চন্দ্রজয় নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জাল
২০ জুলাই ২০০৯
সারা দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ সেদিন সেঁটে গিয়েছিল টেলিভিশনের পর্দার সঙ্গে৷ অবাক চোখে তারা দেখছিল, তাদেরই মতো মানুষ হাঁটছে সেখানে৷ মানব জাতির গৌরবের ফলক হয়ে পত্ পত্ করে উড়ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা৷
স্নায়ুযুদ্ধের সে যুগে মহাকাশ অভিযানে প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেক্কা দিয়ে চাঁদ জয় করার রাজনৈতিক গুরুত্বও ছিল অনেক৷ কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে মানুষের সন্দেহ ততই বেড়েছে৷ কেলেংকারীর দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করা প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়ার পর থেকেই অনেকেই সরকারি ভাষ্যকে সন্দেহের চোখে দেখছিল৷ চাঁদে মানুষের প্রথম অবতরণ নিয়েও সন্দেহ করতে শুরু করে অনেকে৷ টেলিভিশনের পর্দায় দেখা বহু দূরের চাঁদে মানুষের পদচারণাকেও কেউ কেউ মিথ্যা সরকারি ভাষ্য বলে মনে করতে থাকে৷ বছর যত গড়িয়েছে সন্দেহ তত পোক্ত হয়েছে তাদের৷ মানবজাতির এই মাহেন্দ্রক্ষণকে একটি ধোঁকাবাজি বলেই মনে করতে থাকে তারা৷ চাঁদ বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তির এ সময়টাতে এসে দেখা গেছে, সেদিনের সেই ঘটনাকে অবিশ্বাস করে এরকম মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে৷ রাজনীতি, সেই ঐতিহাসিক ধারণচিত্র হারিয়ে ফেলা ও এ অভিযান সংশ্লিষ্ট মানুষদের অসংলগ্ন কথাবার্তাই কী অবিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে?
মানুষের চাঁদে পা রাখার পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৭৪ এ বিল কেইসিং নামের এক ব্যক্তি নিজের পয়সা দিয়ে বই ছাপান একটি৷ তাতে তিনি দাবি করেন মানুষ কখনো চাঁদে যায়নি৷ষড়যন্ত্র তত্ত্ব জোর হাওয়া পায় সে সময় থেকে৷ ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া ক্যাপ্রিকন ওয়ান নামের চলচ্চিত্রটি অনেকের বিশ্বাস টলিয়ে দেয়৷ চলচ্চিত্রটিতে মঙ্গলে যাওয়ার নামে মানুষকে প্রতারণা করার ঘটনা দেখানো হয়৷ সেখানে যে মহাকাশযানটি ব্যবহার করা হয় তা দেখতে অনেকটাই অ্যাপোলো ইলেভেনের মতোই৷ মূলত এই ছবিটিকে ভিত্তি করে সন্দেহবাদীর সংখ্যা বেড়ে যায়৷ আর ইন্টারেনেটের ব্যাপক সম্প্রসারণের কারণে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিস্তার ঘটে৷ তত্ত্বের গাঁথুনিও হতে থাকে শক্ত৷
১৯৯৫ সালে এক জনমত জরিপে দেখা যায়, শতকরা ছয়জন অ্যামেরিকানই মানুষের চাঁদে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন৷ পাঁচ শতাংশ মানুষ এ বিষয়ে কোনো মতামত রাখেনি৷ ১৯৯৯ সালে টাইম-সিএনএন এর একটি জরিপও প্রায় একই ফলাফল দিয়েছিল৷ ২০০১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ফক্স টিভি এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে একটি অনুষ্ঠান প্রচারের পর সন্দেহ করার হার ২০ শতাংশ বেড়ে যায় বলে টেলিভিশনটি দাবি করে৷ ২০০০ সালে রাশিয়াতে চালানো এক জরিপে দেখা যায়, ২৮ শতাংশ রুশই মনে করে না অ্যামেরিকানরা চাঁদে গেছে৷ ২০০৯ সালে বিজ্ঞান বিষয়ক একটি ব্রিটশ সাময়িকীর জরিপ জানায়, ২৫ শতাংশ ব্রিটিশ চাঁদে যাওয়াকে গল্পই মনে করে৷ এবছরই সুইডেনের একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকার জরিপ থেকে জানা যায়, পত্রিকাটির ৪০ শতাংশের মতো পাঠক বিশ্বাস করে মানুষ চাঁদে গেছে৷
অনেকেই মনে করেন, সেসময় চাঁদে মানুষ পাঠানোর প্রাযুক্তিক সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের ছিল না৷ আর নিক্সন সরকারের এরকম সাজানো নাটক মঞ্চস্থ করার পেছনে স্নায়ু যুদ্ধ, কেনেডি হত্যাকাণ্ড নিয়ে ডালপালা মেলা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, ভিয়েতনাম যুদ্ধ এসবকেই কারণ বলে ধরে ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসকারীরা৷
চাঁদে অবতরণের দৃশ্যচিত্রে বায়ুবিহীন চাঁদে পতাকা উড়তে দেখা, তৃতীয় ছায়াচিত্রসহ অনেক কিছুই মানুষকে ধাঁধাঁয় ফেলে দেয়৷ নেভাদার মরুভূমিতে দৃশ্য ধারণ করে মানুষকে বোকা বানানো হয়েছে বলে যারা মনে করেন তাদের যৌক্তিক জবাবের বদলে সেই ভিডিও টেপ হারিয়ে ফেলার মার্কিন স্বীকারোক্তি সন্দেহ বাড়াচ্ছেই কেবল৷
প্রতিবেদক: নাসিরুদ্দিন খোকন
সম্পাদনা: আবদুস সাত্তার