চরম ডানপন্থিদের দ্রুত চাকরিচ্যুত করতে চায় জার্মানি
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
জার্মানিতে একজন সরকারি চাকরিজীবীর বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের জন্য হুমকির অভিযোগ উঠলে তাকে চাকরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া সহজ করার প্রস্তাব দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফ্যাজা৷
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে এই প্রক্রিয়া শেষ হতে গড়ে চার বছর লেগে যায়৷ এইসময় অভিযুক্ত পুরো বেতন পেয়ে থাকেন৷
জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত বুধবার বলেন, ‘‘আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক রাষ্ট্রকে চরম ডানপন্থিদের দ্বারা অন্তর্ঘাত হতে দেব না৷'' রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের জন্য বিশেষভাবে বিপজ্জনক বলেও মন্তব্য করেন তিনি৷
সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ঘটনার প্রেক্ষিতে এমন প্রস্তাব আনা হয়৷ যেমন:
জার্মানির সেনাসদস্য ফ্রাঙ্কো এ. বছর কয়েক আগে সিরীয় শরণার্থী সেজে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন৷ এখন তিনি কারাগারে আছেন৷
সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে ‘রাইশব্যুর্গার আন্দোলন'-এর সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়৷ জার্মান ‘রাইশ' শব্দের অর্থ সাম্রাজ্য, আর ‘ব্যুর্গার' মানে হচ্ছে নাগরিক৷ রাইশব্যুর্গাররা নিজেদের জার্মান সাম্রাজ্যের নাগরিক বলে দাবি করেন৷ আধুনিক জার্মানিকে নিজেদের রাষ্ট্র বলে মানতে রাজি নন তারা৷ তাদের দাবি, ১৯৩৭ বা ১৮৭১ সালের জার্মান সাম্রাজ্যের সীমানাই আসল জার্মানি৷ বর্তমান জার্মানির সরকার, পার্লামেন্ট, বিচারব্যবস্থা এবং নিরাপত্তাবাহিনীকেও তারা মিত্রশক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকা পুতুল বলে মনে করেন৷
ইয়েন্স মায়ার নামক এক বিচারক চরম ডানপন্থি ভাবাদর্শের অনুসারী বলে মনে করে জার্মানির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা৷
এসব ঘটনার সঙ্গে এমন সব ব্যক্তি জড়িত যারা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছিলেন৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্যাজা বলেন, ‘‘যারা রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের এর জন্য কাজ করা উচিত নয়৷''
ফ্যাজার প্রস্তাব পাস হলে সরকার প্রশাসনিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করে অভিযুক্তকে চাকরিচ্যুত করতে পারবে৷ বর্তমানে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তা করা হয়৷
টাইমলাইন: উগ্র-ডানপন্থিদের সন্ত্রাসী হামলা
গত দশ বছরে উগ্র-ডানপন্থিদের অসংখ্য হামলা করেছে৷ এর মধ্যে কয়েকটি বড় ঘটনার দিকে ফিরে তাকিয়েছে ডয়চে ভেলে৷
ছবি: picture-alliance/empics/PA Wire/D. Lawson
জার্মানি ২০০৯: ড্রেসডেন কোর্টে নারীকে ছুরিকাঘাত
২০০৯ সালের ১ জুলাই, ড্রেসডেনের জেলা জজ আদালতে মারওয়া এল-শেরবিনি নামের নারীকে ছুরির আঘাতে হত্যা করা হয়৷ ঐ নারী ছিলেন একজন ফার্মাসিস্ট৷ স্বামী ও ছেলে সন্তান নিয়ে ড্রেসডেনে থাকতেন৷ ২৮ বছর বয়সি এক রাশিয়ান-জার্মানের বিরুদ্ধে কোর্টে কটূক্তির অভিযোগের সাক্ষ্য দেয়ায়, যুবক হামলা চালান৷ ঐ যুবক মারওয়াকে ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘উগ্র মুসলিম’ বলে গাল দিয়েছিলেন৷ মারওয়া জার্মানিতে ইসলামবিদ্বেষের প্রথম হত্যার শিকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Hiekel
নরওয়ে ২০১১: ব্রাইভিকের গণহত্যা
২০১১ সালের ২২ জুলাই অ্যান্ডার্স বেহরিং ব্রাইভিক নামের এক উগ্র ডানপন্থি যুবক একাই দু’টি ঘটনায় ৭৭ জনকে হত্যা করেন৷ তিনি প্রথমে অসলোর সরকারি ভবনে বোমা বিস্ফোরণ করেন এবং এরপর উটোয়া দ্বীপে নিরীহ তরুণদের এক সামার ক্যাম্পে গিয়ে গুলিবর্ষণ করেন৷ হামলার আগে তিনি একটি ইশতাহার প্রকাশ করেন৷ সেখানে তিনি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ‘ইউরোপের ইসলামীকরণ’-এর নিন্দা করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Berit
যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫: চ্যাপেল হিল শ্যুটিং
২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ৪৬ বছর বয়সি এক ব্যক্তি প্রতিবেশী তিন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যা করেন৷ নিহতরা হলেন দেয়াহ বারাকাত, তাঁর স্ত্রী ইউসর আবু-সালহা ও তাঁর বোন রাজান আবু-সালহা৷ হামলাকারী হত্যাকাণ্ডের আগে নিজেকে একটি সংঘবদ্ধ ধর্মের বিরোধী বলে উল্লেখ করেন৷ এই হত্যাকাণ্ডে অনলাইনে ব্যাপক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়৷ টুইটারে #MuslimLivesMatter নামে হ্যাশট্যাগ জনপ্রিয় হয়৷
২০১৫ সালের ১৭ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলাইনার চার্লেস্টনে এমানুয়েল আফ্রিকান মেথডিস্ট এপিস্কোপাল চার্চে এক শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণপন্থি গুলিবর্ষণ শুরু করেন৷ এটি যুক্তরাষ্ট্রে কালোদের সবচেয়ে পুরোনো চার্চ৷ গুলিতে নয়জন নিরীহ আফ্রিকান-অ্যামেরিকান মারা যান৷ এর মধ্যে একজন যাজকও ছিলেন৷ ২১ বছর বয়সি সেই হত্যাকারীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিদ্বেষমূলক অপরাধে দণ্ডিত করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়৷
ছবি: Getty Images/J. Raedle
জার্মানি ২০১৬: মিউনিখে গুলি
২০১৬ সালের ২২ জুলাই মিউনিখের ১৮ বছর বয়সি এক তরুণ একটি শপিং মলে ঢুকে গুলি করা শুরু করেন৷ এতে ১০ জন নিহত ও ৩৬ জন আহত হন৷ নিহতদের মধ্যে ঐ হামলাকারীও ছিলেন৷ হামলাকারী একজন ইরানি বংশোদ্ভুত জার্মান নাগরিক ছিলেন৷ পুলিশ জানায়, হামলাকারী বর্ণবাদী মন্তব্য করছিলেন৷ তিনি অভিবাসীদের উপর প্রতিশোধ নিতে চাইছিলেন৷
ছবি: Getty Images/J. Simon
যুক্তরাজ্য ২০১৭: ফিন্সবুরি পার্ক মসজিদে হামলা
২০১৭ সালের ১৯ জুন, ৪৭ বছর বয়সি এক ব্যক্তি উত্তর লন্ডনের ফিন্সবুরি মসজিদের সামনে ভ্যান চালিয়ে দিয়ে একজনকে হত্যা ও ১০ জনকে আহত করেন৷ আক্রান্তরা সবাই মুসলিম ছিলেন এবং রমজান মাসে তারাবির নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন৷ ইসলামবিদ্বেষী ওই ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/F. Augstein
যুক্তরাষ্ট্র ২০১৭: শার্লটসভিলেতে নব্যনাৎসিদের ওপর গাড়ি হামলা
২০১৭ সালের ১২ আগষ্ট ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিলেতে এক শ্বেতাঙ্গ নাগরিক বিরোধী শিবিরে হামলা চালান৷ বিরোধী শিবিরটিও সাদাদের ছিল এবং সেখানে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী ও নব্য নাৎসিরা জড়ো হন৷ এতে এক নারী নিহত ও অনেকে আহত হন৷
ছবি: Getty Images/AFP/P.J. Richards
ক্যানাডা ২০১৭: কুইবেকে মসজিদে হামলা
২০১৭ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে কুইবেকের ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে এক বন্দুকধারী সন্ধ্যার দিকে নামাজ পড়ার সময় হামলা চালান৷ এতে ছয় জন নিহত ও এক ডজনেরও বেশি মানুষ আহত হন৷ ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এই হামলাকে জঙ্গি হামলা বলে অভিহিত করেন৷
ছবি: Reuters/M. Belanger
যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮: সিনাগগে হামলা
২০১৮ সালের ২৭ অক্টোবর ৪৬ বছর বয়সি এক বন্দুকধারী পিটসবুর্গের ইহুদীদের একটি উপাসনালয়ে হামলা চালান৷ এতে ১১ জন নিহত ও ৭ জন আহত হন৷ হামলাকারী হামলার সময় বারবার ইহুদীবিদ্বেষী মন্তব্য করতে থাকেন৷ মার্কিন ইতিহাসে ইহুদীদের ওপর এটাই সবচেয়ে বড় হামলা৷
ছবি: picture-alliance/AP/M. Rourke
জার্মানি ২০১৯: নববর্ষে বোট্রোপ ও এসেনে হামলা
মধ্যরাতের কিছু পর যখন সবাই নিউইয়ার উদযাপন করছিলেন, তখন ৫০ বছর বয়সি এক ব্যক্তি জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলের দু’টি শহর বোট্রোপ ও এসেনে হামলা চালান৷ তিনি তার গাড়ি উদযাপনরত অভিবাসীদের ওপর চালিয়ে দেন৷ বোট্রোপে গাড়ি উঠিয়ে দেন সিরিয়ান ও আফগান দু’টি পরিবারের সদস্যদের ওপর৷ এতে আট জন আহত হন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Kusch
নিউজিল্যান্ড ২০১৯: ক্রাইস্টচার্চে দুই মসজিদে হামলা
ক্রাইস্টচার্চে দুই মসজিদে জোড়া হামলায় কমপক্ষে ৫০ জন নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়েছেন৷ একে উগ্র ডানপন্থিদের জঙ্গি হামলা বলে চিহ্নিত করেছে কর্তৃপক্ষ৷ বন্দুকধারী ব্যক্তি তার বর্ণবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী ইশতাহার অনলাইনে প্রকাশ করেন এবং হামলার ঘটনা লাইভস্ট্রিম করেন৷ কিউই প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডার্ন ঘটনাকে নিউজিল্যান্ডের ‘একটি অন্ধকারতম দিন’ বলে মন্তব্য করেন৷
ছবি: picture-alliance/empics/PA Wire/D. Lawson
11 ছবি1 | 11
প্রতিক্রিয়া
তবে চাকরিচ্যুতির প্রক্রিয়া দ্রুত করার লক্ষ্য পূরণ আসলেই সম্ভব কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছে ‘জার্মান অ্যালায়েন্স অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ জাজেস'৷ জার্মানির ‘সিভিল সার্ভিস এসোসিয়েশন'ও তেমনটা মনে করছে৷
এদিকে জার্মান ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন বলছে, যাদের চাকরিচ্যুতি করা হবে তারা পরবর্তীতে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে, কারণ সেটি তাদের সাংবিধানিক অধিকার৷ সেক্ষেত্রে ঐ প্রক্রিয়া আগের মতোই দীর্ঘ হতে পারে বলে মনে করছে তারা৷
আগের উদাহরণ
জার্মানির বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গ রাজ্যে ২০০৮ সাল থেকেই সরকারি চাকরিজীবীদের দ্রুতে চাকরিচ্যুতি করার প্রক্রিয়া চালু আছে৷ সেখানে যে পদ্ধতি চালু আছে তাকে মোটামুটি মডেল হিসেবে ধরে নিয়েই খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্যাজা৷
তবে বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গ রাজ্যে ঠিক কতজন সরকারি চাকরিজীবীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে সেই হিসেব দিতে পারেনিন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখপাত্র৷ তার দাবি, রাজ্য কর্তৃপক্ষ এসব তথ্য সংগ্রহ করে না৷
ফ্যাজার খসড়া প্রস্তাবটি সংসদে আলোচনার জন্য উত্থাপন করা হবে৷ জার্মানির জোট সরকারের অংশ সবুজ দল ইতিমধ্যে জানিয়েছে যে, তারা প্রস্তাবটি সমর্থন করবে৷ তবে তার আগে বিলে কিছু সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে তারা৷