ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়িয়ে নানান ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করা হয়, তাই সামগ্রিকভাবে ঘৃণা হলো প্রভাবশালীদের এক রকমের হাতিয়ার৷ এর বাইরে এককভাবে যারা ঘৃণা ছড়ান, তারা কুশিক্ষা বা কুচেতনার বশবর্তী হয়ে এমন করেন বলে মত বিশ্লেষকদের৷
বিজ্ঞাপন
ঘটনা এক
ক'দিন আগেই ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলা হলো৷ ধরা পড়লেন হামলাকারী৷ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে হামলাকারী দাবি করলেন যে, অধ্যাপক ইকবাল ইসলামবিদ্বেষী৷ তাই তাঁর ওপর হামলা করা হলো৷
এই ঘটনায় সামাজিক গণমাধ্যমজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা গেল৷ বেশিরভাগ মানুষই ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ করেছেন৷ কিন্তু এর বাইরেও অনেকে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থনও করেছেন৷ অনেকেই ড. জাফর ইকবালকে নিয়ে বিদ্বেষমূলক মন্তব্যও করেছেন৷
ঘটনা দুই
২০১৭ সালের নভেম্বরে ফেসবুকে ধর্মীয় কটূক্তির ঘটনাকে কেন্দ্র করে রংপুরে পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে৷
টিটু রায় নামে জনৈক ব্যক্তি যিনি ফেসবুকে ধর্মীয় কটূক্তি করেছেন বলে ছড়ানো হয়, দেখা যায়, তিনি রংপুরেই থাকেন না পাঁচ বছর ধরে৷ থাকেন ঢাকায়৷ আর পড়াশুনা জানেন না৷ ফেসবুকে এমন কটূক্তি তাঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়৷
অথচ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়৷ এ সময় পুলিশ ও সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তদের ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ও সংঘর্ষে এক যুবক নিহতও হন৷ আহত হন অর্ধশতাধিক৷
দেশে দেশে ইন্টারনেটে নিয়ন্ত্রণ-লড়াই
অনলাইনে ঘৃণা ছড়ানো বন্ধ করতে জার্মানি একটি ‘সামাজিক মাধ্যম আইন’ করতে চায়৷ জার্মান সংসদে এ নিয়ে আলোচনা চলছে৷ এরই মধ্যে এর সমালোচনাও শুরু হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/W. Kastl
মুক্তমত, নাকি অবৈধ বিষয়বস্তু?
ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য, প্রপাগান্ডা, অ্যাক্টিভিজম ইত্যাদি অনলাইনে হরহামেশাই চলে৷ এগুলো নিয়ে দেশে দেশে বিতর্ক কম হয়নি৷ নানা দেশে তাই সামাজিক মাধ্যমে সরকারি হস্তক্ষেপও এসেছে৷ অনেকে এটাকে মুক্ত মতের উপর হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/W. Kastl
সামাজিক মাধ্যম আইন
জার্মানির আইনমন্ত্রী হাইকো মাস সামাজিক মাধ্যমের জন্য একটি আইনের প্রস্তাবনা তৈরি করেছেন৷ সে আইনে বিদ্বেষমূলক পোস্ট অপসারণ না করলে সামাজিক মাধ্যম কোম্পানির বিপুল জরিমানার কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু এতে বিগড়ে বসেছে ফেইসবুক৷ তারা বলছে, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং ভুয়া খবর ঠেকানোর দায় তাদের একার নয়৷ সরকারকেও এই দায়িত্ব নিতে হবে৷ আইনটি এখন পর্যালোচনার জন্য জার্মান সংসদীয় কমিটিতে রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/T. Hase
ভুলে যাওয়ার অধিকার
২০১৪ সালে ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ জাস্টিসের জারি করা এক আদেশে বলা হয়, গুগল, বিং-এর মতো সার্চ ইঞ্জিনকে তাদের অনুসন্ধানের ফলাফলে কোনো বিশেষ কিছু বাদ দিতে ইউরোপীয় নাগরিকরা অনুরোধ জানাতে পারবেন৷ গুগল সেই আদেশ বাস্তবায়ন করলেও আগে এ বিষয়ে বেশ অনাগ্রহ দেখিয়েছে৷ তখন তারা বলেছে, এটা ইন্টারনেটকে মুক্ত বিশ্বের আবদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে ফেলবে৷
ছবি: picture-alliance/ROPI/Eidon/Scavuzzo
ইউক্রেনের নিষেধাজ্ঞা
ইউক্রেন গত মে মাসে রাশিয়ার সামাজিক মাধ্যম ও ওয়েবসাইটের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে৷ বিষয়টি দেশটির লাখ লাখ মানুষের উপর প্রভাব ফেলে৷ অনেকেই তাদের ডাটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন৷ এর প্রতিবাদে তরুণরা রাস্তায় নেমে আসে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/Str
প্রসঙ্গ: সেফ হারবার
২০১৫ সালে ইউরোপীয় কোর্ট অব জাস্টিস এক রায়ে ইউএস এবং ইইউ’র মধ্যকার চুক্তি ‘সেফ হারবার’কে অকার্যকর ঘোষণা করে৷ যে চুক্তি বলে কারো ব্যক্তিগত তথ্য পূর্বানুমতি ছাড়াই হস্তান্তর করা যায়৷ অস্ট্রেলীয় আইনের ছাত্র ম্যাক্স স্ক্রিম ফেইসবুকের বিরুদ্ধে একটি মামলার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন৷ মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) সাবেক ঠিকাদার অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেন তথ্য ফাঁস করায় তিনি এই ব্যবস্থা নিচ্ছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Warnand
কঠোর চীন
চীনে সরকার কঠোরভাবে সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে৷ ফেসবুক, টুইটার, ইনসটাগ্রামের মতো হাজার হাজার ওয়েবসাইট দেশটির সরকার নিষিদ্ধ করে রেখেছে৷ সেখানকার সরকার নিজস্ব ওয়েবসাইট চালু করেছে৷ যেমন, ইউবো, উইচ্যাট৷ জনবহুল এই দেশটিতে এখন এগুলোরও কোটি কোটি ব্যবহারকারী রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Imaginechina/Da Qing
6 ছবি1 | 6
দেশে এমন ঘটনা নতুন নয়৷ ২০১৬ সালের অক্টোবরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাছিরনগরে প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটে৷ ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধমন্দির পোড়ানো হয়৷ সবগুলো ঘটনাতেই ফেসবুকে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর পোড়ানো, মন্দির জ্বালিয়ে দেয়া হয়৷
ঘটনা তিন
২০১৬ সালের আগষ্টে কলকাতার নজরুল মঞ্চে ছিল ‘স্বাধীনতা কনসার্ট'৷ সেখানে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিল বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলস৷ কলকাতার ব্যান্ড ফসিলসেরও সেখানে গান গাওয়ার কথা ছিল৷
কিন্তু হঠাৎ করেই বেঁকে বসলেন ফসিলসের ভোকাল রূপম ইসলাম৷ মাইলসের শাফিন ও হামিন আহমেদের ‘ভারতবিরোধী' বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে এক মঞ্চে না গাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি৷ এ নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিলেন৷
এরপর মাইলসের সদস্যরাও রূপমের ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা' নিয়ে প্রশ্ন তোলেন৷ দুই পক্ষের বিদ্বেষ দুই বাংলার অনেকের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে৷ এই অবস্থা চলতে থাকে বেশ কিছুদিন৷
ঘটনা চার
চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ডুব' চলচ্চিত্র প্রসঙ্গ৷ এই চলচ্চিত্রটি হুমায়ুন আহমেদের জীবনের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ ছিল হুমায়ূনপত্নী মেহের আফরোজ শাওনের৷ সেই বিতর্কের জেরে শাওনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু করেন অনেকেই৷
তেমনই একজন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বান্টি মীর৷ তিনি সামাজিক গণমাধ্যমে বেশ কয়েকটি ভিডিও প্রকাশ করে সেখানে আক্রমণাত্মক ও অশালীনভাবে শাওন ও তাঁর পরিবারকে আক্রমণ করেন৷
ঘটনা পাঁচ
২০১৭ সালের ঘটনা৷ ফেসবুকের ‘আনসেন্সরড বিডি' পেজে ছবি পোস্ট করা হয় বিশ্বখ্যাত অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, তাঁর স্ত্রী শিশির, কন্যা অব্রি ও তাদের কাজের মেয়ের৷
সেই ছবিটিতে দেখা যায় যে, সাকিব ও শিশির খাচ্ছেন, এবং তাঁদের পেছনে দাঁড়িয়ে কাজের মেয়ে৷
ছবিটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়৷ অনেকেই কটূ কথা বলতে শুরু করেন সাকিব ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে৷ কেউ কেউ সাকিবের অতীত টেনে নানা রকম অশালীন মন্তব্য করেন৷
কিন্তু পরে জানা যায়, যে ছবিটি পোস্ট করা হয়েছে, তা মূল গল্পের একাংশ৷ সেখান থেকে বেরিয়ে আসা অন্য ছবিগুলোতে দেখা যায়, মেয়েটি তাদের সঙ্গে একই খাবার টেবিলে বসে আছে৷
‘হেট স্পিচ মানুষের একটি টিকে থাকার কৌশল’
ওপরের ঘটনাগুলোর প্রত্যেকটির প্রেক্ষাপট ভিন্ন৷ প্রত্যেকটির ব্যাপকতাতেও আছে ভিন্নতা৷ কিন্তু একটি বিষয় সবগুলোতেই রয়েছে, তা হলো, প্রতিটি ঘটনাই বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বা হেট স্পিচের এক একটি উদাহরণ৷
বিদ্বেষ ছড়ানোর ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়৷ বিদ্বেষ ছড়িয়ে নাশকতা তৈরির নজিরও আছে ভুড়ি ভুড়ি৷ কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের ফলে এই বিদ্বেষ ছড়ানো যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে৷
এখনকার সময়ে সবচেয়ে বেশি যেটি দেখা যায়, সেটি হলো, সাম্প্রদায়িক বক্তব্য৷ অর্থাৎ ভিন্ন ধর্মের বা মতের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো৷ এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক আফসান চৌধুরী৷ তিনি মনে করেন, হেট স্পিচ দেয়া বা সমাজে ঘৃণা ছড়ানো মানুষের একটি টিকে থাকার কৌশল৷ ঘৃণা ছড়ালে কারো কারো লাভ হয়৷ তাই লাভবান হতেই হেট স্পিচ ছড়ানো হয়৷
‘‘একাত্তরে কিছু মানুষ সুবিধা নেবার জন্য বা লুটতরাজ করার জন্য বিদ্বেষ ছড়িয়েছে৷ কিন্তু গোষ্ঠীগতভাবে মুসলিমরা হিন্দুদের প্রতি বা হিন্দুরা মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষী কখনোই ছিল না৷''
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, রংপুরের টিটু রায় কিংবা ফেনীতে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রায়ের পর যেসব ঘটনা ঘটেছে সবই স্থানীয় সুবিধা আদায়ের জন্য হয়েছে বলে মনে করেন আফসান চৌধুরী৷
‘‘দেখবেন, বেশিরভাগ এমন ঘটনার পর জমি দখলের ঘটনা ঘটেছে৷ স্থানীয় প্রভাবশালীরাই তা করছে৷''
তিনি নিজের গবেষণায় দেখেছেন যে, এসব ঘটনায় স্থানীয় মুসলিমরাই হিন্দুদের আশ্রয় দিয়েছেন৷ তাই তিনি মনে করেন, ধর্মীয় উস্কানি থাকলেও এগুলোতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষয় নেই৷
অধ্যাপক চৌধুরী মনে করেন যে, প্রভাবশালীরাই বিদ্বেষ টিকিয়ে রেখেছে৷ কারণ, সাধারণ মানুষের বিদ্বেষ করা ছাড়াও রুটিরুজির কাজ করতে হয়৷ তাই বিদ্বেষ টিকিয়ে রেখে লাভ হয় ক্ষমতাবানদেরই৷ কোনো কোনো গোষ্ঠী এই সুযোগ নিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিল করে৷
তিনি মনে করেন, সারাবিশ্বে সবাই সহিংস বিদ্বেষকেই বড় করে দেখে৷ কিন্তু এই সমাজে অহিংস বিদ্বেষ ছড়িয়ে অর্থনীতি ধ্বংস করে নিজেরা লাভবান হচ্ছে, সেটি কেউ দেখে না৷
‘আমরা তো জঙ্গলে বাস করছি না’
‘‘আজকে যদি একজন ১ হাজার কোটি টাকা মেরে দিতে চায়, সে যদি ১০ কোটি টাকা বিএনপির বিরুদ্ধে খরচ করে, তাহলে সে দুর্নীতি করে পার পেয়ে গেল৷ কারণ, তখন আওয়ামী লীগের লোকেরা তাকে কিছু বলবে না৷ একই কথা বিএনপি সরকারে এলে তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷'' টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে বলছিলেন তিনি৷
শুধু রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক নয়, ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে নারীর প্রতিও বিদ্বেষ দেখা যায় ব্যাপক৷ সেই বিদ্বেষ বিকৃতির পর্যায়েও চলে যায়৷ প্রায়ই লাঞ্ছনার শিকার হওয়া নারীরা ফেসবুকে বা সামাজিক মাধ্যমে সোচ্চার হলে অনেকে পক্ষ নিলেও অনেককেই দেখা যায় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিতে৷
সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী৷ ডয়চে ভেলেকে টেলিফোনে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, পরিবারেই এই বিষয়গুলোর শিকার হয় নারীরা৷
‘‘নারী আসলে ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়৷ পরিবারেই ঠিকমতো এগুলো শেখানো হয় না৷ স্কুলগুলোতেও একই অবস্থা৷'' বলছিলেন তিনি৷
নারীদের প্রতি যে কোনো অত্যাচার হলেই কিছু মানুষকে তাঁদের চরিত্র নিয়ে খুব কথা বলতে দেখা যায়৷ ‘‘এটাতো একেবারে কমন৷'' বলছিলেন সালমা আলী৷ ‘‘শুধু পুরুষরা নয়, এমনকি নারীরাও এ প্রশ্ন তোলেন৷ যেমন, এই বনানীর ঘটনাটার কথা ধরেন, মেয়েগুলো কেন গেল, এটাই প্রশ্ন করছেন তারা৷ আমরা তো জঙ্গলে বাস করছি না যে কোথাও যেতে পারব না৷''
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ জরিপ বলছে, প্রতি পাঁচ জনে একজনের বেশি নারী অনলাইনে হয়রানির শিকার হন৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর বিষয়গুলোও বেড়েছে বলে মনে করেন এই মানবাধিকার কর্মী৷
‘‘আইন আছে৷ প্রচলিত আইনেই এসবের বিচার চাওয়া যায়৷ সেই সঙ্গে এখন তো পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট আছে৷'' ঠিকমতো কাজে লাগালে এসব প্রতিহিংসামূলক বক্তব্য ঠেকানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি৷
গবেষক আফসান চৌধুরী ও আইনজীবী সালমা আলী মনে করেন ‘ঘৃণা' বিষয়টি সমাজের মধ্যে গেঁথে আছে৷ এখান থেকে বেরুতে হলে দরকার সামাজিক কাঠামোগত পরিবর্তন৷ সেই পরিবর্তন তখনই কমবে, যখন রাষ্ট্র সবাইকে সমান সুযোগ দিতে পারবে, এবং ঘৃণা ছড়িয়ে যখন লাভবান হওয়ার পথ সংকীর্ণ হয়ে আসবে৷
ঐতিহাসিক হেট স্পিচ
পৃথিবী জুড়ে রাজনৈতিক নেতারা হেট স্পিচে মেতেছেন৷ তবে রাজনৈতিক ইতিহাসে হেট স্পিচ নতুন কিছু নয়৷ নানা সময়ে নানা নামে নানা কায়দায় হেট স্পিচ চালু ছিল৷ ছবিঘরে তারই কিছু উদাহরণ দেওয়া গেল৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media Co. Ltd
ডোনাল্ড ট্রাম্প
বিশ্ব রাজনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি হেট স্পিচের জন্য নাম কিনেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ একবার নয়, বার বার হেট স্পিচ দিয়েছেন৷ তাঁর টার্গেট হয়েছেন কখনো মুসলিমরা আবার কখনো আফ্রিকার মানুষেরা৷ একদা তিনি বলেছিলেন, মুসলিমদের দেশে ঢোকা বন্ধ করে দেবেন তিনি৷ আর আফ্রিকার কয়েকটি দেশের মানুষদের বিষয়ে বলেছিলেন, তাঁরা ‘শিটহোল’ দেশ থেকে এসেছেন৷ যা নিয়ে প্রভূত সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁকে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Harnik
খেয়ার্ট ভিল্ডার্স
গোটা ইউরোপেই এখন অতি দক্ষিণপন্থিদের বারবাড়ন্ত৷ হল্যান্ডে এখনো দক্ষিণপন্থিরা সেভাবে থাবা বসাতে না পারলেও ডাচ নেতা খেয়ার্ট ভিল্ডার্স সংসদে দাঁড়িয়ে যে বক্তৃতা করেছিলেন তা ডাচ ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কের দিন৷ ভিল্ডার্স বলেছিলেন, ইসলাম একটি খারাপ বিষয়৷ ইসলামের জন্য হল্যান্ডের সংস্কৃতি নষ্ট হচ্ছে৷ সংসদেই ভিল্ডার্সকে এরপর চ্যালেঞ্জ করেছিলেন অন্যান্য সংসদেরা৷
ছবি: Imago/Hollandse Hoogte
যোগী আদিত্যনাথ
ভারতে বর্তমান শাসকদল বিজেপি এবং তার সহযোগীরা হেট স্পিচের জন্য বিখ্যাত৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরাসরি অভিযুক্ত গুজরাট দাঙ্গার জন্য৷ হেট স্পিচও দিয়েছেন তিনি একসময়৷ তবে সমসময়ে তাঁর শিষ্য এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ হেট স্পিচের জন্য সবচেয়ে কুখ্যাত হয়েছেন৷ উত্তর প্রদেশে মুসলিমদের বিরুদ্ধে একাধিক হেট স্পিচ দিয়েছেন তিনি প্রকাশ্যে৷ দাঙ্গাও বাঁধিয়েছেন৷
ছবি: Imago/Zumapress
প্রবীণ তোগাড়িয়া
বিশ্বহিন্দু পরিষদ বিজেপিরই অন্যতম শাখা সংগঠন৷ সেই সংগঠনের প্রধান প্রবীণ তোগাড়িয়া একটি জনসভায় মুসলিমদের কুকুরের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন৷ এরপর তাঁর বিরুদ্ধে বহু মামলা হয়েছে৷ সে সব মামলা এখনো চলছে৷
ছবি: UNI
জর্জ ডাব্লিউ বুশ
ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগেও বহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট হেট স্পিচের জন্য ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন৷ ট্রাম্পের সমকক্ষ না হলেও জর্জ ডাব্লিউ বুশ তাঁর অন্যতম৷ বর্ণবিদ্বেষমূলক নীতি গ্রহণের অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে৷ বিশেষত স্কুলের ছাত্রদের ক্ষেত্রে তিনি বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য করেছিলেন বলে অভিযোগ৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/S. Wenig
জন ক্যালভিন কোলড্রিজ
১৯২৩ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন কোলড্রিজ৷ ১৯২৭ সালে হয় ভয়াবহ মিসিসিপি বন্যা৷ অভিযোগ, শ্বেতাঙ্গদের দ্রুত উদ্ধারের ব্যবস্থা করলেও কোলড্রিজ কৃষ্ণাঙ্গদের উদ্ধারের কোনো ব্যবস্থাই করেননি৷ বহু কৃষ্ণাঙ্গ সে সময় প্রাণ হারিয়ে ছিলেন৷ পৃথিবী জুড়ে কোলড্রিজের বিরুদ্ধে সমালোচনা হয়েছিল৷
ছবি: Imago/Ralph Peters
উড্রো উইলসন
১৯১৩ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন উড্রো উইলসন৷ বহু ভালো কাজের জন্য প্রশংসিত হলেও অধিকাংশ মার্কিন প্রেসিডেন্টের মতো তিনিও হেট স্পিচ দিয়েছেন৷ ক্ষমতায় এসে ফেডারেল শ্রমিকদের কাজের পুনর্নবিকরণ করেছিলেন৷ সে সময় অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গকে চাকরিচ্যূত করেছিলেন৷ যাঁদের কাজ বেঁচে গিয়েছিল, তাঁদের জন্য আলাদা খাওয়ার ঘর, কাজের পরিসরের ব্যবস্থা হয়েছিল৷ শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে কাজ করার অধিকার ছিল না তাঁদের৷
ছবি: Getty Images
আডল্ফ হিটলার
কমিউনিস্ট, মুসলিম এবং ইহুদিদের বিরুদ্ধে তিনি যা বলেছেন, সবই হেট স্পিচ৷ শুধু বলেছেন না, ইহুদিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানোরও ব্যবস্থা করেছেন৷ বিশ শতকের দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি হেট স্পিচের রেকর্ড আডল্ফ হিটলারের মুকুটেই৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media Co. Ltd
বেনিটো মুসোলিনি
তাঁর শাসনকালেই ‘ফাশিস্ত’ শব্দটির উদ্ভব৷ বিরোধীদের প্রসঙ্গে যে ধরনের মন্তব্য তিনি করতেন, তা এক কথায় হেট স্পিচ৷
ছবি: picture alliance/AP
ইদি আমিন
১৯৭১ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত উগান্ডার স্বৈরাচারী শাসক ছিলেন ইদি আমিন৷ তাঁর আগের শাসক আবোটের অনুগামীদের বিরুদ্ধে কুৎসিত মন্তব্য করে তিনি নিজের সমর্থকদের তাতিয়ে দিতেন৷ অভিযোগ, আকোলি এবং ল্যাঙ্গো উপজাতির বিরুদ্ধেও একইরকম মন্তব্য করতেন তিনি৷ এবং শেষ পর্যন্ত ওই দুই উপজাতির মানুষদের নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল তাঁর দলবল৷ উগান্ডার ইতিহাসে এখনো যা সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়৷
ছবি: Getty Images
জোসেফ স্ট্যালিন
সোভিয়েত রাশিয়ার এই কমিউনিস্ট নেতার বিরুদ্ধেও হেট স্পিচের অভিযোগ আছে৷ কেবল অ্যামেরিকা নয়, তাঁর নিজের দেশের বিরোধীদের সম্পর্কেও বহু হেট স্পিচ দিয়েছেন তিনি৷ মানুষ উসকেছেন বিরোধীদের একঘরে করার জন্য৷ বস্তুত আয়রন ক্যাম্পও তাঁরই সৃষ্টি৷
ছবি: AFP/Getty Images
আশিন উইরাথু
তিনি ‘মিয়ানমারের বিন লাদেন’ হিসেবেও পরিচিত৷ এই কট্টর জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষু ফেসবুকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কানি ও বিদ্বেষমূলক পোস্ট দিয়ে ব্যাপক আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন৷ তার বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এতটাই প্রভাব বিস্তার করছিল যে ফেসবুক তাঁর পেজটি মুছে ফেলতে বাধ্য হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Gacad
জুলফিকার আলী ভুট্টো
বাংলাদেশ ও এদেশের জনগণ পাকিস্তানের শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরোধিতা করায় এ নিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর খুবই মনোকষ্ট ছিল৷ তিনি কখনো মেনে নিতে পারেননি যে, এদেশের মানুষ তাঁর কথার বিরোধিতা করেছে৷ এমনকি প্রকাশ্যে তিনি জনসভাতেই বলে ফেলেছিলেন৷ ঢাকায় এক জনসভায় তিনি বলেই ফেলেছিলেন যে, ‘‘মঞ্জুর হ্যায় তো ঠিক হ্যায়, নেহি মঞ্জুর হ্যায় তো শুয়োর কে বাচ্চে, জাহান্নাম মে যায়ে৷’’