, এক সঙ্গে নামাজ পড়বেন না, এটা ভাবতেই পারছেন না বহু মানুষ। এ বিষয়ে কী বলছেন ইসলামিক স্কলাররা? জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক এবং জয়পুরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য আখতারুল ওয়াসে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''আল্লাহ সর্ব শক্তিমান। সবই তাঁর সৃষ্টি। ফলে এমন পরিস্থিতিতে সকলে যে একত্রিত হয়ে নামাজ পড়তে পারবেন না, তা সর্বশক্তিমান জানেন। সকলে ঘরে বসে নিজের নিজের মতো করে প্রার্থনা করলেও কোনও দোষ হবে না। এই পরিস্থিতিতে কারও বাইরে যাওয়া উচিত নয়। জমায়েতে অংশ নেওয়া উচিত নয়। সকলে যেন তা মেনে চলেন।'' তাঁর বক্তব্য, সবার আগে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। তবেই সকলকে রক্ষা করা যাবে। সে কারণেই এ বারের ঈদ ঘরে বসে পালন করা জরুরি।
শুক্রবারের নামাজেও ভিড় কম
করোনা নিয়ে সতর্ক হচ্ছে দিল্লি। শুক্রবারের নামাজেও ভিড় কম। বন্ধ হচ্ছে রেস্তোরাঁ।
ছবি: DW/S. Ghosh
জামে মসজিদের নামাজ
যে কোনও শুক্রবার দিল্লির জামে মসজিদের চাতাল ভরে যায় মানুষে। সকলে একসঙ্গে নামাজ পড়েন। এই শুক্রবার লোক ছিল চোখে পড়ার মত কম।
ছবি: DW/S. Ghosh
করোনা আতঙ্ক
জামে মসজিদের আশপাশে বহু মানুষের বক্তব্য, বাড়িতে বসেই প্রার্থনা করছেন। নামাজ পড়ছেন। কিন্তু আপাতত মসজিদে যাবেন না। করোনা সংক্রমণের হাত থেকে তাঁরা নিজেরাও বাঁচতে চান, অন্যদেরও বাঁচাতে চান।
ছবি: DW/S. Ghosh
লোক কম
জামে মসজিদের বাইরেও লোক আগের চেয়ে অনেক কম। অন্য যে কোনও সময় এই জায়গা ভরে থাকে মানুষের ভিড়ে।
ছবি: DW/S. Ghosh
পরের শুক্রবার আসবেন না
জামে মসজিদে না বললেও, দিল্লির বহু মসজিদে ইমামরা বলে দিয়েছেন, পরিস্থিতি এমন চললে পরের শুক্রবার যেন কেউ মসজিদ-মুখী না হন। বাড়িতে বসে প্রার্থনা করলেই হবে।
ছবি: DW/S. Ghosh
একই জলে অজু নয়
কোনও কোনও মসজিদে বলা হয়েছে, বাড়ি থেকে অজু করে আসতে। একই জলে সকলের অজু না করাই ভাল।
ছবি: DW/S. Ghosh
মিনা বাজার
জামে মসজিদ সংলগ্ন প্রাচীন মিনা বাজার। সারা দিন এই বাজারে পা রাখার জায়গা থাকে না। এখন সেখানে ভিড় থাকলেও অন্য সময়ের চেয়ে অনেক কম। দোকানদাররা বলছেন, বিক্রি ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছে।
ছবি: DW/S. Ghosh
6 ছবি1 | 6
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, ঈদের নামাজ বাড়িতে বসে কী ভাবে পড়া হবে? ভারতের আরেক বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার মনজুর আলম ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ঈদের নামাজের সাধারণ নিয়ম হলো সকলে খোলা জায়গায় একত্রে নামাজ পড়বেন। এ বার যেহেতু তা সম্ভব নয়, ফলে বড় ঘরে অথবা বাড়ির ছাদে পরিবারের সকলকে নিয়ে নামাজ পড়া যেতে পারে। তবে ফ্ল্যাট বাড়ি হলে ছাদে না যাওয়াই ভালো। সে ক্ষেত্রে গোটা বাড়ি ছাদে চলে গেলে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকবে না। নিজের বাড়ি হলে তবেই ছাদে গিয়ে নামাজ পড়া উচিত। একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ঈদের বিশেষ প্রার্থনা হওয়া উচিত মানব সভ্যতার জন্য। মানব সভ্যতার যাতে উন্নতি হয়, এই কালো মেঘ যাতে দ্রুত কেটে যায়, সে কথাই উচ্চারণ করতে হবে। গরিবকে সাহায্য করা, আক্রান্তের পাশে দাঁড়ানোর শপথ নিতে হবে। আখতারুল ওয়াসের সঙ্গে মনজুর সাহেবও এক মত। তাঁর বক্তব্য, এ বারের ঈদ অবশ্যই বাড়িতে বসে কাটাতে হবে। তাতে কোনও অন্যায় হবে না। তাঁর আরও পরামর্শ, ''জৌলুস কম করুন। অকারণে খরচ করবেন না। নিজের জন্য জিনিস কম কিনে গরিব মানুষকে সেই টাকায় সাহায্য করুন।''
ভারতে এ বছর ঈদের বাজারেও টান। দোকানদারদের বক্তব্য, ব্যবসায় ক্ষতি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ। কোনও কোনও অঞ্চলে দু'একটি কাপড়ের দোকান খুললেও তাতে লোক নেই। বেচা-কেনা নেই বললেই চলে। রমজানের সময় পুরনো দিল্লির যে চেহারা থাকে, এ বছর তা একেবারে আলাদা। রাস্তায় লোক অনেক কম। বাজার কার্যত বন্ধ। তবে শাহী ইমামের বক্তব্য, ঈদ আবার আসবে। আবার সব আগের মতো হয়ে যাবে। আপাতত সকলের একটাই লক্ষ্য, করোনার সঙ্গে লড়াই।