ঘূর্ণিঝড় ফণীর তাণ্ডব
৩ মে ২০১৯শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ৮টার দিকে তীর্থ নগরী পুরীর ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে গোপালপুর আর চাঁদবালির মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে ওড়িশা উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করে ফণী৷
ঘণ্টায় ১৭৫ কিলোমিটার বাতাসের গতি নিয়ে আসা ফণীর ছোবলে কার্যত তছনছ হয়ে যায় সৈকতশহর পুরী, চাঁদিপুর এবং কটক, ভদ্রক, বালেশ্বর৷
‘‘পুরীতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে৷ অকার্যকর হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও টেলিফোন লাইন,'' বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন ওড়িশার বিশেষ ত্রাণ কমিশনার বিষ্ণুপদ শেঠি৷
ফণীর আঘাতের শুরুতে ওড়িশায় ২ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম৷ পুরীর সাক্ষীগোপালে গাছ পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে আর ওড়িশার কেন্দ্রপাড়ায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু এক বৃদ্ধার৷ এছাড়া গাছপালা ও ঘরবাড়ি লণ্ডভণ্ড হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়৷
ওড়িশা রাজ্যের উপকূল অতিক্রম করার পর উত্তর-উত্তরপূর্বে পশ্চিমবঙ্গের দিকে অগ্রসর হয় ফণী৷ শক্তিশালী এই ঘুর্ণিঝড়ের কারণে রেল ও বিমান চলাচল বন্ধ রেখেছ পশ্চিমবঙ্গ৷ রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকায় অনেকে আটকা পড়েন স্টেশনগুলোতে৷
ফণী আসার আগেই ওড়িশার অন্তত ১১ লাখ লোককে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়েছে সরকার৷ দুর্যোগ প্রস্তুতি হিসাবে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয় সেখানে৷
পশ্চিমবঙ্গে আতঙ্ক
ঘূর্নিঝড় ফণী দিনভর আতঙ্কে রাখল পশ্চিমবঙ্গকে৷ তবে ফণীর শক্তিক্ষয় হচ্ছে ক্রমশ, এটাই যেটুকু আশ্বস্ত হওয়ার মতো বিষয়৷
শুক্রবার মাঝরাতে পশ্চিমবঙ্গে আছড়ে পড়বে ঘূর্নিঝড় ফণী৷ কিন্তু বিকেল থেকেই প্রকৃতির রূপ আতঙ্কে রাখল রাজ্যবাসী এবং প্রশাসনকে৷ যদিও আবহাওয়া দপ্তর থেকে সন্ধেতেই আশ্বস্ত করা হয় যে, ওড়িশায় তাণ্ডব চালানোর পর এই ঘূর্নিঝড় যত জমির ওপর দিয়ে এগিয়েছে, ততই তার শক্তিক্ষয় হয়েছে৷ তার পরেও দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছিল ফণী, ওড়িশা উপকূল থেকে বাংলার দিকে আসার পথে হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে আবার বঙ্গোপসাগরের দিকে ফিরে যাওয়ায়৷ আশঙ্কা ছিল, উত্তপ্ত সাগর থেকে ফের শক্তি বাড়িয়ে পূর্ণ ক্ষমতায় পশ্চিমবঙ্গে ধাক্কা মারবে ফণী। শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা শুক্রবার সন্ধে পর্যন্ত নিশ্চিত না হলেও আবহাওয়া দপ্তরের অনুমান, শনিবার দুপুর থেকে বিকেল নাগাদ ফণী পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে বাংলাদেশের দিকে চলে যাবে৷ তখন তার শক্তি অনেকটাই কমে যাবে৷ ফলে বড় দুশ্চিন্তার কিছু থাকবে না৷ তবে মাঝের সময়টা জুড়ে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি হবে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ এবং উপকূলের জেলাগুলিতে৷
কলকাতাসহ সারা পশ্চিমবঙ্গে বুধ-বৃহস্পতিবার থেকেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ঘুর্নিঝড় ফণীর মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়ে যায়৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি প্রথমে নিজের নির্বাচনি জনসভার নির্ধারিত সূচির কিছু রদবদল করেছিলেন৷ পরে তিনি ৪৮ ঘণ্টার জন্যে বাতিল করে দেন নিজের সব রাজনৈতিক কর্মসূচি৷ রাজ্যের উপকূল এলাকার কাছাকাছি খড়গপুর শহরে গিয়ে ঘাঁটি গাড়েন৷ হাওড়ায় রাজ্য সরকারের প্রধান সচিবালয় নবান্ন ভবনে তৈরি হয় মূল কন্ট্রোল রুম৷ সকাল থেকেই সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হতে থাকে আপৎকালীন সাহায্যের জন্য যোগাযোগের ফোন নম্বর৷ কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম জানান, বিপর্যয় পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য তৈরি আছেন পুর কর্মীরা৷ বাতিল হয়ে গেছে সবার ছুটি৷ বিভিন্ন জরুরি প্রয়োজনে কাজে নেমে পড়তে তৈরি হয়েছে ছোট ছোট দল৷ সাধারণ ফোন লাইনের পাশাপাশি চালু করে দেওয়া হয় মোবাইল ফোন হেল্প লাইন এবং হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর৷ কলকাতা এবং শহরতলিতে যাঁরা পুরনো বাড়িতে থাকেন, তাঁদের চলে যেতে বলা হয় নিরাপদ জায়গায়৷ ঝড়-বৃষ্টির সময় কোনো ভাঙা বাড়ি, বা নির্মীয়মান বাড়িতে আশ্রয় না নেওয়ার জন্য সতর্ক করা হয় সবাইকে৷
বাচ্চারা যাতে কোনোভাবেই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে আটকে না পড়ে, তার জন্য আগাম ছুটি ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলিতে৷ গরমের ছুটির সঙ্গে জুড়ে নিয়ে আগামী প্রায় দু'মাস চলবে এই ছুটি৷ এত দীর্ঘ ছুটি দেওয়ার জন্য শিক্ষা মহলের একাংশ এর সমালোচনা করলেও কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি সরকার৷ বরং বেসরকারি স্কুলগুলিকেও ছুটি ঘোষণা করার অনুরোধ জানানো হয়৷ শুক্রবার সন্ধের পর থেকে আবহাওয়া প্রতিকূল হয়ে উঠবে ধরে নিয়ে তড়িঘড়ি ছুটি হয়ে যায় সরকারি দপ্তরে, বেসরকারি অফিসে এমনকি সল্ট লেক সেক্টর ফাইভের তথ্য-প্রযুক্তি শিল্প তালুকেও৷ পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় মাইকে ঘোষণা করে, নেহাত জরুরি দরকার না থাকলে সবাই যেন ঘরেই থাকেন৷ রাস্তার হকারদের বলা হয় স্টলের মাথায় লাগানো প্লাস্টিকের ছাউনি খুলে ফেলতে৷ যদিও পথঘাটে ঘুরে যা দেখা গেল, হকাররা প্রায় কেউই সেই কথা কানে তোলেননি৷ কলকাতার রাস্তাঘাটও সন্ধের পর থেকে ক্রমশ ফাঁকা হতে শুরু করে৷ উঠে যেতে থাকে বাস, ট্যাক্সি৷ মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে জানানো হয়, যতক্ষণ পরিস্থিতি বিরূপ না হচ্ছে, নিয়মিত নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী মেট্রো চালু থাকবে৷ তবে কোনো ঝুঁকি না নিয়ে শুক্রবার রাত থেকেই কলকাতা বিমানবন্দরের সমস্ত উড়ান বাতিল ঘোষিত হয়৷
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় ফণী আঘাত হানার আগেই ঝড়ের কারণে লণ্ডভণ্ড হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলা৷ স্থানীয় সময় সকাল সোয়া ১০টায় মাত্র ১৫ সেকেন্ডের একটি দমকা হাওয়া বয়ে যায় শহরের মির্জাবাজার এলাকার উপর দিয়ে৷ ঝড়ের শক্তিতে আশেপাশের অন্তত ২৫টি বাড়ির চাল উড়ে গিয়েছে৷
বাংলাদেশে আঘাত
পশ্চিমবঙ্গের উপকূল থেকে আরো উত্তর-উত্তর পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে শুক্রবার মধ্যরাত নাগাদ ফণী খুলনাসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ফণীর পৌঁছানোর কথা৷
এরপর রাজশাহী, রংপুর এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহের ওপর দিয়ে দেশের উত্তরাংশ পেরিয়ে যেতে পারে৷ দেশের স্থলভাগ পার হওয়ার সময় ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে৷
ফণীর প্রভাবে গাছ ভেঙে পড়ে বাংলাদেশে একজন নারী নিহতের খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি৷
গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এ ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ৷ শুক্রবার সকাল পর্যন্ত বাংলাদেশের উপকূলের ৪ লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে৷