১৯৭০ সালের ভয়াল ঘূর্ণিঝড় দেখার অভিজ্ঞতাসম্পন্নরা বলছেন, সেসময় পোকামাকড়ের উপদ্রব হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল৷ আর দুর্যোগের আগের কয়েকদিন ধরেই কুকুর সমানে কাঁদছিল৷ পিঁপড়ারা ডিম পিঠে করে গাছে ওঠা শুরু করেছিল৷
বিজ্ঞাপন
আধুনিক পূর্বাভাস প্রযুক্তি আবিষ্কারের আগে উপকূলের মানুষজন কীভাবে ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের বার্তা পেত?
গুমোট আবহাওয়া, আকাশের মেঘ এবং সাগর ও নদীর মোহনায় পানি বৃদ্ধি দেখে নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের উপকূলের মানুষ বুঝে নিত বড় ধরনের ঝড় আসছে৷ হয়ত জেলেরা সতর্ক হতেন, তীরে ফেরার চেষ্টা করতেন৷ জেলেরা যখন ফিরতেন তখন নৌকার গলুইয়ে পতাকার মতো কাপড় ঝুলিয়ে রাখতেন, যাতে অন্য জেলে নৌকাগুলো বিপদ সম্পর্কে জানতে পারে৷
২০০৩ সালে প্রকাশিত গবেষক ফিলিপা হাওয়েলের গবেষণাপত্র ‘ইনডিজেনাস আর্লি ওয়ার্নিং ইনডিকেটরস অফ সাইক্লোনস: পটেনশিয়াল অ্যাপ্লিকেশন ইন কোস্টাল বাংলাদেশ'-এ প্রযুক্তির বাইরে কীভাবে লোকায়ত জ্ঞান দিয়ে উপকূলের মানুষ ঝড়ের আগাম বার্তা বুঝতে পারত, সে সম্পর্কিত তথ্য জানতে, বেশ কয়েকজন উপকূলবাসীর অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়৷ এদের অনেকেই ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতা থেকে বড় ধরনের ঝড় আসার প্রাকৃতিক আগাম সতর্কতাগুলো নিজেদের স্মৃতি থেকে বর্ণনা করেছেন৷
ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী আটটি ঝড়
ছবিঘরে ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী আটটি ঝড়ের কথা উল্লেখ করা হলো, যেগুলো অ্যাটলান্টিকের হারিকেন, প্রশান্ত মহাসাগরের টাইফুন এবং ভারত মহাসাগরের সাইক্লোন নামে পরিচিত৷ সবচেয়ে বিধ্বংসী ঝড় আঘাত হেনেছে বাংলাদেশে৷
ছবি: Getty Images
২০০৮: নার্গিস (মিয়ানমার)
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে একটি হলো নার্গিস৷ ২০০৮ সালের মে মাসে যেটি মিয়ানমারে আঘাত হানে৷ এতে প্রাণ হারায় ১ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ৷ ৪ লাখ ৫০ হাজার ঘর-বাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়৷
ছবি: Hla Hla Htay/AFP/Getty Images
১৯৯১ সাল: বাংলাদেশ
বাংলাদেশের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, যেটি ২৯শে এপ্রিল ঘণ্টায় ২৩৫ কিলোমিটার বেগে উপকূলে আঘাত হেনেছিল৷ সমুদ্রের পানির উচ্চতা পৌঁছে গিয়েছিল সাত মিটার উঁচুতে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছিল উপকূলের অন্তত ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ৷
ছবি: AFP/Getty Images
১৮৭৬: দ্য গ্রেট বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন, বাংলাদেশ
১৮৭৬ সালের অক্টোবরে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বরিশালের বাকেরগঞ্জে৷ সে সময় ব্রিটিশ শাসনামল চলছিল৷ ভয়াবহ ঐ ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল অন্তত ২ লাখ মানুষ৷
ছবি: Getty Images/AFP
১৯৭৫: নিনা টাইফুন, চীন
যদিও চীনে টাইফুন বা ঘূর্ণিঝড় খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, তবুও ১৯৭৫ সালের ৩১ শে জুলাই চীনের হেনান প্রদেশে টাইফুন নিনার ভয়াবহতা সব ঝড়কে পেছনে ফেলে দেয়৷ ভয়াবহ ঐ ঝড়ে প্রাণ হারায় ২ লাখ ৩১ হাজার মানুষ৷ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Zc
১৮৮১ সাল: হাইফোং, ভিয়েতনাম
১৮৮১ সালের অক্টোবর মাসে ভিয়েতনামের হাইফোং শহরে ভয়াবহ টাইফুন আঘাত হানে৷ এতে প্রাণ হারায় ৩ লাখ মানুষ৷
ছবি: Getty Images/J. Aznar
১৯৩৭ এবং ১৮৩৯ সাল: ভারত
১৭৩৭ সালের অক্টোবর মাসে বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে ধেয়ে এসে কলকাতায় আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড়৷ বেশিরভাগ ইউরোপীয় গণমাধ্যমে বলা হয়েছিল, ঐ ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় তিন লাখ মানুষ৷ কিন্তু সেসময় কলকাতায় মাত্র ১০ হাজার মানুষ বসবাস করত৷ তাই এই সংখ্যাটি নিয়ে অনেকের সংশয় রয়েছে৷ ১৮৩৯ সালের নভেম্বরে অন্ধ্রপ্রদেশের কোরিঙ্গা এলাকায় বিধ্বংসী ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত তিন লাখ মানুষ৷ নষ্ট হয়েছিল ২৫ হাজার জাহাজ৷
ছবি: Reuters
১৯৭০ সাল: ভোলা সাইক্লোন, বাংলাদেশ
বিশ্ব ইতিহাসের ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম বলা হয় ভোলা সাইক্লোনকে৷ ১৯৭০ সালের ১৩ই নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপর দিয়ে ঘণ্টায় ২০৫ কিলোমিটার বেগে বয়ে যায় সাইক্লোন৷ ঐ ঝড়ে প্রাণ হারায় অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ, যাদের মধ্যে এক লাখই ছিলেন জেলে৷
ছবি: Getty Images
7 ছবি1 | 7
এখানে গবেষক ফিলিপা ভোলায় ‘অ্যাকশন এইড' পরিচালিত একটি জরিপের উদাহরণ টেনেছেন৷ ভোলার আওতাভুক্ত ঢাল চর, চর কুকড়িমুকড়ি, চর মোতাহার এবং চর জহিরুদ্দিনের ৯৬ জন বয়োবৃদ্ধের উপর জরিপ চালানো হয়৷ যাদের কাছ থেকে ১৯৭০ সালের ২৯ এপ্রিল পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়ের আগে প্রাকৃতিক পরিবর্তনগুলো কী কী ছিল, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল৷
তাঁরা উত্তরে বলেছিলেন, আকাশ ধূসর ছিল, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে জোরালো হাওয়া বইছিল, আবহাওয়া অস্বাভাবিক গরম ছিল, একদিন আগে পুকুরের পানি গরম হয়ে গিয়েছিল এবং নদীতে অস্বাভাবিক বড় বড় ঢেউ তৈরি হয়েছিল৷
এছাড়া প্রাণিজগতেও পরিবর্তনের কথা বলেছেন এসব চরের মানুষেরা৷ তাঁরা জানিয়েছেন, গবাদিপশুগুলো তিন থেকে সাত দিন আগে থেকেই ছটফট করছিল৷ ঘাস খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল৷ শঙ্খচিলগুলো তারস্বরে চিৎকার করছিল৷ পোকামাকড়ের উপদ্রব হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিলো সেসময়৷ আর কুকুর সমানে কাঁদতো ভয়াল সে দুর্যোগের আগের কয়েকদিন ধরেই৷ পিঁপড়ারা ডিম পিঠে গাছে ওঠা শুরু করেছিল৷
ফিলিপা হাওয়েল ও অ্যাকশন এইডের ঐ জরিপ থেকে অতীতে উপকূলের মানুষজন ঘূর্ণিঝড় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর কীভাবে আগে জানতো, তার মোটামুটি একটা আন্দাজ পাওয়া যায়৷
কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি কমানোর ব্যাপারে তাদের উদ্যোগ কী থাকত, সেই বিষয়টি পাওয়া যায় ইউএসএআইডি পরিচালিত আরেকটি গবেষণা থেকে৷
‘লোকাল উইজডম: ইনডিজেনাস প্র্যাকটিসেস ফর মিটিগেটিং ডিজাস্টার লস' নামের ওই গবেষণায় কিছু লোকায়ত জ্ঞান দিয়ে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার চিত্র দেখানো হয়েছে৷
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব থেকে বাঁচতে সম্ভাব্য মাছ শিকারের নৌকার পাশে বাড়তি ভেলা বেঁধে রাখতেন অনেকেই৷ বাড়িঘরগুলোর চালা নতুন করে বাঁধতেন৷ ছাদের চার কোণায় ভারি কিছু ঝুলিয়ে দিতেন বা পুরো চালই ভারি কিছুর সাথে বাঁধতেন৷ ভারি বস্তুগুলো একে অপরের সাথে বেঁধে রাখাও একটা কৌশল ছিল৷ খাবার এবং পানি মাটির নীচের মশকে ভরে রাখতেন, যাতে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে এ সবের সংকটে পড়তে না হয়৷
এছাড়া অ্যাকশন এইড-এর জরিপ ও ফিলিপা হাওয়েলের গবেষণা থেকেই জানতে পারা যায়, ঘূর্ণিঝড়ের আঁচ পেলে হাতের কাছে প্রচুর ডাব বা নারকেল পেড়ে রাখা হত, যাতে একদিকে দুর্যোগের পরে পানির সংকট মিটতো, অন্যদিকে আচমকা জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে সেগুলো জীবনরক্ষাকারী বয়া হিসেবে কাজ করত৷
এখনকার আবহাওয়া ও জলবায়ু বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে গেছে৷ বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়৷ তবু অতীতের দুর্যোগ মোকাবেলার লোকায়ত পদ্ধতি নিয়েও প্রচুর কাজ হচ্ছে৷ কেননা নানা ধরনের সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে ও ব্যবস্থা নিয়েও উপকূলের মানুষকে নিজের বাড়িঘর থেকে সরানো কঠিন হয়ে পরে৷
তাদের অনেকে গবাদি পশু আর ভিটেমাটির মায়ায় শেষ পর্যন্ত বাড়ি ছাড়েন না৷ তাছাড়া বিশ্বের ভয়াবহতম ঝড়গুলোর সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে করতে অনেক উপকূলের মানুষের মধ্যেই একটি বেপরোয়া একরোখা ভাব চলে এসেছে৷ অনেকটা ‘যা হওয়ার হবে' ধরনের!
এক্ষেত্রে গবেষকরা স্বল্প খরচের লোকায়ত পদ্ধতিতে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা করে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছেন৷ তবে বড় ধরনের ঝড়ের ক্ষেত্রে সতর্কতা সংকেত পাওয়ামাত্রই উপকূলের মানুষ সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই৷
সাইক্লোনে ব্যাপক প্রাণহানি রোধে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ
সমুদ্র উপকূলের লাখ লাখ বাসিন্দা সোমবার তাদের এলাকায় ফিরে গেছেন৷ যদিও ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু অনেক ঘরবাড়ি উড়িয়ে নিয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও এবার প্রাণ হারিয়েছেন মাত্র ২৬ ব্যক্তি, যা অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশ কম৷
ছবি: Imago/Zuma Press
সপ্তাহান্তে হানা দেয় ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু
শনিবার বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে সাইক্লোন রোয়ানু৷ তবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ঘূর্ণিঝড়ের আগেই প্রায় বিশ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে৷ কেউ কেউ কর্তৃপক্ষের আহ্বান সত্ত্বেও এলাকা ছাড়তে অপারগতা প্রকাশ করেন৷
ছবি: Imago/Xinhua
আশ্রয় কেন্দ্রে...
ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে নতুন নয়৷ তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, বেড়েছে সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগ৷ শনিবার রোয়ানুর সময় উপকূলের অনেক মানুষ তাই আশ্রয় নিয়েছেন সাইক্লোন শেল্টারে৷ উপকূলীয় অঞ্চল এবং দ্বীপগুলোতে পর্যাপ্ত না হলেও এরকম শেল্টারের সংখ্যা অনেক৷
ছবি: picture-alliance/dp/K. Sumon
প্রয়োজন খাদ্য এবং অন্যান্য সহায়তা
রোয়ানুর আঘাতে প্রাণহানি কমানো গেলেও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রচুর৷ বিশেষ করে ঘরবাড়ি হারানো মানুষদের এখন প্রয়োজন জরুরী ত্রাণ সহায়তা৷ মহেশখালি দ্বীপের কাউন্সিল প্রধান মোহাম্মেদ উল্লাহ জানান, লক্ষাধিক লোক সোমবার তাদের ভিটেবাড়িতে ফিরেছেন৷ অনেকেই এখন খাদ্য সঙ্কটে রয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP
কমেছে প্রাণহানি
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে কয়েক লক্ষ মানুষ বাস করেন৷ ১৯৭০ সালে সাইক্লোনে প্রাণ হারিয়েছিল তিন লাখের মতো মানুষ৷ আর সর্বশেষ ২০০৭ সালে সাইক্লোন সিডরের আঘাতে তিন হাজারের মতো মানুষের প্রাণ যায়৷ সরকারি এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে নেয়া বিভিন্ন কর্মকাণ্ড প্রাণহানি রোধে সহায়তা করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন৷
ছবি: Imago/Zuma Press
প্রয়োজন আরো উদ্যোগ
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট সঙ্কট মোকাবিলায় আরো উদ্যোগ প্রয়োজন, কেননা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমান ভবিষ্যতে বাড়তে পারে৷ পাশাপাশি সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পেলে উপকূলীয় এলাকা তলিয়েও যেতে পারে৷
ছবি: Imago/Zuma Press
5 ছবি1 | 5
ঘূর্ণিঝড়ের আভাস পাওয়ার আর কোনো লোকায়ত পদ্ধতি সম্পর্কে জানেন কি? লিখুন নীচের ঘরে৷