চলচ্চিত্র শিল্পে শুল্ক বোমা ট্রাম্পের
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
একের পর এক শুল্ক আরোপ থেকে অভিবাসীদের জন্য ভিসা, নানা ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কঠোর নীতির ঘোষণা করেছেন। সেই তালিকায় যুক্ত হল সিনেমা।
চলচ্চিত্রে শুল্ক আরোপ
সোমবার ফের শুল্ক চাপানোর কথা ঘোষণা করেনট্রাম্প। এ বার নিশানায় অ্যামেরিকার বাইরে তৈরি সিনেমা। এসব সিনেমার উপরে ১০০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর কথা ঘোষণা করেছেন তিনি। নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, “আমাদের সিনেমার ব্যবসা অ্যামেরিকা থেকে অন্য দেশ চুরি করে নিয়েছে। শিশুর থেকে লজেন্স নিয়ে নেয়ার মতো।”
রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প মে মাসের শুরুতে এই ধরনের শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে তিনি এ ব্যাপারে কিছু খোলসা করে বলেননি, যার ফলে বিনোদন শিল্পে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। সেই ধোঁয়াশা কাটিয়ে এবার বড়সড় ঘোষণার ধাক্কা এই শিল্পে।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ট্রাম্প গত জানুয়ারিতে হলিউডের প্রবীণ ও খ্যাতনামা অভিনেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেন। এর মধ্যে ছিলেন সিলভেস্টার স্ট্যালোনের মতো বিশ্বখ্যাত সিনেমা ব্যক্তিত্ব। অ্যামেরিকার বিনোদন শিল্পকে কীভাবে চাঙা করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। মার্কিন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সেদেশের তারকা অভিনেতারা প্রেসিডেন্টের কাছে সুপারিশ করেন, হলিউডের শিল্পকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনে সেদেশে তৈরি ছবির জন্য ট্যাক্স ক্রেডিট অর্থাৎ কর ছাড়ের সুবিধা দেয়া হোক।
চলচ্চিত্র শিল্পের উপর শুল্ক কবে ও কীভাবে কার্যকর হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। প্রোডাকশন হাউজের পাশাপাশি স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম, সিনেমা হলে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির ক্ষেত্রে কীভাবে শুল্ক ধার্য হবে, সেটা বোঝা যাবে হোয়াইট হাউস নয়া নীতির ব্যাখ্যা দিলে।
মার্কিন চলচ্চিত্রের হাল
হলিউডের চলচ্চিত্র শিল্প শুধু ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, হলিউডের ব্যানারে তৈরি হওয়া ছবির প্রোডাকশন হচ্ছে সে দেশের বাইরে। সাম্প্রতিক অতীতে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ডেডপুল অ্যান্ড উলভারিন, উইকেড, গ্লাডিয়েটর ২ এর শুটিং হয়েছে অ্যামেরিকার বাইরে। এর ফলে সে দেশের ছবিতে বিনিয়োগ করা অর্থের একটা বড় অংশ অন্য দেশে ব্যয় করতে হয়েছে নির্মাতাদের।
যদিও ট্রাম্পের দেশ এখনো বিনোদনের বিবিধ কনটেন্ট নির্মাণের কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত। চলচ্চিত্রে শিল্প নিয়ে গবেষণাকারী সংস্থা প্রোডপ্রো-র বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরে অ্যামেরিকায় বিভিন্ন ছবির প্রোডাকশনের জন্য ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু সে দেশের জন্য চিন্তার বিষয়, এই খরচের অঙ্ক ২০২২ সালের তুলনায় ২৬ শতাংশ কমেছে। অন্য দিকে এই ব্যয় বেড়েছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা ও ব্রিটেনে।
বিশেষ করে কানাডার জন্য এই ঘোষণা অনেকটা বজ্রপাতের মতো। সে দেশের বণিকসভার কর্তাকে উদ্ধৃত করে বিবিসি লিখেছে, যেসব মার্কিন প্রযোজনা সংস্থা কানাডায় ছবি তৈরি করছে, তাদের খরচ অনেকটা বেড়ে যাবে। এর ফলে দুই দেশের অর্থনীতিই ধাক্কা খাবে। মাঝারি আয়ের যেসব কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছিল, সেসব সংকুচিত হবে।
অ্যামেরিকায় বাইরে ছবির শুটিং করার ক্ষেত্রে যে সুযোগ-সুবিধা ও আর্থিক আনুকূল্য মার্কিন প্রযোজনা সংস্থাগুলি পাচ্ছে, তাতে ট্রাম্পের দেশের হলিউড কেন্দ্রিক কর্মসংস্থান ছোট হয়ে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন নীতি কার্যকর হলে প্রযোজনা সংস্থা অ্যামেরিকাতেই শুটিং ও সিনেমা নির্মাণে বাধ্য হবে। যারা স্ক্রিপ্টের খাতিরে ভিন দেশে প্রোডাকশন চালিয়ে যাবেন, তাদের উপরে ধার্য ১০০ শতাংশ শুল্ক শেষমেশ দর্শক বা গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এতে সিনেমা বা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে বিনোদন উপভোগ করার খরচ বেড়ে যাবে।
ভারতীয় সিনেমার সমস্যা
বলিউডে তৈরি সিনেমার বড় বাজার অ্যামেরিকা। সেদেশে বসবাসকারী ভারতীয় প্রবাসীদের সংখ্যা ৫২ লক্ষেরও বেশি। এরা হিন্দি বা দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার দর্শক। অন্যান্য দেশের মতো ভারতে তৈরি ছবিতে ১০০ শতাংশ হারে শুল্ক চাপলে বাজার হারাতে পারে বলিউড।
এর ফলে টিকিটের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে, এতে সিনেমা হলে আসা দর্শকদের সংখ্যা ক্রমশ কমবে। ফলস্বরূপ, ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলিতে দর্শকরা ঝুঁকতে শুরু করবেন। সিনেমা হলে সিনেমা দেখার তুলনায় স্ট্রিমিং পছন্দ করবেন। কানাডার মতো ভারতের বিভিন্ন সংস্থা হলিউডের ছবির জন্য নানা ধরনের কনটেন্ট তৈরি করে। এ ধরনের আউটসোর্সিংয়ের কাজ কমে আসতে পারে ট্রাম্পের শুল্ক বোমায়।
বিদেশের মাটিতে ভারতীয় সিনেমার আয়ের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ আসে অ্যামেরিকা থেকে। সেখানকার বাজার বলিউড এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সিনেমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শুল্ক বৃদ্ধির ফলে টিকিটের দাম ছাড়াও ডিস্ট্রিবিউশনের খরচ দ্বিগুণ হতে পারে। এটা অনেক ভারতীয় চলচ্চিত্রের মুক্তির পথে বাধা সৃষ্টি করবে। ছোট এবং মাঝারি বাজেটের প্রযোজনা সংস্থাগুলি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে, যেহেতু সেগুলির লাভের হার খুবই কম।
ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক মানস ঘোষ ডিডাব্লিউকে বলেন, "একদিকে হলিউডে দীর্ঘদিন ধরে স্ট্রাইক, বিভিন্ন রকম অশান্তি চলছে। হলিউড খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। অন্যদিকে ক্রমাগত অন্যান্য ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, যেমন বলিউড এবং হংকং ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিনেমার দৌলতে গ্লোবাল সেন্টার তৈরি করেছে। এই দুটো চাপে হলিউডের অবস্থা এই মুহূর্তে খারাপ। ট্রাম্প শুল্ক চাপিয়েছেন যাতে হলিউড অন্তত নিজের দেশের সার্কুলেশন ভালো করতে পারে। এ কারণে ট্রাম্প বলিউড ও দক্ষিণ এশিয়ার ছবিগুলোর উপরে আস্তে আস্তে শুল্ক চাপিয়ে প্রতিকূলতার মধ্যে ফেলতে চাইছেন।"
ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এর কতটা প্রভাব পড়বে? তিনি বলেন, "বলিউডের অবস্থা আর্থিকভাবে এই মুহূর্তে খারাপ। সাম্প্রতিক অতীতে একের পর এক ছবি ফ্লপ হয়েছে। একমাত্র শাহরুখ খানের পর পর তিনটে ছবি বড় হিট দিয়েছে। তাছাড়া অনেকদিন ধরে নেই বিগ হিট। এই শুল্ক নীতির ফলে বলিউড ভালোই ক্ষতির মুখে পড়বে। কিন্তু দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা অতটা চাপে পড়বে না। দক্ষিণ ভারতীয় ছবিগুলোর সার্কুলেশন মালয়েশিয়া, হংকং, ফিলিপাইনস, দুবাই, জাপান ইত্যাদি জায়গায় রয়েছে। যেখানে দক্ষিণ ভারতীয় প্রবাসী রয়েছেন, সেখানেই মূলত এর রাজস্ব উঠে আসছে। জাপানের সঙ্গে তামিল ছবির অনেক দিনের সম্পর্ক। জাপানের রজনীকান্তের ফ্যান ফলোয়িং আছে। ফলে এটা বলা যায় অ্যামেরিকাকে বাদ দিয়েও দক্ষিণ ভারতীয় ছবি চলতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া,ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপপুঞ্জগুলোয় দক্ষিণ ভারতীয় ছবির একটা বড় বাজার আছে। এখানে হিন্দি ছবিরও বাজার আছে। বলিউড যেহেতু একটু তলানিতে আছে, তাদের জন্য এটা একটা ক্ষতি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আমেরিকার সেই সমস্ত দর্শক যারা বলিউডের ছবি দেখতে পছন্দ করেন।"
লেখক ও চলচ্চিত্র গবেষক সোমেশ্বর ভৌমিক ডিডাব্লিউকে বলেন, "পৃথিবী জুড়েই এর প্রভাব পড়বে। এটা সাপ্লাই চেইন-এর যুগ। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় উৎপাদন সীমাবদ্ধ থাকে না। যেখানে খরচ কম হয়, সেখানে একটা নির্দিষ্ট সেগমেন্ট বা পুরো ফিল্মটা তৈরি হয়। যেমন, ভারতের থ্রিডি কাজ নিয়মিত হলিউডে রফতানি হয়। এখন সারা পৃথিবী জুড়েই লোকেশন। সর্বত্র শুটিং হয়। একটা ফিল্মের পুরোটাই বাইরে তৈরি হলে সেটার উপরে শুল্ক চাপানো হবে, নাকি সামান্য অংশ যদি বাইরে থেকে করিয়ে নিয়ে ওখানে ব্যবহার করা হয়, তাহলেও শুল্ক চাপানো হবে? এই ব্যাপারটা এখনও পরিষ্কার নয়। খরচের দিক থেকে যেখানে সুবিধা দেখবেন, প্রযোজকরা সেখানেই কাজ করবেন। কেউই এখন একই জায়গায় নির্মাণের সব কাজ সম্পন্ন করতে আগ্রহী নন। হলিউড স্টুডিওগুলোর ইউনিট জাপান, ভারতেও আছে। হায়দরাবাদের স্টুডিওতে স্পেশাল এফেক্ট-এর কাজ করালে তার জন্য শুল্ক দিতে হবে কি না, সেগুলো এখনো পরিষ্কার নয়।"
তিনি বলেন, "ভারতীয় ছবির উপরে এই মাত্রায় শুল্ক বসানো হলে তো তার ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। অন্তত অ্যামেরিকায় তাদের রিলিজ নিয়ে সন্দেহ থাকবেই। যারা এক্সপোর্ট করেন ভারতীয় ছবি, তারা সেই পরিমাণ শুল্ক রাজি কিনা, সেটাও দেখতে হবে। হয়তো সব ছবি যাবে না, ছবি রফতানির সংখ্যা কমে যাবে ছবি।"
ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক অধ্যাপক অনিন্দ্য সেনগুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, "গ্লোবালাইজেশন-এর জন্য সমস্ত পৃথিবীর বাজার সবার কাছে খোলা ছিল। ট্রাম্প যেটা করছেন সেটা এর বিপরীত। উনি মার্কিন সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। অন্য অনেক দেশের ছবি থেকে কিছু বার্তা চলে আসতে পারে যেটা ওনার পছন্দ নাও হতে পারে, তাই উনি গোটা জিনিসটার উপরে নিজের একটা কর্তৃত্ব ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। বিনোদন এবং সংস্কৃতির উপর কর্তৃত্ব রাখাটা খুবই কঠিন। ট্রাম্পের এই প্রচেষ্টা খুব একটা সফল হবে বলে মনে হয় না।"
তার মতে, "ভারতে যেরকম সেন্সরসিপ আছে, তেমনি ট্রাম্প ভবিষ্যতে অ্যামেরিকায় আনতে চলেছেন। সেদেশে ভারতের মতো জাতীয় সেন্সর কিছু হয় না। উনি বিরোধীর স্বর দমাতে পারছেন না বলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। তাই উনি নিজের দেশের ছবি-সহ বাইরের দেশের ছবিকেও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। এই সিদ্ধান্ত বেশি দিন টিকবে না। ওদের ব্যবসাই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বলিউডের অবস্থা নতুন করে আর খারাপ হওয়ার মতো নেই। বিনোদন শিল্পের উন্নতির কথা ভেবে নয়, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত তার দেশের ব্যবসার সুরক্ষার কথা ভেবে। এটা গ্লোবাল ব্যবসার জন্য খুব খারাপ।"