ছোট্ট এক টুকরো চকলেট৷ কিন্তু মন ভরে না৷ আর একটু নিলে ক্ষতি কী? তারপর আর এক টুকরা৷ দেখতে দেখতে গোটা বারই শেষ হয়ে গেল৷ বিবেকে লাগছে? তার প্রয়োজন নেই৷ চকলেটে বেশ কিছু গুণাগুণও রয়েছে, বলেন চিকিৎসকরা৷
বিজ্ঞাপন
চকলেট প্রসঙ্গে কোনো দেশের কথা মনে হয় প্রথমে? নিশ্চয়ই সুইজারল্যান্ডের কথা৷ যেমন নোবেল প্রাইজের ব্যাপারে মনে ভেসে ওঠে সুইডেনের কথা৷ এই দুই দেশে অনেক চকলেট খাওয়া হয়৷ আর এই দুই দেশ থেকেই এসেছেন বহু নোবেল বিজয়ী৷ চকলেট ও বুদ্ধিমত্তার মধ্যে কি কোনো সংযোগ রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন নিউইয়র্কের গবেষক ফ্রান্স মেসের্লি৷ তাঁর এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছেন ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে'৷
২৩টি দেশের ওপর সমীক্ষা
সুইজারল্যান্ডে বছরে একজন প্রায় ১২ কিলো চকলেট খেয়ে থাকেন৷ আর এই দেশটি থেকেই সবচেয়ে বেশি নোবেল প্রাইজ বিজয়ী (৩৬) এসেছেন৷ সব মিলিয়ে ২৩টি দেশের ওপর সমীক্ষা চালিয়েছেন মেসের্লি৷
তবে সুইডেনে ৬.৫ কিলোগ্রাম চকলেট খাওয়া হয়৷ অথচ দেশটি থেকে ৩২ জন নোবেল বিজয়ী এসেছেন৷ ‘চকলেট-পরিসংখ্যান' অনুযায়ী, সুইডেনে এই ধরনের বিজ্ঞ ব্যক্তির সংখ্যা ১৪ হওয়ার কথা৷
এই বিষয়টির ব্যাখ্যাও দিয়েছেন মেসের্লি৷ সুইডিশরা এব্যাপারে সংবেদনশীল৷ তাই অল্প চকলেটেই কাজ হয়৷ যা নোবেল পাওয়ার জন্য যথেষ্ট৷ অন্য আরেকটি সম্ভবনার কথাও বলেছেন এই গবেষক৷ নোবেল প্রাইজ কমিটির কেন্দ্র সুইডেনে অবস্থিত৷ তাই পুরস্কারের ব্যাপারে কিছুটা পক্ষপাত থাকতে পারে৷
রসাত্মক গবেষণা
অবশ্য এই গবেষণাকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন না জার্মান পুষ্টি সোসাইটির আঙ্গেলা বেশ্টহোল্ড৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘নানা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে চকলেটের উপাদান মানুষের কর্মদক্ষতার ওপর ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে৷ আর এর ওপর ভিত্তি করে মেসের্লি সমীক্ষাটি করেছেন৷ কোনো কোনো দিক দিয়ে দুটির মধ্যে একটা সংযোগও লক্ষ্য করেছেন তিনি৷ তবে একে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয় বরং রসাত্মক গবেষণা হিসাবে দেখা উচিত৷'' ‘মেসের্লি-পরিসংখ্যান' অনুযায়ী জার্মানির স্থান সপ্তম৷
বিজ্ঞানের জগতে চকলেটের গুণাগুণ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে৷ বিশেষ করে মানুষের শরীরে কালো ও তিতা স্বাদের চকলেটের প্রভাব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে৷
ইতিবাচক প্রভাব পেতে প্রচুর চকলেট
শরীরে ইতিবাচক প্রভাব পেতে হলে চকলেটে কমপক্ষে ৭০ শতাংশ কোকো থাকতে হবে৷ রহস্যটা রয়েছে কোকো দানাতে থাকা ‘ফ্লাভোনয়েডস' নামে এক ধরনের উদ্ভিজ উপাদানে৷ এর সংক্রমণ প্রতিরোধী গুণাগুণ রয়েছে৷ যা রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণ করে, কোলেস্টরেল ও উচ্চ রক্তচাপ কমায়৷ বার্ধক্যের প্রক্রিয়া মন্থর করে৷ স্মৃতিশক্তি ও মানসিক দক্ষতা বৃদ্ধি করে৷ এদিক দিয়ে মেসের্লি ঠিকই বলেছেন৷
জার্মানিতে বিশ্বের একমাত্র চকলেট মিউজিয়াম
চলুন, ঘুরে দেখা যাক
ছবি: picture alliance/Horst Galuschka
সবার জন্য চকলেট
‘চকলেট খায় বাচ্চারা’ – এমনটাই আমরা আগে শুনেছি৷ তবে জার্মানিতে এসে দেখছি চকলেট ছোট, বড় সবার জন্য৷ বাচ্চাদের জন্য অবশ্য আলাদা বিশেষ চকলেট রয়েছে, যেগুলোতে দুধ এবং মিষ্টির পরিমাণ একটু বেশি থাকে৷ আজকাল তো দেখা যায় হৃদরোগীদের ডাক্তাররা কালো বা বিটার চকলেট খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/ZB
রাইন নদীর বুকে চকলেট মিউজিয়াম
জার্মানির কোলন শহরের এই মিউজিয়ামটি বিশ্বের প্রথম এবং একমাত্র চকলেট মিউজিয়াম৷ মিউজিয়ামটি দেখে মনে হয় যেন কাঁচ আর ধাতুর তৈরি একটি সুন্দর জাহাজ৷ ৪,০০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে চকলেট আর কোকোর পুরনো ইতিহাস বহন করছে এই মিউজিয়ামটি৷
ছবি: DW
কোলনকে বিশেষ উপহার
চকলেট কোম্পানি ‘স্টলভের্ক’-এর মালিক হান্স ইমহোফ এই মিউজিয়ামটি তৈরি করেন ১৯৯৩ সালে৷ যেখানে চকলেটের ৩,০০০ বছরের পুরনো ইতিহাস নানাভাবে তুলে ধরা হয়েছে৷ বিশেষ ধরণের এই মিউজিয়ামটি হান্স ইমহোফ কোলন শহরকে উপহার দিয়ে দিয়েছেন এবং যার মধ্য দিয়ে তিনি অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছেন৷ ২০০৭ সালে তিনি মারা যান৷
ছবি: Foustontene - Fotolia.com
কোকো দানা
কোকোর দানা বা বিচি থেকে তৈরি করা হয় চকলেট৷ মিউজিয়ামের ভেতরের ঘরটিতে শুধু কোকো সম্পর্কেই দেওয়া হয়েছে নানা তথ্য৷ যেমন ২০ জাতের কোকোর পরিচয়, কোকোর চাষ ইত্যাদি৷ কোকো দানার জন্ম ল্যাটিন অ্যামেরিকায়৷ ১৭০০/১৮০০ শতকে এটি প্রথম ইউরোপে আসে ড্রিংক চকলেট হিসেবে৷ এরপর ১৯ ও ২০ শতকে কোকো প্রথম চকলেট আকারে বানানো শুরু হয়৷
ছবি: DW
বিশেষ আকর্ষণ – চকলেট গাছের ঝরনা
তিন মিটার উঁচু এই সুন্দর ঝরনাটি যে চকলেট মিউজিয়ামের বিশেষ আকর্ষণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ যা দেখে একটুখানি চেখে দেখার লোভ সামলানো যায় না৷ আর সেজন্যই হয়ত বা যারা মিউজিয়ামে ঢোকেন, সবাইকেই একটি করে বিস্কুট গরম চকলেটের মধ্যে ডুবিয়ে খেতে দেওয়া হয়, তার আসল স্বাদ গ্রহণ করার জন্য৷
ছবি: picture-alliance/Bildagentur Huber
যে দেশের যে সংস্কৃতি
আসলে বাংলাদেশ বা ভারতে যেমন কোনো উপলক্ষ্য বা কোথাও গেলে মিষ্টি নিয়ে যাওয়ার রীতি রয়েছে, তেমনি জার্মানিতে নিয়ে যাওয়া হয় চকলেট৷ আপনি এখানে কোনো জার্মান বাড়িতে আমন্ত্রিত, কি নেবেন ভাবছেন? না, ভাবনার কিছু নেই৷ অনায়াসেই নিয়ে যেতে পারেন সুন্দর এক বাক্স চকলেট৷ আর যদি কারো পছন্দের চকলেটের নাম জানা থাকে, তাহলে তো সোনায় সোহাগা !
ছবি: DW
কত রকমের চকলেট
এই ২১ শতকে চকলেট ছাড়া জার্মানদের জীবন ভাবা যায়না৷ লিন্ড, স্টলভের্ক, রিটার স্পর্ট, মিলকা, নিউটেলা, মোত্সার্ট মার্বেল, সারোটি – কত ছোট বড় কোম্পানির চকলেট যে রয়েছে এদেশে৷
ছবি: DW
চকলেট মিউজিয়াম দেখা মানেই অভিজ্ঞতা অর্জন
চকলেট খেলে শরীর মনে কি প্রভাব পড়ে, আগে কিভাবে চকলেট বানানো হতো আর এখনই বা কিভাবে তৈরি করা হয় ইত্যাদি বিষয়েও জানা যাবে এই মিউজিয়ামে গেলে৷
ছবি: Fotolia/Tatyana Gladskih
চকলেট দিয়ে তৈরি মানুষের মিছিল
মানুষের মিছিলের মতো কোকো আর চকলেট দিয়ে ১৮ সেন্টিমিটার উঁচু এই চকোলেট মিছিলটি তৈরি করেছেন এক শিল্পী৷ একটি প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে এটা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রিয়জনের জন্য চকলেট
চকলেট খেতে ভালোবাসে এমন মানুষের অভাব নেই৷ কিন্তু চকলেটের ইতিহাসও জানতে ইচ্ছে করে অনেকেরই৷ তাই এরই মধ্য প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ কোলনের এই চকলেট মিউজিয়াম পরিদর্শন করেছেন৷ মিউজিয়ামে চকলেট বানানোর রহস্য অর্থাৎ রেসিপি ও প্রণালী দেওয়া আছে৷ তবে এভাবে বাড়িতে বসে চকলেট তৈরি করা না গেলেও, একটা ধারণাটা তো পাওয়া যাবে!
ছবি: imago/INSADCO
বাড়তি পাওয়া
চকলেট মিউজিয়াম ঘুরে এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানার পর ঢুকে পড়ুন চকলেট মিউজিয়ামের ক্যাফেতে৷ সেখানে খেতে পারেন খুবই মজার এক টুকরো চকলেট কেক বা গরম চকলেট, যাকে বলে ‘হট চকলেট’৷ আর সেই সাথে উপভোগ করতে পারেন রাইন নদীর সৌন্দর্য, যে অনুভূতি অনেকদিন মনে রাখার মতো৷
ছবি: picture alliance/Horst Galuschka
11 ছবি1 | 11
আঙ্গেলা বেশ্টহোল্ড বলেন ‘ফ্লাভোনয়েডস'-এর আরো কিছু ইতিবাচক গুণাগুণ রয়েছে৷ এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধশক্তি ও রক্তের ধমনির ওপর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে৷ এর ফলে রক্তচলাচল ভালোভাবে হয়৷ প্রতিরোধ হয় স্ট্রোক ও হার্টঅ্যাটাকের মতো অসুখবিসুখ৷
চকলেট সুখানুভূতির হরমোন ‘সেরোটোনিন' উজ্জীবিত করে৷ এখানে প্রশ্ন জাগতে পারে, সুখি হতে হলে কী পরিমাণ চকলেট খাওয়া প্রয়োজন? উত্তরে বলা যায়, প্রচুর চকলেট৷ চকলেটের একটি বার দিয়ে তা হবে না৷
পুরস্কারসরূপও চকলেট
পুরস্কারস্বরূপও চকলেট দেওয়া হয়৷ ভালো কাজের জন্য কোনো বাচ্চাকে চকলেট দিয়ে পুরস্কৃত করলে এক ধরনের ইতিবাচক অনুভূতি সৃষ্টি হয়৷ যা সুখের অনভূতিও এনে দেয়৷
এবার মন্দের দিকটাও উল্লেখ না করলেই নয়৷ বেশি চকলেট খেলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়৷ কালো বা সাদা যে কোনো চকলেটেই থাকে প্রচুর পরিমাণে চিনি ও তৈলাক্ত পদার্থ৷ তাই প্রচুর পরিমাণে চকলেট খেলে ক্যালোরিও গ্রহণ করা হয় বেশি, ওজন বেড়ে যায়৷ দেখা দেয় নানা রকম অসুখ-বিসুখ৷ বলেন পুষ্টি বিজ্ঞানী বেশ্টহোল্ড৷
তবে চকলেট শুধু খেতেই মজা নয়৷ সৌন্দর্য চর্চাতেও সাহায্য করে এই মিষ্টি পদার্থটি৷ মুখের মাস্ক, বাথ কিংবা ম্যাসেজও করা যায় চকলেট দিয়ে৷ এনে দেয় সুখের অনুভূতি৷